শিকল-পরার গান কবিতার প্রশ্ন উত্তর | Sikol Porar Gaan Kobitar Question Answer Class 8 [WBBSE]

WhatsApp Channel Join Now
Telegram Group Join Now

 

                   শিকল-পরার গান
              কাজী নজরুল ইসলাম

কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) : বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি হিসাবে সমাদৃত। জন্ম বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে। পিতার নাম কাজী ফকির আহমেদ। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র বাংলায় আলোড়ন সৃষ্টি হয়। মানবতার কবি নজরুল ইংরেজের শোষণ, সামাজিক অসাম্য, ধর্মীয় ভন্ডামি এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তাঁর সাহিত্যকেই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। হিন্দু ও মুসলিম ঐতিহ্যের মেলবন্ধনে তিনি সদাসচেষ্ট। কবিতা এবং গদ্য ব্যতিরেকে নজরুল-প্রতিভা সার্থকতা লাভ করেছিল তাঁর গানে। তিনি শ্যামাসংগীত, গজল, দেশাত্মবোধক, ইসলামি প্রভৃতি নানা ধরনের গানেরও রচয়িতা। তাঁর লেখা বইগুলি হলো অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশি, সাম্যবাদী, সর্বহারা, ফণীমনসা, প্রলয়শিখা প্রভৃতি।

পাঠ্য কবিতাটি তাঁর বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।

উৎস: ‘শিকল-পরার গান’ কবিতাটি ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত কাজী নজরুল ইসলামের বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত।

সারমর্মঃ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত ‘শিকল-পরার গান’ শীর্ষক কবিতায় পরাধীনতার বন্ধনমোচনে তৎপর ভারতীয়দের দৃঢ় মনোভাব ফুটে উঠেছে। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ রাজশক্তির দমন-পীড়ন-নিগ্রহের কলঙ্ক মানুষের স্বাধীনতার প্রবল ইচ্ছাকে অবরুদ্ধ করতে পারেনি। ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদী আন্দোলনকে স্তিমিত ও স্তব্ধ করতে দেশজুড়ে ইংরেজরা কারাগারের অন্ধকারে বন্দি করেছে আন্দোলনকারীদের। তবু এই বিদ্রোহকে দমন করা যায়নি। নির্ভীক, একনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধারা কারাবরণের মধ্যে দিয়েই অহংকারী ব্রিটিশ রাজশক্তিকে বিদ্রুপ করেছেন, তাঁদের শিকল বাজিয়ে দেশমাতৃকার চরণবন্দনার সুর সৃষ্টি করেছেন। বন্ধনে ধরা দেওয়ার মধ্য দিয়েই তাঁরা বন্ধনমোচনের সংকল্প গ্রহণ করেছেন। বন্ধনেই তাঁদের বন্ধনের ভয় কেটেছে, মাভৈঃ মন্ত্রে তাঁরা দীক্ষিত হয়ে উঠেছেন। ভবিষ্যতের মানুষরা এই স্বাধীনতাযোদ্ধা বীরদের জীবনাদর্শের আলোয় মুক্তি সংগ্রামে ব্রতী হবেন এবং এভাবেই কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা আসবে—কাজী নজরুল ইসলাম এই কবিতায় এই আশায় প্রকাশ করেছেন।

নামকরণঃ কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার সাধারণ বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করেই শিকল পরার গান কবিতাটি লেখা । পাঁচটি স্তবকে বিন্যস্ত কবিতাটিতে প্রথম স্তবকে কবি বলেছেন যে, শিকল পরাটা শুধুমাত্র একটা ছলনা মাত্র । এই শিকল পড়ে অত্যাচারীদের বিকল করাই এর আসল উদ্দেশ্য। দ্বিতীয় স্তবকে তিনি বলেছেন যে বন্ধ কারাগারে বন্দি হতে নয় , অত্যাচারীদের ভিতর থেকে ক্ষয় করতেই এখানে আসা। বাঁধন দিয়ে যতই আবদ্ধ করা হবে, ততই বাঁধনের ভয় কমতে থাকবে । যে পায়ে আজ শিকল বাঁধা, সেই পা দিয়েই শিকল ভাঙা হবে। তৃতীয় স্তবকে কবি বলেছেন, ছোটো ছোটো কারাগারের মধ্যে মানুষকে বন্দি করে যারা বিশ্বকে গ্রাস করছে তারা ভাবছে যে তারা বিধাতাকেও ভয় দেখাতে পারবে। যারা ভয় দেখাচ্ছে তাদের বিতাড়নের জন্যে বিজয়মন্ত্র গাওয়া হবে। চতুর্থ স্তবকে কবি অত্যাচারীদের মূল অস্ত্র ভয়ের উপরেই আঘাত হানতে বলেছেন । শেষ স্তবকে এসে তিনি বলেছেন যে শিকলের শব্দের মধ্যে বন্দিদের কান্না নয়, মুক্তির অগ্রদূতের চরণ বন্দনা ধ্বনিত হচ্ছে । যারা লাঞ্ছিত হয়েছে তাঁরাই অত্যাচারকে লাঞ্ছিত করবে । দধীচির মতো আবার অস্থি দিয়ে বজ্র নির্মাণ করে অত্যাচারীকে আঘাত হানতে হবে। কবিতাটিতে কবি বিষয়বস্তুর সাথে কাব্যিক ছন্দ ও লয় এর মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। কবিতাটির রচনা কৌশল গানের কথার মতোই । আর কবিতার বিষয়বস্তুতে বারবার শৃঙ্খলের বন্ধন ধ্বনিত হয়েছে। তাই কবিতাটির নাম ‘শিকল পরার গান’ যথার্থ হয়েছে ।

       (হাতে কলমে’র প্রশ্ন ও উত্তর) 

১.১ কবি কাজী নজরুল ইসলাম কোথায় জন্মগ্রহণ করেন? 

উত্তরঃ কবি কাজী নজরুল ইসলাম বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

১.২ তিনি কী কী ধরনের গানের রচয়িতা ?

উত্তরঃ কাজী নজরুল ইসলাম রাগপ্রধান, ভক্তিগীতি, গজল, লোকগীতি, দেশাত্মবোধক, হাস্যকৌতুক প্রভৃতি নানা ধরনের গানের রচয়িতা।

২. নীচের প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর একটি বাক্যে লেখাে :

২.১ ‘শিকল-পরা ছল’ বলতে কবি প্রকৃতপক্ষে কী বােঝাতে চেয়েছেন ?

উত্তরঃ ‘শিকল-পরা ছল’ বলতে, কবি প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় স্বাধীনতাকামীদের স্বাধীনতা অর্জনে কারাবরণ করে শিকল পরার ভীতি দূর করাকে বােঝাতে চেয়েছেন। 

২.২ ‘ক্ষয় করতে আসা মােদের সবার বাঁধন-ভয়। —‘বাঁধন-ভয়’ ক্ষয় করতে কারা, কোথায় এসেছেন ? 

উত্তরঃ কবি-সহ তাঁর অনুগামী দেশভক্তরা ‘বাঁধন-ভয়’ ক্ষয় করতে ব্রিটিশের কারাগারে এসেছেন।

২.৩ ‘মুক্তি-পথের অগ্রদূতের চরণ-বন্দনা কীভাবে রচিত হয় ?

উত্তরঃ দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার জন্য ব্রিটিশদের হাতে আক্রান্ত হওয়া এবং মুক্তিকামী দেশভক্তদের পায়ে শিকল পরার মাধ্যমে তাঁদের চরণ-বন্দনা রচিত হয়।

২.৪ ‘মােদের অস্থি দিয়েই জ্বলবে দেশে আবার বজ্ৰানল।’ —পঙক্তিটিতে ‘আবার’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে কেন?

উত্তরঃ পুরাণ কাহিনি অনুসারে, দধীচি মুনির হাড় দিয়ে নির্মিত বজ্রে বৃত্রাসুরকে বধ করা হয়েছিল। বর্তমানে দেশভক্তদের হাড় দিয়ে পুনরায় নির্মিত বজ্রে ইংরেজ শক্তিকে নাশ করার প্রসঙ্গে ‘আবার’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।

৩.১ স্বাধীনতাকামী মানুষের মুক্তির বাসনা কীভাবে ‘শিকল-পরার গান’ কবিতায় ধরা পড়েছে, তা আলােচনা করাে।

উত্তরঃ কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিষের বাঁশি’ কাব্যের অন্তর্গত ‘শিকল-পরার গান’ কবিতায় সমগ্র স্বাধীনতাকামী ভারতবাসীর মুক্তির বাসনা তীব্রভাবে প্রকাশিত হয়েছে। কবি ভারতের মুক্তিপিয়াসী মানুষের মনে সাহস জোগানাের জন্য এবং মুক্তির বাসনাকে চরিতার্থ করার জন্য বলেছেন— শৃঙ্খলিত হয়ে তাঁদের কারাগারে প্রবেশ করা একটা ছলনা মাত্র। এই শিকল পরেই তাঁরা পরাধীনতার শৃঙ্খলকে চূর্ণ করবেন। এই কারাবরণের মাধ্যমে তারা মুক্তিপিয়াসী মানুষের মন থেকে কারাবরণের ভীতিকে দূরীভূত করতে চান। ব্রিটিশরা যে ভয় দেখিয়ে তাঁদের শাসনজাল বিস্তার করছে, সেই ভয়ের কণ্ঠ রােধ করেই সকলকে সাহসী করে তুলতে চান। আলােচ্য কবিতায় দেশকে ব্রিটিশদের কবল থেকে মুক্ত করতে সমস্ত কষ্ট স্বীকার করে নিজেদের জীবন বলিদানের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের মুখে হাসি ফোটানাের বার্তা ঘােষিত হয়েছে। কবি বলেছেন, দেশভক্তদের শরীরের হাড় দিয়ে পুনরায় বজ্র তৈরি হয়ে ব্রিটিশ শাসনের বিনাশ ঘটাতে দেশে বজ্রের আগুন জ্বলবে। এভাবেই স্বাধীনতাকামী মানুষের মুক্তির বাসনা কবিতাটিতে ধ্বনিত হয়েছে।

৩.২ ‘বাঁধন-ভয়কে করব মােরা জয়’—কেন এই বাঁধন ? কারা, কীভাবে এই ‘বাঁধন-ভয়কে জয় করবে ?

উত্তরঃ বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম রচিত ‘শিকল-পরার গান’ কবিতায় ‘বাঁধন’ হল পরাধীনতার বন্ধন। সাম্রাজ্যলোভী ব্রিটিশ শক্তির অত্যাচারে সমগ্র ভারতবর্ষ তথা ভারতের আপামর জনগণ পরাধীনতার বাঁধনে আবদ্ধ।

  » এই ‘বাঁধন-ভয়’-কে জয় করার জন্য এগিয়ে এসেছে বিপ্লবী, স্বদেশপ্রেমী স্বাধীনতাকামী মানুষ। স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীরা নিজেদের শিকলে আবদ্ধ করে শিকলকে ভাঙার কাজে সদাসচেষ্ট। নিজেদেরকে ইংরেজ শক্তির বন্ধনে আবদ্ধ করে তারা সাধারণ মানুষের মন থেকে বন্ধন-ভয়কে দূর করতে চায়। ভয়-ভীতি দ্বারা ইংরেজ শক্তি ভারতবাসীকে পরাধীনতার জালে আবদ্ধ করেছে। সেই ইংরেজ শক্তির সর্বনাশের জন্য বলহীনদের মধ্যে বিপ্লবী স্বাধীনতাকামী মানুষ ‘মাভৈঃ বিজয়মন্ত্র’ সঞ্চারিত করতে চাইছে। নিজেদের জীবন দেশের স্বার্থে উৎসর্গ করে এরা নিত্য ‘মুক্তি-পথের অগ্রদূতের’ উপাসনা করছে। অত্যাচারিত মানুষের মধ্যে নিভে যাওয়া শক্তিকে জাগ্রত করেই দেশের মানুষ ব্রিটিশদের বাঁধন-ভয়কে জয় করতে পারবে।

৪. দল বিশ্লেষণ করাে : বন্ধনী, ঝঞ্ঝনা , বজ্রানল , সর্বনাশ, অস্থি।

 » বন্ধনী = বন্- ধ – নী (রুদ্ধদল—বন্ (১ টি) মুক্তদল—ধ, নী (২ টি),।

» ঝঞ্ঝনা = ঝন্ – ঝ – না [ রুদ্ধদল-ঝন (১টি), মুক্তদল—ঝ, না (২ টি), ] ।

» বজ্ৰানল = বজ্ – রা – নল্ (মুক্তদল— রা (১টি), রুদ্ধদল—বজ্, নল্ (২ টি)।

» সর্বনাশ = সর্ – ব – নাশ্ (মুক্তদল— ব (১টি), রুদ্ধদল— সর, নাশ্ (২ টি)।

» অস্থি = অস্-থি (মুক্তদল-থি (১টি), রুদ্ধদল—অস্ (১টি)।

৫. ধ্বনি পরিবর্তনের কোন নিয়ম এখানে কাজ করেছে দেখাও : বাঁধন, পরে।

» বাঁধন = বন্ধন > বাঁধন (নাসিক্যীভবন)।

» পরে= পরিয়া > পইরা > পরে (অভিশ্রুতি)।

৬. বাক্যে রূপান্তর করাে :

৬.১ ভয়-দেখানাে ভূতের মােরা করব সর্বনাশ। (জটিল বাক্যে) 

উত্তরঃ তারা ভয় দেখানাে ভূত, তাদের আমরা সর্বনাশ করব। 

৬.২ মােরা ফাঁসি পরে আনব হাসি মৃত্যুজয়ের ফল। (যৌগিক বাক্যে) 

উত্তরঃ মােরা ফাঁসি পরব এবং মৃত্যুজয়ের ফল স্বরূপ হাসি আনব। 

৬.৩ তােদের বন্ধ কারায় আসা মােদের বন্দী হতে নয়। (চলিত গদ্যে) 

উত্তরঃ তােদের বন্ধ কারায় আমাদের বন্দি হতে আসিনি।

৭. পদ চিহ্নিত করাে : 

৭.১ তােমরা বন্ধ ঘরের বন্ধনীতে করছ বিশ্বগ্রাস। 

উত্তরঃ তােমরা— সর্বনাম, বন্ধ— বিশেষণ, ঘর— বিশেষ্য, বন্ধনী— বিশেষ্য, করছ— ক্রিয়া, বিশ্বগ্রাস— বিশেষ্য। 

৭.২ মােরা ফাঁসি পরে আনব হাসি মৃত্যুজয়ের ফল। 

উত্তরঃ মােরা— সর্বনাম, ফাঁসি— বিশেষ্য, পরে— ক্রিয়া, আনব— ক্রিয়া, হাসি— বিশেষ্য, মৃত্যুজয়— বিশেষ্য, ফল— বিশেষ্য। 

৭.৩ এবার আনব মাভৈঃ-বিজয়-মন্ত্র বলহীনের বল। 

উত্তরঃ এবার— অব্যয়, আনব— ক্রিয়া, মাভৈঃ— বিশেষণ, বিজয়মন্ত্র— বিশেষ্য, বলহীন— বিশেষণ, বল— বিশেষ্য।

৮. ব্যাসবাক্য-সহ সমাসের নাম লেখাে :

» শিকল-ঝঞ্জনা = শিকলের ঝঞ্চনা–সম্বন্ধ তৎপুরুষ সমাস।  

» চরণ বন্দনা = চরণকে বন্দনা— কর্ম-তৎপুরুষ সমাস; চরণের বন্দনা— সম্বন্ধ তৎপুরুষ সমাস। 

» বজ্ৰানল = বজের অনল— সম্বন্ধ তৎপুরুষ সমাস; ব্রজ রূপ অনল— রূপক কর্মধারয় সমাস।

» মৃত্যুজয় = মৃত্যুকে জয় — কর্ম তৎপুরুষ সমাস ; মৃত্যু হতে জয় — অপাদান তৎপুরু সমাস।

Leave a Reply