বনভোজনের ব্যাপার গল্পের শব্দার্থ ও প্রশ্নোত্তর অষ্টম শ্রেণি | Bonbhojoner Bepar- Narayan Gangopadhyay

WhatsApp Channel Join Now
Telegram Group Join Now
বনভোজনের ব্যাপার 
 নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
শব্দার্থ ও টীকা
১. পােলাও- ঘি-মশলা মাংস দিয়ে রাঁধা ভাত, পলান্ন
২. ডালনা- তরকারি ব্যঞ্জন-বিশেষ
৩. মাংসের কোর্মা- তুর্কি প্রথায় জল ব্যবহার না করে দই, কিশমিশ ও অন্যান্য মশলা দিয়ে রাঁধা মাংসের ঝােল
৪. কাবাব- শিক দিয়ে গেঁথে বিশেষ পদ্ধতিতে ঝলসানাে মশলা-যুক্ত মাংস
৫. কুঁদরু- পটলের মতাে দেখতে একপ্রকার সবজি
৬. ঠেকুয়া- ছাতু দ্বারা তৈরি বিস্কুট-জাতীয় খাবার
৭. পিকনিক- বনভােজন, চড়ুইভাতি, Picnic,
৮. ঝকমারি- ঝামেলা, বিপদ
৯. পােলাপান- ছেলেপুলে, (এখানে) ছেলেমানুষ অর্থে ব্যবহৃত
১০. গাড়লগুলাে- মূর্খ, নির্বোধগুলাে
১১. দলপতি- দলের নেতা
১২. প্ল্যান- পরিকল্পনা
১৩. ঠাট্টা- মজা, ইয়ার্কি
১৪. লিস্টি- লিস্ট, তালিকা
১৫. বেরসিক- রসবােধ নেই যার
১৬. বাবুর্চি- যিনি রান্না করেন
১৭. ট্র্যাক- কোমরের বাঁধন বা কষি, (এখানে) তহবিল অর্থে ব্যবহৃত
১৮. জুতসই- উপযুক্ত
১৯. গালপাড়া- দুই গাল জোড়া দাড়ি
২০. রফা- আপস, মীমাংসা
২১. হাতসাফাই- চুরি, হাতের কৌশল
২২. আইটেম- তালিকাভুক্ত বিষয়, (এখানে) তালিকাভুক্ত পদ
২৩. মগজ- বুদ্ধি, মস্তিষ্ক
২৪. ঘাবড়াই- ভয় পাই
২৫. সাবাড়- শেষ 
২৬. রাজকীয়- রাজার মতো 
২৭. ব্যাজার- অপ্রসন্ন, বিরক্ত 
২৮. গেরো- গিঁট, এখানে আপদ অর্থে ব্যবহৃত 
২৯. পাকড়ালাম- ধরলাম 
৩০. খলিফা- মুসলমান সমাজের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি, ধর্মগুরু, নিপুণ শিল্পী, ওস্তাদ; মন্দ অর্থে অতিশয় ধূর্ত ব্যক্তি
৩১. বিতিকিচ্ছিরি- কুৎসিত, অত্যন্ত বিশ্রী 
৩২. বদখত- বিশ্রী, কদর্য, বেয়াড়া
৩৩. রোয়াক- বারান্দা 
৩৪. ডাঁট- অহংকার, গর্ব, দেমাক 
৩৫. চালিয়াতি- ধাপ্পাবাজ
৩৬. গাঁট- পকেট
৩৭. একরাশ- প্রচুর
৩৮. ছাড়ান দাও- ছেড়ে দাও
৩৯. মোটঘাট- পুঁটলি, মালপত্র
৪০. পরিণাম- ফলাফল
৪১. ভাঁড়ার ঘর- ভান্ডার
৪২. পোঁটলা- বড়ো পুঁটলি/বোঁচকা
৪৩. করুণ- দুঃখী
৪৪. হুংকার- গর্জন
৪৫. গণ্ড- ব্যর্থ, বিফল
৪৬. দ্রাক্ষাফল- আঙুর ফল
৪৭. অতিশয়- খুব
৪৮. খাট্টা- টক
৪৯. স্রেফ- শুধু, একদম
৫০. স্পঞ্জ- কৃত্রিমভাবে রাসায়নিক উপায়ে তৈরি এক ধরনের পদার্থ, যা শোষণের কাজে ব্যবহৃত হয়।
৫১. গুরুপাক- সহজে হজম করা যায় না এমন, দুম্পাচ্য
৫২. পাহারা- নজরদারি, চৌকি দেওয়া
৫৩. হরিমটর- উপবাস/উপােস 
৫৪. অমৃত- সুস্বাদু
৫৫. ঊর্ধ্বশ্বাসে- অতি দ্রুত
৫৬. পাষাণ- পাথর, নিষ্ঠুর
৫৭. মন্ত্রমুগ্ধ- আচ্ছন্ন, সম্মােহিত 
৫৮. গোদা- মােটা
৫৯. তরিবত- তৃপ্তি, সন্তোষ
৬০. ভেংচি- ভেংচানাের জন্য মুখের বিকৃতি, বিদ্রুপ করার অঙ্গভঙ্গি
৬১. শােকসভা- শােক প্রকাশক সভা
৬২. স্তব্ধ- নিশ্চুপ
৬৩. অগত্যা- কোনাে উপায় না থাকা
৬৪. কোপ্তা- মসলা সহযোগে প্রস্তুত মাছ বা মাংসের ভাজা বড়া বিশেষ
                   হাতে কলমে 
১.১ নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের কোন বিখ্যাত চরিত্রের সৃষ্টিকর্তা?
উত্তরঃ টেনিদা।
১.২ তাঁর লেখা দুটি উপন্যাসের নাম লেখো। 
উত্তরঃ ‘শিলালিপি’ ও ‘লালমাটি’।
২. নীচের প্রশ্নগুলির কয়েকটি বাক্যে উত্তর দাও : 
২.১ বনভােজনের উদ্যোগ কাদের মধ্যে দেখা গিয়েছিল ? 
উত্তরঃ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছােটোগল্পকার ও ঔপন্যাসিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রচিত ‘বনভােজনের ব্যাপার’ গল্পে টেনিদা, ক্যাবলা, হাবুল ও প্যালার মধ্যে বনভােজনের উদ্যোগ দেখা গিয়েছিল। 
২.২ বনভােজনের জায়গা কোথায় ঠিক হয়েছিল ? 
উত্তরঃ বনভােজনের জায়গা ঠিক হয়েছিল বাগুইআটি ছাড়িয়ে আরও চারটে স্টেশন পরে ক্যাবলার মামার বাড়ির কাছে এক বাগানবাড়িতে। 
২.৩ বনভােজনের জায়গায় কীভাবে যাওয়া যাবে ? 
উত্তরঃ বনভােজনের জায়গায় যেতে প্রথমে শ্যামবাজার থেকে মার্টিনের রেলে চাপতে হবে। ওই ট্রেনে করে বাগুইআটি ছাড়িয়ে আরও চারটে স্টেশন পার করে নামতে হবে। সেখান থেকে নেমে প্রায় মাইলখানেক রাস্তা হেঁটে গেলে বনভােজনের জায়গায় পৌঁছনাে যাবে। 
২.৪ রাজহাঁসের ডিম আনার দায়িত্ব কে নিয়েছিল ?
উত্তরঃ রাজহাঁসের ডিম আনার দায়িত্ব প্যালা নিয়েছিল। 
২.৫ বনভােজনের বেশিরভাগ সামগ্রী কারা সাবাড় করেছিল ?
উত্তরঃ বনভােজনের বেশিরভাগ সামগ্রী বানরের দল সাবাড় করেছিল। 
২.৬ কোন খাবারের কারণে বনভােজন ফলভােজনে পরিণত হল ?
উত্তরঃ বাগানের একটি গাছে পেকে থাকা জলপাই খাওয়ার ফলে বনভােজন পরিণত হয় ফলভােজনে।
৩ নীচের শব্দগুলির সন্ধি বিচ্ছেদ করাে : মােগলাই, রান্না, বৃষ্টি, পরীক্ষা, আবিষ্কার। 
» মােগলাই = মােগল+ আই।
» রান্না =রাঁধ্ + না। 
» বৃষ্টি = বৃষ্ + তি।
» পরীক্ষা = পরি + ঈক্ষা। 
» আবিষ্কার = আবিঃ + কার।
৬. ব্যাসবাক্য-সহ সমাসের নাম লেখাে : বনভােজন, দলপতি, বেরসিক, দ্রাক্ষাফল, রেলগাড়ি। 
» বনভােজন = বনে ভােজন-অধিকরণ তৎপুরুষ সমাস। 
» দলপতি = দলের পতি-সম্বন্ধ তৎপুরুষ সমাস।
» বেরসিক = বে (নয়) রসিক– না তৎপুরুষ সমাস। 
» দ্রাক্ষাফল = দ্রাক্ষা নামক ফল— মধ্যপদলােপী কর্মধারয় সমাস। 
» রেলগাড়ি = রেল বাহিত গাড়ি—মধ্যপদলােপী কর্মধারয় সমাস।
৭ নির্দেশ অনুযায়ী বাক্য পরিবর্তন করা : 
৭.১ লাফিয়ে উঠে টেনিদা বাগানের দিকে ছুটল। (জটিল বাক্যে) 
উত্তরঃ লাফিয়ে উঠে টেনিদা যেদিকে বাগান সেদিকে ছুটল। 
৭.২। চোখের পলকে বানরগুলাে গাছের মাথায়। (জটিল বাক্যে) ) 
উত্তরঃ যেই-না চোখের পলক ফেলা, অমনি বানরগুলাে গাছের মাথায়। 
৭.৩ দুপুর বেলায় আসিস। বাবা-মেজদা অফিসে যাওয়ার পরে। (একটি সরল বাক্যে)
উত্তরঃ দুপুর বেলায় বাবা-মেজদা অফিসে যাওয়ার পরে আসিস। 
৭.৪ ইচ্ছে হয় নিজে বের করে নাও। (জটিল বাক্যে)
উত্তরঃ যদি ইচ্ছে হয় তাহলে নিজে বের করে নাও। 
৭.৫ টেনিদা আর বলতে দিলে না। গাঁক গাঁক করে চেঁচিয়ে উঠল। (একটি সরল বাক্যে) 
উত্তরঃ টেনিদা আর বলতে না-দিয়ে গাঁক গাঁক করে চেঁচিয়ে উঠল। 
৮ নীচের শব্দগুলির সমার্থক প্রবচনগুলি খুঁজে বের করাে এবং তা দিয়ে বাক্যরচনা করাে : চুরি, নষ্ট হওয়া, পালানাে, গােলমাল করে ফেলা, লােভ দেওয়া, চুপ থাকা। 
» চুরি—(হাত সাফাই করা) = হাবুল দিদিমার ঘর থেকে আমের আচার হাতসাফাই করেছিল। ) 
» নষ্ট হওয়া –(বারােটা বাজা) = মহিম তার জল-খাবার নিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়ায় জলখাবারের বারােটা বাজল। 
» পালানাে–(হাওয়া হওয়া)= কালীবাবুর বাগানের আম চুরি করে ধরা পড়ার ভয়ে বলাই সেই রাত্রে বাড়ি থেকে হাওয়া হল।
» গােলমাল করে ফেলা—(তালগােল পাকানাে)= অর্পিতা টিভি দেখতে দেখতে অঙ্ক করতে গিয়ে সব তালগােল পাকিয়ে ফেলেছে। 
» লােভ দেওয়া —(নজর দেওয়া) = অপরের সম্পত্তিতে নজর দেওয়া ভালাে নয়।
» চুপ থাকা—(মুখে কুলুপ আঁটা) = মার খাওয়ার ভয়ে ঈশান তার দাদার সামনে মুখে কুলুপ এটে রইল। 
৯ টীকা লেখাে : কলম্বাস, লেডিকেনি, বিরিয়ানি, ইউরেকা।
কলম্বাস: ক্রিস্টোফার কলম্বাস ১৪৩৬ খ্রিস্টাব্দে ইটালির জানােয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পঞ্চদশ শতকে উত্তর আমেরিকা মহাদেশ আবিষ্কার করেন। তিনি ছিলেন তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন, মেধাবী মানুষ। তিনি ইতিহাস, ভূগােল, জ্যামিতি ও জ্যোতিষ শাস্ত্রে পারদর্শী ছিলেন। নৌবিভাগে চাকরি নিয়ে স্পেনের রাজা ফার্দিনান্দ ও রানি ইসাবেলার সাহায্যে ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভারতে আসার জন্য যাত্রা শুরু করেন। তিনি ভারতবর্ষে আসতে গিয়ে আমেরিকা মহাদেশের মধ্যভাগে পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে জাহাজ নিয়ে পৌছেছিলেন এবং সেখানকার অধিবাসীদের নাম দিয়েছিলেন রেড ইন্ডিয়ান।  
লেডিকেনি : ছােটো পানতুয়া বা পানতুয়ার মতাে মিঠাই-বিশেষ। কথিত আছে, লর্ড ক্যানিং তাঁর স্ত্রীকে খুশি করার জন্য কলকাতার প্রখ্যাত ময়রা নবীনচন্দ্রকে মিষ্টান্ন তৈরি করতে বললে, তিনি এমন এক মিষ্টান্ন উদ্ভাবন করেন। লেডি ক্যানিং এই জাতীয় মিষ্টি খুবই পছন্দ করতেন। তাই তাঁর নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়। 
বিরিয়ানি : মাংস বা মাছ সহযােগে প্রস্তুত পােলাও জাতীয় খাবার-বিশেষ। সুগন্ধি চাল, মাছ বা মাংস, গরম মশলা (দারুচিনি, এলাচ, লবঙ্গ, জাইফল, জয়িত্রী, কাবাব চিনি), ঘি, তেজপাতা, নুন, চিনি, গােলাপ জল, হলুদগুঁড়াে, লঙ্কাগুঁড়াে, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, কাঁচালঙ্কা, সাদা তেল সহযােগে এই খাদ্য প্রস্তুত করা হয়। এটি প্রধানত মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত হলেও বর্তমানে সকল সম্প্রদায়ের মধ্যেই বিশেষ প্রিয় খাদ্যরূপে মর্যাদা পেয়েছে। কথিত আছে, সুলতান রাজিয়া তাঁর সেনাদের জন্য এই খাদ্যের প্রচলন করেন । 
ইউরেকা : এই শব্দটি গ্রিক ‘heureka’ থেকে এসেছে। যার অর্থ—“আমি খুঁজে পেয়েছি।” ইংরেজিতে I have found it? Oxford English Dictionary-60তে Eureka শব্দের অর্থ করা হয়েছে— ‘Used to show pleasure at having found 5th, especially the answer to a problem’। সাধারণত কোনাে বিশেষ কিছু হঠাৎ আবিষ্কৃত হলে, আমরা এই শব্দটি প্রয়ােগ করে থাকি। আর্কিমিডিস একবার একটি চৌবাচ্চায় নামার সঙ্গে সঙ্গে তার কিছুটা জল উপচে পড়ে যায়, তখন তিনি ‘ইউরেকা’ বলে চেঁচিয়ে ওঠেন, যার অর্থ হল ‘পেয়েছি। পরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শব্দভাণ্ডারে এই শব্দটি বহুলভাবে প্রচলিত হয়।
১০ নীচের প্রশ্নগুলির সংক্ষিপ্ত ও যথাযথ উত্তর দাও : 
১০.১ বনভােজনের প্রথম তালিকায় কী কী খাদ্যের উল্লেখ ছিল ? তা বাতিল হল কেন ?
উঃ বিখ্যাত ছােটোগল্পকার নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রচিত। ‘বনভােজনের ব্যাপার’ শীর্ষক ছােটোগল্পে উদ্ধৃত বনভােজনের প্রথম তালিকায় বিরিয়ানি, পােলাও, কোর্মা, কোপ্তা, কাবাব (দু-রকম), মাছের চপ প্রভৃতি খাদ্যের উল্লেখ ছিল।
   » প্রথম তালিকায় যেমন খাদ্যের উল্লেখ করা হয়েছিল, তার খরচ নেহাত কম ছিল না। তারপর ক্যাবলা জানায় বাবুর্চি, চাকর, মােটগাড়ির জন্য আরও দু-শাে টাকা খরচা হবে। অথচ, তাদের চারজনের চাঁদাই উঠেছে মাত্র দশ টাকা ছ-আনা। সুতরাং, ওসবের খরচ যােগাড় করা অসম্ভব। মূলত খরচা কমাতেই বনভােজনের খাদ্যের প্রথম তালিকা বাতিল করতে হয়েছিল।
১০.২ বনভােজনের দ্বিতীয় তালিকায় কী কী খাদ্যের উল্লেখ ছিল এবং কে, কী কাজের দায়িত্ব নিয়েছিল ? 
উঃ বনভােজনের দ্বিতীয় তালিকায় খিচুড়ি, আলুভাজা, পােনা মাছের কালিয়া, আমের আচার, রসগােল্লা, ও লেডিকেনির উল্লেখ ছিল। এছাড়াও ডিমের ডালনা লিস্টে ছিল। 
    » প্যালা রাজহাঁসের ডিম আনার দায়িত্ব নিয়েছিল । ক্যাবলা নিয়েছিল আলু ভাজার দায়িত্ব, প্যালা নিয়েছিল পােনা মাছের কালিয়া রাঁধার দায়িত্ব এবং হাবুল নিয়েছিল দিদিমার ঘর থেকে আমের আচার সংগ্রহ করার দায়িত্ব । 
১০.৩ প্যালার রাজহাঁসের ডিম আনার ঘটনাটির বর্ণনা দাও। 
উঃ প্যালা রাজহাঁসের ডিম জোগাড় করার জন্য ভন্টাকে ধরেছিল। কারণ ভন্টাদের বাড়িতেই কয়েকটি রাজহাঁস ছিল। ভন্টা দু-আনার পাঁঠার ঘুগনি ও ডজনখানেক ফুলুরি খাওয়ার পরে জানিয়েছিল যে, সে ডিম দিতে পারে কিন্তু প্যালাকে তার নিজের হাতে বাক্স থেকে বের করে নিতে হবে। ভন্টা আইসক্রিমের পরিবর্তেও প্যালাকে ময়লা ঘেঁটে রাজহাঁসের ডিম বের করে দিতে রাজি হল না। অগত্যা প্যালাকে নিজের হাতে ডিম বের করার সিদ্ধান্ত নিতে হল। পূর্বের কথামতাে দুপুরবেলাতে সে এল। উঠোনের একপাশে কাঠের বাক্সের মধ্যে সার-সার খুপরি। তার মধ্যে দুটি হাঁস ডিমে তা দিচ্ছে। কাছে যেতেই তারা ফাস-ফাস করে উঠল। ময়লা ও বিশ্রী গন্ধকে উপেক্ষা করে, সাহস করে হাত ঢােকানাের সঙ্গে সঙ্গে একটা রাজহাঁস ঘটাং করে প্যালার হাতটি কামড়ে ধরল। রাজহাঁসের কামড়ের প্যালা চিৎকার করে উঠল। প্যালার গলার আওয়াজ পেয়ে ভন্টার মা জেগে উঠেছিল। ফলে ভয়ে হ্যাঁচকা টানে নিজের হাত ছাড়িয়ে প্যালা রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ােল। কিন্তু তখন তার হাত থেকে ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে। এইভাবে রাজহাঁসের ডিম আনতে গিয়ে রক্ত ঝরিয়ে ব্যর্থ মনােরথ হয়ে প্যালাকে ফিরতে হল। 
১০.৪ ট্রেন থেকে নেমে হাঁটতে গিয়ে তাদের কী কী বিপদ ঘটেছিল ?
উঃ গল্পকার নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রচিত ‘বনভােজনের ব্যাপার’ গল্পে বনভােজনে যাওয়ার পথে ট্রেন থেকে নেমে বনভােজনের জিনিসপত্র নিয়ে হাবুল, ক্যাবলা, প্যালা ও টেনিদা এগােতে লাগল। আগেরদিন বৃষ্টি হয়ে গ্রামের রাস্তা পিছল হয়েছিল। তিন পা যেতে না যেতেই হাবুল আছাড় খেল, তার হাতে থাকা ডিমের পুঁটলি কুঁকড়ে গিয়ে হলুদ রস পড়তে লাগল। এর পরেই প্যালা ও টেনিদা পড়ে গিয়ে তাদের আমের আচার ও রসগােল্লা সমেত মাটিতে লুটোপুটি খেল। অবশিষ্ট রইল শুধু চাল-ডালের পুঁটলিটি ও পোনামাছগুলি। গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই তাদের জামা কাপড় নোংরা হয়েছিল।
১০.৫ মাছের কালিয়ার তিনটে বেজে গেল’ মাছের কালিয়া সম্পর্কে এরকম বলার কারণ কী ? 
উঃ ‘বনভােজনের ব্যাপার’ গল্পের উদ্ধৃত প্রশ্নে মাছের কালিয়া রাঁধার দায়িত্ব ছিল প্যালার। টেনিদা লিস্ট বের করে প্যালাকে সর্বপ্রথম মাছের কালিয়া রাঁধার নির্দেশ দেয়। ক্যাবলার মা মাছ কেটে লবণ ও অন্যান্য জিনিস মাখিয়ে দিয়েছিলেন। প্যালা কড়াইতে তেল চাপিয়ে সঙ্গে সঙ্গে কাঁচা তেলে মাছ ঢেলে দেওয়ায় কড়াই ফেনায় পরিপূর্ণ হয়ে মাছগুলো একসঙ্গে তালগােল পাকিয়ে যায়। মাছের কালিয়া পরিণত হয় মাছের হালুয়াতে। আসলে কাঁচা তেলে মাছ দেওয়ায় মাছের এই অবস্থা হয়েছিল।   
১১ নীচের প্রশ্নগুলির উত্তর নিজের ভাষায় লেখাে
১১.১ এই গল্পটির নাম ‘বনভােজন’ না-হয়ে ‘বনভােজনের ব্যাপার’ হল কেন ?
উঃ কবিতা, নাটক, কথাসাহিত্য-সহ সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই নামকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়। নামকরণের মধ্য দিয়েই সর্বপ্রথম আমরা পাঠ্য বিষয়ের কাহিনি ও তার গভীরে প্রবেশ করতে চেষ্টা করি। আলােচ্য ‘বনভােজনের ব্যাপার’ গল্পটি নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের এক অনন্য সৃষ্টি।
          ‘বনভােজন’ হল ‘চড়ুইভাতি’ এবং ‘ব্যাপার’ বলতে আভিধানিক অর্থে ঘটনা, অনুষ্ঠান বা বিষয়কে বােঝানাে হয়। আলােচ্য গল্পে হাবুল, টেনিদা, প্যালা ও ক্যাবলা একটি বনভােজনের আয়ােজন করেছিল। অর্থের অপ্রতুলতার কারণে বনভােজনের খাদ্যের তালিকার অনেকটাই তাদেরকে হেঁটে ফেলতে হয়েছিল। যদিও পরে নির্বাচিত খাদ্য তালিকার ডিমের কালিয়া, রসগােল্লা এমনকি আমের আচার পর্যন্ত তাদের কপালে জোটেনি। চাল, ডাল, আলু ইত্যাদি খিচুড়ির প্রাথমিক উপাদানও বানরদলের সংগ্রহে চলে যায়। শেষে জলপাই খেয়ে তাদের বনভােজনকে ফলভােজনে পরিণত করতে হয়। আসলে গল্পকার আলােচ্য গল্পটিকে রসভােগ্য করে তুলেছেন তার কাহিনি বর্ণনার অপূর্ব গুণে। যেহেতু বনভােজনের মূল খাওয়াদাওয়া বা বিষয়টি শেষপর্যন্ত বনভােজন হয়ে রইল না, তা বনভােজনের একটি উপাদেয় গল্প বা ঘটনা হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে তাই কাহিনির নিপুণ বয়ন ও বিষয়কে লক্ষ রেখে বলা যায়, গল্পটির নামকরণ ‘বনভােজন’ না হওয়ার ফলে ‘বনভােজনের ব্যাপার হওয়ার ফলে সার্থক হয়েছে। 
১১.২ এই গল্পে কটি চরিত্রের সঙ্গে তােমার দেখা হল ? প্রত্যেকটি চরিত্র নিয়ে আলােচনা করাে।
উঃ কথাসাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রচিত ‘বনভােজনের ব্যাপার’ নামাঙ্কিত গল্পটিতে হাবুল সেন, ক্যাবলা, টেনিদা, প্যালা প্রভৃতি চরিত্রের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। 
» হাবুল সেন : নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় সৃষ্ট হাবুল সেন চরিত্রটি ঢাকাই বাঙাল। তার কথাবার্তার মধ্যে বাঙাল সদৃশ টান ও বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। সে পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজের অবস্থান বদলায় এবং সমস্ত বিষয়কে স্বাভাবিকভাবে, মানানসই রূপে গ্রহণ করার প্রবণতাও তার মধ্যে লক্ষণীয়। গল্পের প্রথমে দেখা যায়, হাবুল বনভােজনের খাদ্যতালিকা প্রস্তুত করার সময় টেনিদার মনের মতাে খাদ্যতালিকা প্রস্তুত করে। একজন প্রকৃত খাদ্যরসিকের মতাে ডিমের ডালনা, রুই মাছের কালিয়া, মাংসের কোর্মা, বিরিয়ানি, পােলাও তারও প্রিয় পদ। আবার প্যালা রাজহাঁসের ডিম আনার নাম করে সাধারণ ডিম আনলে টেনিদা রেগে যায়, সেই-ই সহমর্মিতাবশত তাকে আশ্বস্ত করে বলে যে, প্যালা ডিম এনেছে সেটিই বড়াে কথা। বনভােজনের প্রস্তুতিতে তার আগ্রহ কম নয়। হাবুল মােট চাঁদার এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ, চার টাকা নিজে দিয়েছে। সবমিলিয়ে চরিত্রটি কাহিনির উপযােগী হয়ে উঠেছে। 
» ক্যাবলা: ক্যাবলা একটি মজার চরিত্র। সে প্রত্যেকের কথার পর বা একটি করে ঘটনার পরে নিজের মন্তব্য পেশ করে। এটি তার চরিত্রের রসবােধের পরিচয় বহন করে। সে ছােটোবেলায় পশ্চিমে ছিল, তাই তার কথার মধ্যে দুই-একটি হিন্দি শব্দ মাঝে মাঝে বেরিয়ে পড়ে। ক্যাবলার চলাফেরা, কথাবার্তার মধ্যে একটি কৌতুকের লক্ষণ আছে। মাটির পিছল রাস্তায় বাগানবাড়িতে পৌঁছােনাের সময় হাবুল। ডিমের পুঁটলি-সহ আছাড় খেলে সে বলে—“ডিমের ডালনার বারােটা বেজে গেল। প্যালা আমের আচার। নিয়ে পড়ে গেলে সে মন্তব্য করে—‘আমের আচারের একটা বেজে গেল। সে জানে, সব লেডিকেনি টেনিদা একাই শেষ করবে। তাই বুদ্ধি করে খিচুড়ি রান্নার কাজ ক্যাবলাই টেনিদার কাঁধে চাপিয়ে দেয়। 
» টেনিদা : কথাসাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের এক অবিস্মরণীয় সৃষ্টি টেনিদা চরিত্রটি। টেনিদা আসলে সব জায়গায় দাদাগিরি দেখাতে চায়। তার আচরণের মধ্যে একটি ভারিক্কি ভাব বর্তমান। তার কাছে টাকা থাকলেও সে মুর্গ মুসল্লম, বিরিয়ানি খেতে পছন্দ করে। মাছের কালিয়া, মাংসের কোর্মা খাওয়ার কথা বলে অথচ, চাঁদার সময় ছয় আনা দেয়। সে রকমারি রসভােগ্য খাদ্য খেতে চায়। অথচ সেই খাদ্য সংগ্রহ করার দায়িত্ব দেয় অপরের ঘাড়ে। স্টেশন থেকে নেমে সঙ্গে নেওয়া খাদ্যের মধ্যে সবচেয়ে হালকা জিনিসটিই সে বহন করে। ট্রেনে চেপে লেডিকেনিগুলি তিনি একাই শেষ করে। অন্য কেউ পড়ে গিয়ে খাবার নষ্ট করলে তাকে সে শাস্তি দেয় কিন্তু নিজে পিছলে পড়ে রসগােল্লা নষ্ট করলে তখন চুপ থাকে। টেনিদা চরিত্রটি আমাদের বাংলা সাহিত্যের শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সৃষ্ট ‘নতুনদা’ চরিত্রটিকে স্মরণ করায়।
» প্যালা : প্যালা পুরাে কাহিনির বক্তা। সে অত্যন্ত সাধারণ, সাদাসিধে প্রকৃতির ছেলে। বনভােজনের খাদ্যতালিকা প্রস্তুতির সময় প্যালা কিছু সাধারণ খাদ্যের কথা জানায়—আলুভাজা, শুক্তো, বাটিচচ্চড়ি। প্যালা মাটির কাছাকাছি থাকা মানুষ। টেনিদাকে খুশি করার জন্য ডিমের একটি পদ সে-ই বাড়িয়ে দেয়। রাজহাঁসের ডিম জোগাড় করার দায়িত্বও সে নেয়। আসলে তার মধ্যে বাস্তববুদ্ধির পরিচয় মেলে। আবার টেনিদা তাকে শাস্তি দিলে সে মুখ বুজে তা সহ্য করে। সে এমনই নিরীহ। টেনিদার মুখের ওপর সে বড়াে একটা কথা বলে না। টেনিদার কথা থেকে জানা যায়, সে একটু পেটরােগা বলে প্রায় সারা বছরই শিঙিমাছের ঝােল-ভাত খায়। » অন্যান্য চরিত্র: এছাড়াও গল্পটিতে পার্শ্বচরিত্র হিসেবে ভন্টা ও ভন্টার মায়ের উল্লেখ পাওয়া যায়।
১১.৩ এ গল্পটিতে হাস্যরস সৃষ্টির জন্য ভাষার দিক থেকে লেখক নানারকম কৌশল অবলম্বন করেছেন। কী কী কৌশল তুমি খেয়াল করেছ লেখাে। 
উঃ নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রচিত ‘বনভােজনের ব্যাপার। গল্পে হাস্যরস হল প্রধান অলংকার। হাস্যরস সৃষ্টিতে তাঁর দক্ষতা সত্যই প্রশংসনীয়। চরিত্র সৃষ্টি, কাহিনির বুনন ছাড়াও ভাষাগতভাবে তিনি বেশ কিছু কৌশল অবলম্বন করেছেন। যেমন— 
(ক) ভাষার মধ্যে আরবি, ফারসি, ইংরেজি প্রভৃতি বিদেশি শব্দের প্রয়ােগ ঘটিয়েছেন। যেমন— বিরিয়ানি, মশলা, দোসা, বাবুর্চি, কাবাব ইত্যাদি। 
(খ) বিভিন্ন চরিত্রের সংলাপে কথ্যভাষার প্রয়ােগ লক্ষ করা যায়। যেমন—ময়লা আর কী বদখত গন্ধ! ‘চোঁচা দৌড়’, ‘হ্যাচকা টান’, ‘ফেরেববাজ’ ইত্যাদি 
(গ) হাবুল সেন চরিত্রের সংলাপে বঙ্গালি উপভাষার প্রয়ােগ দেখা যায়। যেমন—“আহা-হা চৈইত্যা যাইত্যাছ কেন?’ ‘পােলাপানে কয়’ ইত্যাদি। 
(ঘ) ধ্বনিগত দিক থেকে অপিনিহিতি, বর্ণবিপর্যয়, স্বরাগম প্রভৃতির প্রয়ােগ লক্ষ করা যায়। যেমন— ‘ইস্টুপিড’, ‘বিচ্ছিরি’, ‘লিস্টি’, ‘ভদ্দর’ প্রভৃতি। 
(ঙ) ধ্বন্যাত্মক, অনুকার শব্দের ও শব্দদ্বৈতের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। যেমন—ডিম-টিম, প্ল্যান-ট্যান, ধ্বস-ধ্বস, ভোঁস ভোঁস, ঝাল-ঝাল । 
(চ) ক্রিয়াপদের ব্যবহারেও বৈচিত্র্য লক্ষণীয়। প্রাদেশিক (ধ্বন্যাত্মক) রীতির ভাষাও বর্তমান। যেমন—খাওয়া অর্থে ‘সাবাড়-করা’ শব্দের প্রয়ােগ। লােভ দেওয়া অর্থে নজর দেওয়া প্রভৃতির প্রয়ােগ হাস্যরসের সৃষ্টি করেছে। 
(ছ) অর্থগত দিক থেকে শব্দের বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার, যেমন—খাবার নষ্ট হওয়া অর্থে বারােটা বাজা’, ‘একটা বাজা’ প্রভৃতি শব্দের ব্যবহার। 
(জ) এ ছাড়াও প্রবাদ প্রবচনের ব্যবহার, বাগ্ ধারার ব্যবহার লক্ষণীয়। 
(ঝ) অলংকারের প্রয়ােগবৈচিত্র্যও হাস্যরস সৃষ্টির সহায়ক হয়েছে। 
(ঞ) অর্ধ-তৎসম, তদ্ভব শব্দের প্রয়ােগবৈচিত্র্যও লক্ষণীয়। 
(ট) চরিত্রের সংলাপে ‘দ্রাক্ষাফল অতিশয় খাট্টা, ‘এক চড়ে গালের বােম্বা উড়িয়ে দেব’– প্রভৃতির মাধ্যমে হাস্যরস সৃষ্টি হয়েছে।
👉আরো দেখো….

Leave a Reply