অদ্ভুত আতিথেয়তা
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
লেখক পরিচিতিঃ
‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’ নামটি আমাদের কাছে অতি পরিচিত একটি নাম। তিনি উনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক এবং সাহিত্যকার। তাঁর আসল নাম ছিল ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, কিন্তু সংস্কৃত ভাষা এবং সাহিত্যে তাঁর অগাধ জ্ঞানের জন্য তিনি বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ করেন। আধুনিক বাংলা লিপির প্রধান সংস্কারক এবং বাংলা গদ্যের প্রথম সার্থক রূপকার তিনিই। আজকের দিনেও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘বর্ণপরিচয়’ দিয়েই শিশুদের বাংলা ভাষা শিক্ষার শুরু হয়৷
তাঁকে তথাকথিত সাহিত্যিকের গণ্ডিতে বাঁধা যায় না, তাঁর সকল কাজের মূল চালিকা শক্তি ছিল সমাজ, শিক্ষা ও ভাষার সংস্কার ও উন্নতি সাধন। তাঁর এই চিন্তার প্রতিফলন তাঁর সাহিত্যকর্মের মধ্যে বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়। তাঁর সাহিত্যকাজের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল কথামালা (১৮৫৬), আখ্যানমঞ্জরী, বেতাল পঞ্চবিংশতি (১৮৪৭) শকুন্তলা (১৮৫৪), সীতার বনবাস (১৮৬০), মহাভারত, ভ্রান্তিবিলাস (১৮৬৯) প্রভৃতি।
উৎসঃ
অদ্ভুত আতিথেয়তা গল্পটি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচিত ‘আখ্যানমঞ্জরী’ গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।
বিষয়সংক্ষেপঃ
আরব জাতির সঙ্গে মুর জাতির যুদ্ধে একদিন আরবসেনা এক মুরসেনাপতির পিছু নেন। মুরসেনাপতি দিক হারিয়ে শত্রু সৈন্যের শিবিরে চলে যান। সেখানে আশ্রয় প্রার্থনা করলে জনৈক আরবসেনাপতি পরম আদরে অতিথি জ্ঞানে তাঁকে আশ্রয় দেন এবং তাঁকে সেবা-যত্ন-পরিচর্যা করে সুস্থ করে তােলেন। তারপর তারা উভয়ই বধুভাবে কথাবার্তা শুরু করেন। প্রত্যেকেই নিজ পূর্বপুরুষের বীরত্বগাথা ও যুদ্ধের কৌশল বলতে থাকেন।
সহসা আরবসেনাপতি ভারাক্রান্ত মনে উঠে যান। কিছুক্ষণ পর মুরসেনাপতিকে অনুচর মারফত বলে পাঠান, তাঁর শরীর অসুস্থ, তাই নিজে থেকে তিনি তাঁর সেবা করতে পারছেন না। তা ছাড়া মুরসেনাপতির ঘােড়ার যা অবস্থা, তাতে সে কোনােভাবেই নিরাপদে নিজের শিবিরে ফিরে যেতে পারবেন না। তবে দুশ্চিন্তার কারণ নেই, তিনি সব ব্যবস্থা করে নিজে তাঁকে বিদায় দেবেন।
রাত্রিশেষে আরবসেনাপতির লােক মুরসেনাপতিকে ডেকে তুললেন। প্রাতঃকৃত্য শেষে মুরসেনাপতি দেখলেন, আরবসেনাপতি ঘােড়ার মুখের দড়ি ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। মুরসেনাপতিকে সাদর সম্ভাষণ করে তিনি বললেন- গত রাতে তারা যখন পরস্পর কথা বলছিলেন তখন তিনি কথার মাধ্যমে জেনে যান, সেই-ই তাঁর বাবার হত্যাকারী । সুতরাং, তিনি পিতৃহন্তাকে বধ করবেন। তবে তাঁর প্রতিজ্ঞা, সূর্যোদয়ের পরেই তিনি এ কাজ করবেন। অথচ আরবের জাতীয় ধর্ম কোনাে আশ্রিতকে তাঁর শত অপরাধ সত্ত্বেও আশ্রয়স্থলে হত্যা করা যায় না। উপরন্তু গৃহস্বামীকেই তাঁর নিরাপত্তা প্রদান করতে হয়। তাই মুরসেনাপতি যেন সত্বর চলে যান। কারণ সূর্য উঠলে, তিনি পিতৃহন্তার সন্ধানে বেরােবেন। তার মধ্যে যদি সে পালাতে পারে, তবে দুজনেই বেঁচে থাকবেন। এ কথা বলে পরস্পর শুভেচ্ছা বিনিময় করে মুরসেনাপতিকে কিছু আগে বেরােনােয় সাহায্য করলেন। মুরসেনাপতির ঘােড়াকে যথেষ্ট শক্তিশালী ও দ্রুতগামী করে তিনি নির্বিঘ্নে নিজ শিবিরে ফিরে গেলেন। আরবসেনাপতি সূর্যোদয়ের পর তাঁর পিছু নিলেন। কিছুটা গেলেন, কিন্তু দেখলেন মুরসেনাপতি তাঁর দলের শিবিরে ঢুকে গিয়েছেন। অতঃপর তিনি ফিরে এলেন।
নামকরণঃ
সাহিত্যে নামকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা বিষয়বস্তুর গভীরে প্রবেশ পূর্বে বিষয় অনুধাবন ইঙ্গিবাহী। ‘অদ্ভুত আতিথেয়তা’ গল্পের নামকরণও তেমনই ইঙ্গিতবাহী। ‘অদ্ভুত আতিথেয়তা’ গল্পটি একটি মানবিক ধর্মের ও মানব-বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলক। ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সমাজ-সংস্কারের যে কঠিন ব্রত গ্রহণ করেছিলেন, এই গল্পের । মাধ্যমে তিনি সেই সামাজিক ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন।
সাধারণভাবে শত্রুকে কাছে পেয়ে দুর্বলতম পরিস্থিতিতে তাকে বধ করাই নিয়ম। অথচ এই গল্পে দেখা যায়, আরবসেনাপতির প্রধান শত্রু মুরসেনাপতি শ্রান্ত, মানসিকভাবে অবসন্ন ও দিকভ্রষ্ট। কিন্তু তাঁর আশ্রয় প্রার্থনা আরব জাতির জাতীয় নিয়মকে লঙ্ন করতে দেয়নি। পরিবর্তে দেখা যায়, শত্রুর প্রতি বিরুদ্ধ মনােভাব দূর করে সাদর আতিথেয়তায় বরণ এবং তাঁর মঙ্গলার্থে আপন ক্ষমতায় নিজেকে সমর্পণ। এমনকি, আরবসেনাপতি একসময় জানতেও পারেন যে, তাঁর পিতৃহন্তা মুরসেনাপতি নিজেই। তবুও তিনি নিজে সংযমী থেকেছেন, অতিথির অনিষ্টসাধন করেননি। পরদিন প্রাতে মুরসেনাপতিকে বিদায়কালে অতিথিস্বরূপ পরামর্শ দিয়েছেন এবং নিজ অন্তরের বাসনাও তিনি গােপন করেননি। আতিথেয়তার সাধারণ নিয়মে দৃশ্যটি আমাদের কাছে একান্ত দুর্লভ। তাই নীতিগত শিক্ষার এই আতিথেয়তা যে অদ্ভুত, তাতে কোনাে সন্দেহ নেই। সেই বিচারে কাহিনির ক্রমপরিণতিতে এই অদ্ভুত আতিথেয়তা’ নামকরণ অবশ্যই যথার্থ ও সার্থক।
• শব্দার্থ ও টীকা
• সহিত— সঙ্গে
• অশ্বারোহণে— ঘোড়ায় চড়ে
• বিরত— ক্ষান্ত
• একদা— একসময়
• মুর— উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার কৃষ্ণকায় মুসলমান জাতি
• সংগ্রাম— যুদ্ধ
• পলায়ন— পালিয়ে যাওয়া
• গমন— যাওয়া
• স্বপক্ষীয়— নিজের পক্ষের
• দিকভ্রম— দিকভুল
• বিপক্ষ— প্রতিপক্ষ
• শিবির সন্নিবেশস্থানে— যেখানে শিবির স্থাপন করা হয়েছে, সেখানে
• অশ্বপৃষ্ঠে— ঘোড়ার পিঠে
• কিয়ৎক্ষণ— কিছুক্ষণ
• পটমণ্ডপদ্বারে— তাঁবুর দরজায়
• আতিথেয়তা— অতিথিপরায়ণতা (অতিথির সেবা করা)
• সাধ্যানুসারে— সামর্থ্য অনুসারে
• অনাদর— অবহেলা
• বিদ্বেষপ্রদর্শন— হিংসাপূর্ণ আচরণ করা
• তৎক্ষণাৎ— সঙ্গে সঙ্গে
• ক্ষুৎপিপাসা— খিদেতেষ্টা
• উদ্যোগ— আয়োজন
• পিপাসাশান্তি— পিপাসা নিবৃত্ত করা
• গাত্রোত্থান— উঠে পড়া
• অশ্ব— ঘোড়া
• পঁহুছিতে— পৌঁছোতে
• তেজস্বী— শক্তিমান
• দণ্ডায়মান— দাঁড়িয়ে আছে এমন
• সত্বর— তাড়াতাড়ি
• আনুকূল্য— সহায়তা, উপকার
• আলয়ে— গৃহে
• অনুমাত্র— সামান্য
• পরিচর্যা— যত্ন
• বিপক্ষতাচরণ— বিরোধিতা
• প্রার্থিত— চাওয়া হয়েছে এমন
• আহারাদির— খাওয়া-দাওয়ার
• ক্ষুন্নিবৃত্তি— আহারের ফলে ক্ষুধার (খিদে) উপশম, খিদের কষ্ট দূর হওয়া
• উপবিষ্ট— বসা, আসীন
• ক্লান্তি পরিহার— ক্লান্তি দূর করা
• স্বীয়— নিজের
• বিবর্ণ— ম্লান, বর্ণহীন
• প্রস্থান— চলে যাওয়া
• হতবীর্য— দুর্বল, ক্লান্ত, শক্তিহীন
• প্রত্যুষ— ভোরবেলা
• সজ্জিত— সেজে
• সাক্ষাৎ— দেখা
• তদ্বিষয়ে— সেই বিষয়ে
• মর্মগ্রহ— অর্থ উপলব্ধি করা
• সন্দিহানচিত্তে— সন্দেহ মনে
• রজনীশেষে (আকাদেমি অভিধান অনুযায়ী ‘রজনিশেষে’)— রাতের শেষে
• নিদ্রাভঙ্গ— ঘুম ভাঙা
• আপনকার— নিজের
• গাত্রোত্থান— শয্যা থেকে উঠে পড়া
• মুখপ্রক্ষালন— মুখ ধোওয়া
• সমাপন— শেষ করা
• আহারস্থানে— খাওয়ার জায়গায়
• দর্শনমাত্র— দেখামাত্র
• মুখরশ্মি— মুখের দড়ি, লাগাম
• আরোহণ— চড়া
• সত্বর— তাড়াতাড়ি
• গাত্রোত্থান— শয্যা থেকে উঠে পড়া
• যৎকালে— যে সময়ে
• অশেষবিধ— অনেক, অজস্র
• বৃত্তান্তবর্ণন— কাহিনি বর্ণনা
• বৈরসাধন— শত্রুতা
• শ্রবণমাত্র— শোনামাত্র
• বাসনা— ইচ্ছা
• পিতৃহন্তা— পিতার হত্যাকারী
• সর্বস্বান্ত— সব হারানো
• প্রাণান্ত— মৃত্যু
• অনিষ্টচিন্তা— ক্ষতি করার চিন্তা
• বহির্গত— বাইরে যাওয়া
• অপগত— চলে গেছে এমন, দূরীভূত
• সম্ভাষণ— ডাকা, সম্বোধন করা
• করমর্দন— হাত মেলানো
• তদীয়— তার
• কতিপয়— কিছু, কয়েকটি
• সংকল্প— প্রতিজ্ঞা
• প্রবিষ্ট— প্রবেশ করেছে এমন
• প্রত্যাগমন— ফিরে যাওয়া
∆ ঠিক উত্তরটি বেছে নিয়ে লেখো।
১. যে গ্রন্থ থেকে ‘অদ্ভুত আতিথেয়তা’ গল্পটি নেওয়া হয়েছে –
(ক) সীতার বনবাস (খ) শকুন্তলা
(গ) আখ্যানমঞ্জরী (ঘ) কথামালা
উত্তরঃ (গ) আখ্যানমঞ্জরী।
২. আখ্যানমঞ্জরী গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল –
(ক) ১৮৬৩ (খ) ১৮৬৪ (গ) ১৮৬৫ (ঘ) ১৭৬৩
উত্তরঃ (ক) ১৮৬৩
৪. আরবদের সঙ্গে যুদ্ধ হয়েছিল—
(ক) মুরদের (খ) নিগ্রোদের (গ) আর্যদের
(ঘ) দ্রাবিড়দের
উত্তরঃ (ক) মুরদের।
৫. মুররা হল ________ কৃষ্ণকায় জাতি ।
(ক) দক্ষিণ আমেরিকার
(খ) উত্তর আমেরিকার
(গ) আফ্রিকার
(ঘ) এশিয়া
উত্তরঃ (গ) আফ্রিকার।
৬. মুরসেনাপতি আরবসেনাপতির ______
ছিলেন।
(ক) ভাই (খ) বন্ধু (গ) আত্মীয় (ঘ) শত্ৰু
উত্তরঃ (ঘ) শত্ৰু
৭. মুরসেনাপতি ________ প্রার্থনা করেছিল।
(ক) আশ্রয় (খ) বাসস্থান (গ) খাদ্য (ঘ) জল
উত্তরঃ (ক) আশ্রয়।
৮. ‘পটমণ্ডপ’ শব্দের অর্থ হল—
(ক) এলাকা (খ) তাঁবু (গ) পর্দা (ঘ) কুটির
উত্তরঃ (খ) তাঁবু
৯. আতিথেয়তার ক্ষেত্রে পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ জাতি হলো—
(ক) মুর (খ) আরব (গ) ফরাসি (ঘ) ইংরেজ
উত্তরঃ (খ) আরব।
১০. এই সময়ে সহসা আরব সেনাপতির মুখ _________ হইয়া গেল।
(ক) পীতবর্ণ (খ) বিবর্ণ (গ) রক্তবর্ণ (ঘ) গলদঘর্ম
উত্তরঃ (খ) বিবর্ণ
১১. ‘তদ্ বিষয়ে যথোপযুক্ত আনুকূল্য করিব’ – বক্তা—
(ক) মুর সেনাপতির পিতা
(খ) আরব সেনাপতি
(গ) মুর সেনাপতি
(ঘ) আরব সেনাপতি পিতা
উত্তরঃ (খ) আরব সেনাপতি
১২. আরবসেনাপতির পিতা হত্যাকারী হলেন –
(ক) মুরসেনাপতি
(খ) মুরসেনাপতির বন্ধু
(গ) মুরসেনাপতির সৈন্য
(ঘ) মুরসেনাপতির পূর্বপুরুষ
উত্তরঃ (ক) মুরসেনাপতি
১৪.. মুরসেনাপতিকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিয়ে তাকে দেওয়া হয়েছিল—
(ক) ঘোড়া (খ) হাতি (গ) রথ (ঘ) নৌকা
উত্তরঃ ঘোড়া
১৫. “আমাদের উভয়ের………সম্ভাবনা।” – উভয়ের যা যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল—
(ক) অর্থ যাওয়ার (খ) প্রাণ যাওয়ার
(গ) সম্মান যাওয়ার (ঘ) বিদেশ যাওয়ার
উত্তরঃ (খ) প্রাণ যাওয়ার
১৬. কারা মুর সেনাপতি কে অনুসরণ করেছিল –
(ক) ফরাসি সেনা (খ) আরব সেনা
(গ) ইংরেজসেনা (ঘ) মুরসেনা
উত্তরঃ (খ) আরব সেনা
১৭. ‘তাঁহার দিকভ্রম জন্মেছিল’ – কার ?
(ক) আরব্ সেনাপতির
(খ) ইংরেজ সেনাপতির
(গ) মুর সেনাপতির
(ঘ) মোঘল সেনাপতির
উত্তরঃ (গ) মুর সেনাপতির
১৮. আরবসেনাপতি তার পিতার হত্যাকারীকে বধ করবেন –
(ক) সূর্যাস্ত হইলে (খ) ভোর হইলে
(গ) মধ্যরাত্রি হইলে (ঘ) সূর্যোদয় হইলে
উত্তরঃ (ঘ) সূর্যোদয় হইলে
১৯. আরব সেনাপতি মুর সেনাপতিকে –
(ক) ধরতে পেরেছিলেন
(খ) হত্যা করেছিলেন
(গ) চাবুক মেরে ছেড়ে দিয়েছিলেন
(ঘ) উপরের কোনোটিই নয়
উত্তরঃ (ঘ) উপরের কোনোটিই নয়
২০. আরব সেনাপতির বৈরসাধন সংকল্প –
(ক) সফল হয়েছিল
(খ) সফল হয়নি
(গ) অর্ধেক সফল হয়েছিল
(ঘ) উপরের কোনোটিই নয়
উত্তরঃ (খ) সফল হয়নি