ছুটি গল্পের প্রশ্ন উত্তর একাদশ শ্রেণি বাংলা দ্বিতীয় সেমিস্টার | Chuti Golper Question Answer Class 11 Bengali Second Semester wbbse
1. একাদশ শ্রেণির বাংলা সমস্ত অধ্যায়ের প্রশ্নোত্তর Click Here
2. একাদশ শ্রেণির সমস্ত বিষয়ের প্রশ্নপত্র প্রশ্ন Click Here
রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর : ছুটি গল্প একাদশ শ্রেণি বাংলা দ্বিতীয় সেমিস্টার | Chuti Golper Essay Type Question Answer Class 11 Bengali Second Semester wbbse
অনধিক ১৫০ শব্দের মধ্যে উত্তর দাও : প্রতিটি প্রশ্নের মান- ৫
১. ‘ছুটি’ গল্প অবলম্বনে ফটিক চরিত্র বর্ণনা করো। ৫
উত্তরঃ ‘ছুটি’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ফটিক। সমগ্র গল্পজুড়ে তার অবস্থান। গল্পটির সূচনা ও সমাপ্তি ফটিককে নিয়েই। গল্পে তার যে চরিত্রবৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে তা নিম্নে আলোচিত হল—
ডানপিটে স্বভাব ও নেতা সুলভ মানসিকতাঃ গল্পের শুরুতেই তেরো-চৌদ্দ বছরের ফটিককের নেতৃত্বে নদীর ধারে শাল গাছের গুঁড়ি মাস্তুলে পরিণত করার পরিকল্পনা, মাখনলাল সেই গুঁড়ির উপর চেপে বসলে তাকে গড়িয়ে দেওয়া, মাখনলালের মায়ের কাছে নালিশ, তারপর মা ডাকলেও ‘যাব না’ বলা, মায়ের চড় খেলে তাকে ঠেলে দেওয়া, আবার চক্রবর্তী বাবুদের বাড়ি কোথায় জানতে চাইলে ‘জানি নে’ বলা– এগুলো ফটিকের ডানপিটে স্বভাব ও নেতৃত্ব দেওয়ার মানসিকতার প্রমাণ।
জন্মভূমির প্রতি টানঃ মামা’র বাড়ি গেলেও বন্ধনমুক্ত পরিবেশে অভ্যস্ত ফটিক কলকাতায় যাওয়ার পর গ্রামে খেলার সাথী ও নদীর ধারের মাঠের কথা বারবার মনে করতে থাকে। এতে তার জন্মভূমির প্রতি টান স্পষ্ট হয়।
মমত্ববোধঃ মা ও ভাই মাখনলালের প্রতি ফটিকের মমত্ববোধ ছিল। তাই কলকাতা যাওয়ার সময় নিজের খেলার সামগ্রী ভাই মাখনকে দিয়েছিল। আবার অসুস্থ অবস্থায় অত্যাচারিণী মাকেই সে বারবার কাছে পেতে চেয়েছিল। মায়ের জন্য ফটিকের মন বারবার বেদনাময় হয়েছিল।
আত্মসম্মানবোধঃ লেখাপড়ায় অমনোযোগী ফটিক স্কুলে ও মামার বাড়িতে বারবার অপমানিত ও তিরস্কৃত হয়েছে। মামীর কটু কথা তার আত্মসম্মানবোধে আঘাত করেছে, ফলে সে গ্রামে মায়ের কাছে ফিরে যেতে চেয়েছে।
পরিশেষে বলা যায়, ফটিকের মধ্যে কিশোর বয়সের চপলতা, নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা, মা ও ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসা, জন্মভূমির প্রতি টান এবং আত্মসম্মানের সমন্বয়ে এক জীবন্ত কিশোর চরিত্র ধরা দিয়েছে।
২. ‘ছুটি’ গল্পে মামাবাড়িতে গিয়ে ফটিকের যে দুরাবস্থা হয়েছিল তা নিজের ভাষায় লেখো। ৫
উত্তরঃ ‘ছুটি’ গল্পে মায়ের অবাধ্য উচ্ছৃঙ্খল লেখাপড়ায় অমনোযোগী তেরো বছরের এক কিশোর হল ফটিক। মামা বিশ্বম্ভরবাবু ফটিকের দুরন্তপনা এবং দারিদ্রতার কথা ভেবে ফটিককে কলকাতায় নিয়ে যেতে ইচ্ছা প্রকাশ করলে অত্যন্ত আগ্রহের সাথে ফটিক রাজি হয়। এরপর খেলার সাথী, মা ভাই ও প্রাণপ্রিয় গ্রামকে বিদায় জানিয়ে ফটিক পৌঁছে যায় শহর কলকাতায় মামার বাড়ি।
মামার বাড়ি পৌঁছাতেই মামীর সঙ্গে আলাপে ফটিকের উৎসাহে ভাটা পড়তে শুরু করে। মামী তাঁর তিন সন্তানের পরিবারে অনাবশ্যক পরিবার বৃদ্ধি বলে মনে করে অসন্তুষ্ট হন। মামীর স্নেহ মমতাহীন চোখ দুটি ফটিকের কাছে একটা ‘দুর্গ্রহের মতো’ মনে হতে থাকে। তাই মামীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফটিক প্রয়োজনের বেশি কাজ করেও মামীকে খুশি করতে পারেনি। লেখাপড়ায় মনোযোগী হতে বললে মামীর কথাগুলিও তাঁর কাছে নিষ্ঠুর অবিচার বলে মনে হতে থাকে। স্কুলের মাস্টারমশাইয়ের মারধোর, ছেলেদের কটূক্তি, বই হারিয়ে গেলে মামীর তিরস্কার তাঁকে আরো স্কুল বিমুখ করে। এইভাবে প্রতিদিনের জীবনে মামীর অবহেলা এবং উপেক্ষায় ফটিকের কাছে মামার বাড়ি নরক বলে মনে হতে থাকে। ফলে প্রতিদিন ফটিকের মনে মায়ের স্নেহের অভাব বোধ হতে থাকে। সেই সবুজ ছায়াঘেরা গ্রাম, নদীর ধার, মুক্ত মাঠ এবং খেলার সাথীদের হাতছানি ফটিককে শহর কলকাতা থেকে পালাতে বাধ্য করে। কিন্তু অবিশ্রান্ত বৃষ্টিধারার মধ্যে পুলিশ জলে ভেজা ফটিককে তাঁর মামার বাড়িতে পৌঁছে দেয়। প্রচণ্ড জ্বরে প্রলাপ বকতে থাকা ফটিকের জীবন প্রদীপ চিরদিনের জন্য নিভে যায়।
৩। “উৎসাহে তাহার রাতে নিদ্রা হয় না।”– কার উৎসাহ ? উৎসাহের কারণ কী ? ১+৪
উত্তরঃ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা উল্লেখযোগ্য ছোটোগল্প ‘ছুটি’ থেকে গৃহীত আলোচ্য অংশটিতে গল্পের প্রধান চরিত্র ফটিকের উৎসাহের কথা বলা হয়েছে।
বিশ্বম্ভরবাবু, তার বোনের দুর্ভাগ্যের কথা শুনে, দীর্ঘদিন বাদে তাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। বোন এবং বোনের সন্তানদের প্রতি স্বাভাবিক মায়া-মমতাবশত তিনি সেখানে কিছুদিন থেকেছিলেন। বাড়িতে থাকাকালীন ভাগ্নেদের পড়াশোনা ও অন্যান্য বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, মাখন পড়াশোনায় ভালো হলেও ফটিক অবাধ্য, পড়াশোনায় তার একেবারে মন নেই। পড়াশোনায় উদাসীন ফটিক তার সমবয়সি ছেলেদের দলের নেতা। দস্যি ছেলে ফটিকের চিন্তায় ফটিকের মায়ের মনে কোনো শান্তি ছিল না। তাই ফটিকের পড়াশোনা ও চঞ্চলতাকে কমানোর জন্য বিশ্বম্ভরবাবু ফটিককে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। কিশোর মনের স্বাভাবিক কৌতূহলবশত ফটিক কলকাতায় যাওয়ার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে উঠেছিল। ফটিকের মন সেই সময় মায়ের স্নেহাঞ্চল, প্রকৃতির উদারতা থেকে কলকাতায় চলে যেতে একবারও ব্যথিত হয়নি। উপরন্তু বয়ঃসন্ধিকালীন অতিরিক্ত আগ্রহে কলকাতায় যাওয়ার চিন্তা তার কিশোর মনকে আচ্ছন্ন করেছিল। গ্রামের সংকীর্ণ গণ্ডি অতিক্রম করে কলকাতা শহর দেখার অতিশয় আগ্রহে সে রাতে ঘুমাতে পর্যন্ত পারেনি।
৪। “বিধবা এ প্রস্তাবে সহজেই সম্মত হইলেন।”- প্রস্তাবটি কী ছিল ? বিধবা এ প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছিলেন কেন ? ২+৩
উত্তরঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ছুটির গল্প অনুসারে। দীর্ঘদিন পশ্চিমে কাটানোর পর বিশ্বম্ভরবাবু বোনের বিপর্যয়ের কথা শুনে তাদেরকে দেখতে আসেন। বোন এবং বোনের সন্তানদের প্রতি তার দয়ামায়া মমতাবোধ আছে। তিনি গ্রামের বাড়িতে বোনের কাছে এসে জানতে পারেন, স্বামীর অবর্তমানে দুই সন্তানকে নিয়ে তার বোন বিব্রত। বিশেষ করে ফটিক দুরন্ত, অবাধ্য এবং পড়াশোনায় একেবারে অমনোযোগী। বোনের সামান্য সাহায্যের জন্য এবং ফটিকের ভালো ভবিষ্যতের জন্য তিনি ফটিককে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। সহায়সম্বলহীনা বিধবা ফটিকের মা ফটিকের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভেবে দাদা বিশ্বম্ভরবাবুর এই প্রস্তাবে সম্মতি দেন।
নিম্ন-মধ্যবিত্ত সংসারের ব্রাহ্মণ বিধবা ফটিকের মা তার দুই সন্তান ফটিক ও মাখনকে নিয়ে খুবই বিব্রত ছিলেন। দুই ভাই চরিত্রগতভাবে আলাদা, তাই তাদের মধ্যে কোনো সদ্ভাব ছিল না। উপরন্তু তাদের প্রতিনিয়ত ঝগড়া মারামারি লেগেই থাকত। মাখন পড়াশোনায় মনোযোগী, তাই মা সবসময় তার পক্ষ নিতেন। অন্যদিকে ফটিক দুরন্ত এবং পড়াশোনার প্রতি একেবারে উদাসীন ও অমনোযোগী। তাই দাদা বিশ্বম্ভরবাবু ফটিককে কলকাতায় নিয়ে যেতে চাইলে তিনি রাজি হন। ফটিকের লেখাপড়ার জন্য – এবং মূলত তার চঞ্চলতাকে কমাতে তার সুন্দর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভেবে ফটিকের মা, দাদা বিশ্বম্ভরবাবুর সঙ্গে ফটিককে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাবে সম্মতি দেন। তা ছাড়া ফটিকেরও আগ্রহ ছিল এবং দাদা – বিশ্বম্ভরবাবুর সদাশয়তা সম্বন্ধে তাঁর কোনো সন্দেহ ছিল না। কিন্তু ভাইকে চিনলেও ভ্রাতৃবধূকে তিনি ঠিকমতো চেনেননি। চিনলে তার সন্তানের অকালে ঝরে যাওয়ার পথকে তিনি সহজ করতেন না, ফটিককে তিনি কখনোই কলকাতায় পাঠাতেন না।
৫। “এই অনাবশ্যক পরিবার বৃদ্ধিতে মনে মনে যে বিশেষ সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন তাহা বলিতে পারিনা।”- ‘অনাবশ্যক পরিবারবৃদ্ধি’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে ? উদ্দিষ্ট ব্যক্তির সন্তুষ্ট না হওয়ার কারণ কী ? ২+৩
উত্তরঃ মানবদরদি ও মানবতাবাদী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা সাধনাপর্বের উল্লেখযোগ্য ‘ছুটি’ গল্পের অন্তর্গত। কলকাতায় বসবাসকারী বিশ্বম্ভরবাবুর পরিবারে স্ত্রী-সহ তিন সন্তান ছিল। ফটিকের মামি তার তিন সন্তান নিয়ে সুখেই ছিলেন। কিন্তু ভাগ্যবিপর্যস্ত বিধবা বোনকে দেখতে গিয়ে ফটিককে সঙ্গে করে আনেন বিশ্বম্ভরবাবু। পরিবারে ফটিক আসাতে স্বাভাবিকভাবেই পরিবার বৃদ্ধি পায়। ফটিককে কলকাতায় না আনলেই ভালো হত এই মানসিকতার বশবর্তী হয়ে অত্যন্ত বিরক্ত হৃদয়হীন মামির ফটিককে আনা অনাবশ্যক পরিবারবৃদ্ধি বলে মনে করেছেন।
বিশ্বম্ভরবাবুর নিজের তিন সন্তান থাকা সত্ত্বেও মায়ার বশে তিনি ফটিককে কলকাতায় নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন। ফটিককে পড়াশোনায় মনোযোগী করতে, তার চঞ্চলতাকে দূর করতে বিশ্বম্ভরবাবুর এই পদক্ষেপকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাতে হয়। কিন্তু নিজের স্ত্রী-সন্তান থাকা সত্ত্বেও এতটা হৃদয়হীন, অমানবিক, স্নেহশূন্য হবেন তা বোধ করি কল্পনা করতে তিনি পারেননি। তাই কলকাতায় ফটিক আসার পর প্রথম থেকেই ফটিক মামির চোখের বালিতে পরিণত হয়। ফটিকের মতো তেরো চোদ্দো বছরের গ্রাম্য অপরিচিত, অশিক্ষিত কিশোর তার সাজানো সংসারে কিরকম অশান্তির কারণ হতে পারে, তা কল্পনা করেই তিনি খুব অসন্তুষ্ট ও বিরক্ত হয়েছিলেন। চরিত্রগত ভাবে তিনি নিষ্ঠুর, স্নেহহীনা, অমানবিক ছিলেন বলেই ফটিকের মতো সরল সন্তানসম ছেলেকে তিনি ভালোবাসতে পারেননি।
৬। “তেরো-চৌদ্দ বৎসরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই।”- এ কথা কোন্ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে ? ‘বালাই’ শব্দের অর্থ কী ? তেরো-চোদ্দো বৎসরের ছেলেকে বালাই বলা হয়েছে কেন ? ১+১+৩
উত্তরঃ ‘ছুটি’ গল্পে মামা বিশ্বম্ভরবাবু যখন ফটিককে তাদের কলকাতার বাড়িতে নিয়ে এলেন এবং ফটিকের মামি এই অনাবশ্যক পরিবারবৃদ্ধিতে বিরক্ত হলেন, তখন স্বয়ং লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই মন্তব্যটি করেছেন।
‘বালাই’ শব্দের অর্থ বালকের অহিত। এখানে অমঙ্গল বা উৎপাত বা বিপদ অর্থে শব্দটিকে ব্যবহার করা হয়েছে।
ফটিক যখন মামার সঙ্গে কলকাতায় আসে তখন তার বয়স তেরো-চোদ্দো বছর। এই তেরো-চোদ্দো বছর বয়স ছেলেমেয়েদের বয়ঃসন্ধির সময়। মূলত শিশু-কিশোরদের বয়ঃসন্ধিকালীন শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনজনিত কারণে নানারকম আবেগ, অনুভূতি, কৌতূহল, দেখা যায়। ফটিক চরিত্রের মধ্যে দিয়ে লেখক এই বয়সের স্বভাববৈশিষ্ট্য তুলে ধরে তাকে বালাই বলেছেন। কেন-না নানারকম শারীরিক পরিবর্তন ঘটে বলে শৈশবের লালিত্য চলে যায়। কণ্ঠস্বরের মিষ্টতা ম্লান হয়ে আসে। এই বয়সের আধো আধো কথা ন্যাকামো মনে হয় আবার পাকাপাকা কথা জ্যাঠামো মনে হয়। তা ছাড়া নানারকম কৌতূহল জন্ম নেয় এই বয়সে। অথচ বড়োদের মধ্যে যোগ দেওয়া যায় না আবার ছোটোদের সঙ্গেও খেলতে বেমানান লাগে। আমাদের সমাজব্যবস্থায় এই বয়সন্ধিকালীন আচরণকে ঔদ্ধত্য হিসেবে দেখা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আধুনিক মনস্তাত্ত্বিকতার পরিচয় দিয়ে ফটিক চরিত্রের বয়ঃসন্ধিকালীন আচরণের ব্যাখ্যা করেছেন এবং সহানুভূতিশীল হয়েছেন।
৭। “তাহার চেহারা এবং ভাবখানা অনেকটা প্রভুহীন পথের কুকুরের মতো হইয়া যায়।”- ‘তাহার’ বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে ? তাকে প্রভুহীন কুকুর বলার কারণ কী ? ১+৪
উত্তরঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা উল্লেখযোগ্য ছোটোগল্প ‘ছুটি’ থেকে গৃহীত আলোচ্য অংশে ‘তাহার’ বলতে ফটিককে বোঝানো হয়েছে।
আধুনিকতম লেখক রবীন্দ্রনাথ তাঁর আধুনিক মনস্তাত্ত্বিক ভাবনাচিন্তা দ্বারা চালিত হয়ে ‘ছুটি’ গল্পের প্রধান চরিত্র ফটিকের মধ্যে বয়ঃসন্ধিকালীন কিশোরের বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তুলেছেন। শৈশব ও যৌবনের বয়স ধর্মকালীন আচরণের সঙ্গে আমরা পরিচিত হলেও বয়ঃসন্ধিকালীন পরিবর্তিত আচরণকে আমরা ঔদ্ধত্য মনে করি। ফটিকের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। তেরো-চোদ্দো বয়সে বয়ঃসন্ধিকালে দাঁড়িয়ে ফটিক মায়ের স্নেহাঞ্চল ছেড়ে চলে এসেছিল কলকাতার স্নেহহীন স্থানে। যেখানে একমাত্র মামা ছাড়া সবাই তাকে দুর্গ্রহ মনে করত। কোথাও স্নেহ, মায়া, মমতার আশ্রয় ছিল না। এই বয়সের কোনো শোভা নেই, কোনো কাজে লাগে না। তার দেহ কাপড়চোপড়ের পরিমাণ রক্ষা না করে হঠাৎ বেমানানরূপে বেড়ে ওঠে। শৈশবের লালিত্য এবং কণ্ঠস্বরের মিষ্টতা হঠাৎ চলে যায়। লোকে সেইজন্য তাকে মনে মনে অপরাধী করে। এই বয়সের স্বাভাবিক অনিবার্য ত্রুটিও অসহ্য বলে মনে হয়। তা ছাড়া ছেলেমেয়েরাও নিজেদেরকে অন্যের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে না। সে স্নেহ পেতে চায় কিন্তু কেউ সাহস করে স্নেহ দিতে পারে না। কারণ তাকে প্রশ্রয় বলে মনে হয়। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, তার চেহারা এবং ভাবখানা অনেকটা প্রভুহীন পথের কুকুরের মতো হয়ে যায়। এই সময়ে সবচেয়ে বড়ো আশ্রয়স্থল হল মা। কিন্তু ফটিকের দুর্ভাগ্য যে এই সময়েই মায়ের ভালোবাসা, স্নেহ থেকে সে বহুদূরে অমানবিক পরিবেশে থেকেছে। যার অনিবার্য ফলস্বরূপ ডেকে এনেছে তার অকাল মৃত্যু।
৮। “এমন অবস্থায় মাতৃভবন ছাড়া আর কোনো অপরিচিত স্থান বালকের পক্ষে নরক।”- প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ব্যাখ্যা লেখো। ৫
উত্তরঃ ছোটোগল্পগুলির মধ্যে ‘ছুটি’ গল্পটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। রবীন্দ্রসাহিত্যে যত উল্লেখযোগ্য বালক চরিত্র আছে ফটিক তাদের মধ্যে অবিস্মরণীয় চরিত্র। আলোচ্য অংশে যে বালকের কথা বলা হয়েছে, সে হল ফটিক। বয়ঃসন্ধির অস্বস্তিকর বিড়ম্বনার মনস্তত্ত্বসম্মত চিত্র অত্যন্ত সুন্দর করে রবীন্দ্রনাথ এঁকেছেন ফটিকের জীবনে ।
তেরো-চোদ্দো বছর বয়সের বয়ঃসন্ধিকালে দাঁড়িয়ে থাকা ফটিক মাকে ছেড়ে এসেছিল মামার বাড়ি কলকাতায়। এই বয়সের কোনো শোভা নেই, কোনো কাজেও লাগে না। কাপড়চোপড়ের পরিমাণ রক্ষা না করে তার শরীর হঠাৎ বেমানানরূপে বেড়ে যায়। শরীরে আসা নানা পরিবর্তন। মনে দেখা দেয় নানা কৌতূহল। গলার স্বরের মিষ্টতা চলে যায়। লোকে তাকে অপরাধী মনে করে। এই বয়সের স্বাভাবিক-অনিবার্য ত্রুটিও অসহ্য বলে মনে হয়। পৃথিবীর কোথাও নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারে না। তাই নিজেদেরকে প্রতিনিয়ত অপরাধী, লজ্জিত বলে মনে করে। এই বয়সের ছেলেমেয়েরা স্নেহের কাঙাল থাকে, সামান্য ভালোবাসা স্নেহ পেলে আত্মবিক্রিও করে দেয়। কিন্তু কোথাও স্নেহ-ভালোবাসা না পেলে প্রভুহীন কুকুরের মতো হয়ে থাকে। এইসময় একমাত্র আশ্রয়স্থল শান্তির নীড় হল মা ও মায়ের স্নেহাঞ্চল। মায়ের স্নেহই সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বোত্তম এবং সৌভাগ্যের প্রতীক। বঞ্চিত হতভাগ্য সন্তানেরও একমাত্র নিরাপদ আশ্রয় মা। সেই আশ্রয়চ্যুত ফটিক স্নেহশূন্য, মায়া মমতাহীন, ভালোবাসাহীন পরিবেশে থেকেছে; যা নরক বেদনার সমতুল্য।
৯। “এমন অবস্থায় মাতৃভবন ছাড়া আর-কোনো অপরিচিত স্থান বালকের পক্ষে নরক।”- কোন্ প্রসঙ্গে এ কথা বলা হয়েছে ? তা ‘নরকতুল্য’ কেন ? ২+৩
উত্তরঃ আলোচ্য অংশটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উল্লেখযোগ্য গল্প ‘ছুটি’-এর প্রধান চরিত্র
ফটিক তার নিজের মায়ের কাছ থেকে বিশ্বম্ভরবাবুর সঙ্গে কলকাতায় মামার বাড়ি চলে আসা প্রসঙ্গে এ কথা বলা হয়েছে। দুরন্ত অবাধ্য ছেলেকে দাদার কাছে রেখে সহায়-সম্বলহীন ফটিকের মা শান্তি পেতে চেয়েছিল। ভেবেছিল ছেলেটা মানুষ হয়ে আসবে। দাদা বিশ্বম্ভরবাবু তার অভিভাবকত্ব নেওয়ায় তিনি আশ্বস্ত হয়েছিলেন।
খুব সূক্ষ্মভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ফটিকের মধ্য দিয়ে বয়ঃসন্ধিকালের ছেলেদের বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তুলেছেন। অসাধারণ মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করেছেন তিনি এই সময়ের বয়সধর্মের। এই বয়সের ছেলেদের কোনো শোভা থাকে না। শরীর হঠাৎ বেমানানভাবে বেড়ে ওঠে। কণ্ঠস্বরের মিষ্টতা চলে যায়, হয়ে ওঠে কর্কশ। তার আধো আধো কথা ন্যাকামি এবং পাকা পাকা কথা জ্যাঠামি বলে মনে হয়। এইসময় কেউ তাকে স্নেহ ও ভালোবাসা দিতে চায় না। এই বয়সের ছেলেমেয়েরা নিজেকে সবার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে না। সবসময় নিজেকে অপরাধী মনে করে এবং অন্যের সামান্য স্নেহশূন্য ব্যবহার তাকে কাঁটার মতো বিদ্ধ করে। এইসময় নারীমাত্রই স্বর্গের দুর্লভ জীব বলে মনে হয়। কিন্তু সেই নারীর কাছ থেকে অনাদর-অবহেলা ও অপমান পেলে তা হয়ে উঠতে পারে হৃদয়বিদারক। ফটিকের বয়ঃসন্ধিকালের পর্বে মামির নিষ্ঠুর ও অমানবিক স্নেহশূন্য ব্যবহার ফটিককেও ব্যথিত করত। এই সময় মায়ের আশ্রয়ই শিশুর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়। অন্য কোনো স্থান তার কাছে নরকতুল্য, বেদনাদায়ক। কারণ সেখানে স্নেহ, ভালোবাসা, সহানুভূতি কোনো কিছুই থাকে না।
১০। “মামীর স্নেহহীন চক্ষে সে যে একটা দুর্গ্রহের মতো প্রতিভাত হইতেছে,”- ‘সে’ বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে ? ‘দুগ্রহের মতো’ বলার কারণ কী ? ১+৪
উত্তরঃ রবীন্দ্রনাথের উল্লেখযোগ্য ছোটোগল্প ‘ছুটি’ থেকে আলোচ্য অংশটি নেওয়া হয়েছে। এখানে ‘সে’ বলতে ফটিককে বোঝানো হয়েছে।
পড়াশোনায় অমনোযোগী ফটিকের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভেবে বিশ্বম্ভরবাবু ফটিককে কলকাতায় নিয়ে আসেন। কিন্তু কলকাতায় নিজের সংসারে স্ত্রী-সহ আরও তিন সন্তান কেউই এই সিদ্ধান্তে খুশি হননি। বিশ্বম্ভরবাবুর স্ত্রী অর্থাৎ ফটিকের মামি ফটিককে দেখামাত্রই বিরক্ত হয়েছিলেন। তার সাজানো সংসারে ফটিকের মতো অবাধ্য, দুরন্ত, গ্রাম্য, অপরিচিত বালক কী ধরনের উচ্ছৃঙ্খল কারণ হতে পারে, তাই ভেবেই তিনি অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। সর্বোপরি ফটিক তেরো-চোদ্দো বছরের এক কিশোর। এই বয়ঃসন্ধিকালের কিশোর বালক ফটিককে আনার সিদ্ধান্তকে তিনি বিশ্বম্ভরবাবুর কাণ্ডজ্ঞানহীনতার কাজও বলেছেন। বয়ঃসন্ধিকালে স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন আসে। দেহের বৃদ্ধি, কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন- এইসব এই বয়সের ধর্ম। শৈশবের লালিত্য হারিয়ে যায়। শৈশব ও যৌবনের মাঝখানে দিশেহারা বালকের কোনো শোভা থাকে না। পৃথিবীতে কোথাও কারও সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে না। স্নেহ পেতে চায়, ভালোবাসা দিতে চায় কিন্তু কেউ তাকে স্নেহ-ভালোবাসা দিতে চায় না। নারীজাতি তাদের কাছে স্বর্গের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। কিন্তু সেই নারীজাতির কাছ থেকে অনাদর, স্নেহহীনতা সহ্যাতীত। এই বয়সের একমাত্র আশ্রয়স্থল হল মা। কিন্তু ফটিকের মামি এমন এক হৃদয়হীন নিষ্ঠুর নারী যে, কখনও ফটিকের মা হয়ে উঠতে পারেনি। উপরন্তু ফটিককে সবসময় দুর্গ্রহের মতো দেখেছে এবং তার সঙ্গে অতি অমানবিক আচরণ করেছে।
১১। “দেয়ালের মধ্যে আটকা পড়িয়া কেবলই তাহার সেই গ্রামের কথা মনে পড়িত।”- ‘তাহার’ বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে ? তার গ্রামের কোন্ কথা, কেন মনে পড়ত ? ১+৪
উত্তরঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ছোটোগল্প ‘ছুটি’ থেকে গৃহীত আলোচ্য অংশে ‘তাঁহার’ বলতে ফটিককে বোঝানো হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ ‘ছুটি’ গল্পে প্রকৃতির সঙ্গে মানবমনের নিগূঢ় সম্পর্কের চিত্র এঁকেছেন ফটিক চরিত্রের মধ্য দিয়ে। গ্রামবাংলার উদার আকাশের নীচে পথে-প্রান্তরে, নদীর ঘাটে ছুটির আনন্দে সঙ্গীদের নিয়ে সারাদিন ছুটোছুটি করে বেড়ানোই ছিল ফটিকের একমাত্র কাজ। প্রকাণ্ড একটা ধাউস ঘুড়ি নিয়ে বোঁ-বোঁ করে মাঠে দৌঁড়ে বেড়ানো, ‘তাইরে নাইরে নাইরে না’ করে গাওয়া, দিনের মধ্যে যখন-তখন ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কাটা-সেইসব গ্রামবাংলার দস্যি ছেলের দলবল, সর্বোপরি মায়ের কথা ফটিকের মনে পড়ত।
নিয়ম মাফিক পড়াশোনা বা কোনো সাংসারিক কাজে তার কোনোদিনই মন ছিল না। ফটিক ছিল বনের পাখির মতোই স্বাধীন, মুক্ত, স্বচ্ছন্দ; অনন্ত-উদার নীল আকাশে আপন মনে ঘুরে বেড়ানোর মধ্যেই ছিল তার প্রাণের আনন্দ, মনের মুক্তি। কিন্তু সেই মুক্তপ্রাণা ফটিককে পড়াশোনার অমনোযাগিতার কারণে কলকাতায় এনে চার দেয়ালে বন্দি করা হয়। বন্দিদশায় মামির নিষ্ঠুর স্নেহহীন আচরণ, স্কুলের মাস্টারমশাইয়ের অমানবিক প্রহার, মামাতো ভাইদের অবহেলা-তাচ্ছিল্য তাকে বারবার নিজের গ্রামের কথা, মায়ের কথা মনে করিয়ে দিত।
১২। “সেই লজ্জিত শঙ্কিত শীর্ণ দীর্ঘ অসুন্দর বালকের অন্তরে কেবলই আলোড়িত হইত।”- এই বালক কে ? তার অন্তরে কী আলোড়িত হওয়ার কথা বলা হয়েছে ? ১+৪
উত্তরঃ এই লজ্জিত, শঙ্কিত, শীর্ণ, দীর্ঘ, অসুন্দর বালক বলতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটোগল্প ‘ছুটি’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ফটিককে বোঝানো হয়েছে।
প্রকৃতির স্নেহের দুলাল ফটিককে প্রকৃতি মায়ের স্নেহাঞ্চল ছিন্ন করে কলকাতায় মামার বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। উদার-মুক্ত শ্যামল অরণ্য থেকে তাকে লোহার খাঁচায় বন্দি করা হয়। সেই স্নেহহীন নিষ্প্রাণ বন্দিজীবনের মধ্যে ক্লান্ত ফটিক গ্রামের জীবনে প্রকৃতি মায়ের কোলে ফিরে আসার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠত। তার মনে পড়ত প্রকাণ্ড ঢাউস ঘুড়ি নিয়ে বোঁ বোঁ শব্দে উড়ে বেড়ানোর সেই মাঠ, ‘তাইরে নাইরে নাইরে না’ করে উচ্চস্বরে স্বরচিত গান গেয়ে অকর্মণ্যভাবে ঘুরে বেড়ানোর সেই নদীতীর, দিনের মধ্যে যখন-তখন ঝাঁপ দিয়ে পড়ে সাঁতার কাটাবার সেই নদী আর খেলার সঙ্গী, স্বাধীনতা সর্বোপরি সেই অত্যাচারিণী, অবিচারিণী মা।
এইসবই রাতদিন তার অসহায় মনকে আকর্ষণ করত। বয়ঃসন্ধিকালের কিশোর ফটিক নিজের মধ্যে অনুভব করত জন্তুর মতো এক অবুঝ ভালোবাসা। প্রকৃতি মায়ের কাছে, সর্বোপরি নিজের মায়ের কাছে ফিরে যাওয়ার অব্যক্ত ইচ্ছা এবং সেই ইচ্ছাই বেদনা হয়ে ফটিকের অন্তরের ‘মা মা’ কান্নার রোল তুলত। এইসব ভাবনাই ফটিকের মনকে আলোড়িত করত।
১৩। ‘ছুটি’ গল্পে বিশ্বম্ভরবাবুর চরিত্র আলোচনা করো।
উত্তরঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘ছুটি’ গল্পে অপ্রধান চরিত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম হল বিশ্বম্ভরবাবু অর্থাৎ ফটিকের একমাত্র মামা। অপ্রধান চরিত্রের প্রধান কাজ হল কাহিনিকে তার অনিবার্য পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে সাহায্য করা। সেইদিক থেকে বিচার করলে বিশ্বম্ভরবাবুর সিদ্ধান্তের জন্যই এই গল্পের কাহিনি করুণ পরিণতি পেয়েছে। এই চরিত্রটির প্রয়োজনীয়তা ও প্রাসঙ্গিকতা প্রশ্নাতীত।
দীর্ঘদিন পশ্চিমে কাটিয়ে দেশে ফিরে তিনি তার একমাত্র বোনের ভাগ্যবিপর্যয়ের খবর পেয়ে তাদেরকে দেখতে গ্রামে আসেন। বিশ্বম্ভরবাবু একজন দায়িত্ববান ব্যক্তি তাই তিনি দাদা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বোন ও বোনের সন্তানের প্রতি তার স্নেহ ছিল অকৃত্রিম। ফটিকের চঞ্চলতার কথা শুনে, তার পড়াশোনায় অমনোযোগিতার কথা শুনে, সর্বোপরি তাকে নিয়ে ফটিকের মায়ের দুশ্চিন্তার কথা ভেবে দায়িত্ববান মামার মতো পিতৃহারা ফটিকের সকল দায়িত্ব পরম মমতায় গ্রহণ করেছেন।
দায়িত্ববান, স্নেহ-মমতাযুক্ত নিপাট ভালোমানুষ হলেও বিশ্বম্ভরবাবুর কোনো ব্যক্তিত্ব ছিল না। তাই কলকাতায় পৌঁছেই তিনি তার স্ত্রীর সামনে একেবারে ব্যক্তিত্বহীন কাপুরুষ চরিত্রে পরিণত হয়েছেন। কলকাতায় থাকাকালীন ফটিকের প্রতি অবহেলা-অনাদরের কোনো প্রতিবাদ তাকে করতে দেখা যায়নি। কলকাতায় নিয়ে এসে ফটিককে স্কুলে ভরতি করিয়ে তিনি নিজের দায়িত্বটুকু শেষ করেছেন।
ব্যক্তিত্বহীন, ভীরু হলেও এই অসহায় মানুষটি আমাদের সহানুভূতি আদায় করে নেয়। অসুস্থ ফটিককে কোলে করে এনে তাকে সেবা করেছেন। জ্বরের মধ্যে ফটিক বাড়ি যেতে চাইলে বিশ্বম্ভরবাবু চোখের জল আটকে রাখতে পারেননি। স্বস্নেহে ফটিকের তপ্ত হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বসে থেকেছেন। তিনি ফটিকের মাকে কলকাতায় নিয়ে আসার বন্দোবস্তও করেছিলেন। তারপর যে সর্বনাশ ঘটেছে, তার মধ্যে এই অসহায় মানুষটির নীরব বেদনা, আমাদের হৃদয়কে স্পর্শ করে।
১৪। ‘ছুটি’ গল্পে ফটিকের মামির চরিত্র লেখো।
উত্তরঃ ‘ছুটি’ গল্পে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেশ কিছু অপ্রধান চরিত্র অঙ্কন করেছেন। এই সকল অপ্রধান চরিত্রগুলো কাহিনিকে অনিবার্য পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। এই অপ্রধান চরিত্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য হল ফটিকের মামি অর্থাৎ বিশ্বম্ভরবাবুর স্ত্রী।
কলকাতায় বসবাসকারী আধুনিক নারী হলেও তিনি ছিলেন হৃদয়হীন ও অমানবিক। নিজের তিন ছেলে থাকা সত্ত্বেও সন্তানসম ফটিককে তিনি আপন করতে পারেননি। উপরন্তু নিজের সংসারে ফটিককে ‘দুর্গ্রহের মতো’ মনে করতেন।
গল্পের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ফটিকের মামি চরিত্রের কোনো বিবর্তন লক্ষ করা যায় না। স্নেহহীনা এই নারী ফটিককে কোনোদিন ভালোবাসতে পারেননি। ফটিকের বয়ঃসন্ধিকালীন ব্যবহার তাকে বিরক্ত ও বিব্রত করেছে। মায়ের স্নেহাঞ্চল থেকে বিচ্যুত ফটিকের শ্রদ্ধার নারী হয়ে উঠতে পারেনি। মামির কটূক্তি তাকে বার বার আঘাত করেছে। স্নেহহীনা এই নারী ফটিকের বই হারানোর ঘটনাকে কেন্দ্র করে অত্যন্ত নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়েছেন। মাত্রাতিরিক্ত বিরক্তি প্রকাশ করে তিনি জানিয়েছিলেন ‘আমি তোমাকে মাসের মধ্যে পাঁচবার করে বই কিনে দিতে পারিনে’ মামির এই শ্লেষাত্মক বাক্য পাঠক মাত্রই বিদ্ধ করবে।
ফটিকের মামি এই গল্পে ভিলেন চরিত্র। তার স্নেহহীনতা, অমানবিকতা ফটিককে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। তিনি যদি স্নেহশীলা, মমতাময়ী হতেন তবে ফটিকের মৃত্যু হত না। ফটিকের অকাল মৃত্যুর জন্য দায়ি ফটিকের মামি। জ্বরে আক্রান্ত মৃত্যুপথযাত্রী ফটিকের পাশে মায়ের ভালোবাসা দেওয়ার পরিবর্তে তিনি তার স্বামী বিশ্বম্ভরবাবুকে দোষারোপ করেছেন- ‘কেন বাপু পরের ছেলেকে নিয়ে কেন এ কর্মভোগ’। আদ্যন্ত মমতাহীনা, অমানবিক, স্নেহহীনা নিষ্ঠুর চরিত্রের প্রতীক হলেন ফটিকের মামি।
১৫। ‘ছুটি’ গল্পে অপ্রধান চরিত্র হিসেবে ফটিকের মায়ের চরিত্র লেখো।
উত্তরঃ ‘ছুটি’ গল্পের প্রধান চরিত্র ফটিকের পর অপর একটি চরিত্র গল্পে অপ্রধান হলেও আমাদের সহানুভূতি ও করুণা আদায় করে নেয়, তিনি হলেন ফটিকের মা।
নিম্নমধ্যবিত্ত বিধবা গ্রামীণ অসহায় নারী। স্বামীর অবর্তমানে সংসারের আর্থিক অস্বচ্ছলতার পাশাপাশি দুই পুত্র সন্তান নিয়ে বিব্রত। বিশেষত ফটিক অত্যন্ত দুরন্ত, অবাধ্য প্রকৃতির; তাকে নিয়ে ফটিকের মায়ের দুশ্চিন্তার অন্ত নেই অন্যদিকে মাখন শান্তশিষ্ট হলেও ফটিকের সঙ্গে তার প্রতিনিয়ত ঝগড়া-মারামারি লেগেই থাকে।
মাতৃত্ব-যা মায়েদের প্রধান বৈশিষ্ট্য তা ফটিকের মায়েরও ছিল। কিন্তু তিনি ছিলেন পক্ষপাতদুষ্ট, আপাত দৃষ্টিতে শান্ত মাখনকে বেশি পছন্দ করতেন। তাই ফটিককে কলকাতায় নিয়ে যাবার প্রস্তাবে তিনি অমত করেননি। ফটিকের মতো দুরন্ত ছেলের কাছে মাকে অত্যাচারিণী ও অবিচারিণী হতেই হয়েছে। কিন্তু সেই অত্যাচারের মধ্যেও যে স্নেহের পরম প্রভাব ছিল তাও গল্পের মধ্যে ফটিকের জন্য চিন্তায় পাওয়া যায়। তাই কঠিন রোগসজ্জায় ফটিক কেবল তার মাকেই খুঁজেছে।
ফটিকের মায়ের চরিত্রের অপর বৈশিষ্ট্য হল দূরদর্শিতার অভাব। তিনি তার দাদা বিশ্বম্ভরবাবুকে চিনতেন কিন্তু তার ভাতৃবধূকে চিনতে পারেননি। যদি সাংসারিক দূরদর্শিতা তার থাকত তাহলে তিনি হয়তো কখনই ফটিককে মামার সঙ্গে কলকাতায় পাঠাতেন না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্যক্তিগত জীবনে বহুপ্রিয়মানুষের মৃত্যুবেদনার আঘাতে জর্জরিত হয়েছেন। সেই আঘাত তাকে এই সত্যে উপনীত করতে সাহায্য করেছে যে মৃত্যু জীবনের অনিবার্য চরম সত্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও মায়ের কোলে সন্তানের মৃত্যু যে কী নির্মম বেদনাদায়ক তা চিন্তা করলে ফটিকের মায়ের জন্য চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। এই কারুণ্যের স্পর্শেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ফটিকের মায়ের মতো সাধারণ অপ্রধান চরিত্রকে স্মরণীয় করে দিয়েছেন।
১৬। ‘ছুটি’ গল্পে মাখন চরিত্রটি উল্লেখ করো।
উত্তরঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘ছুটি’ গল্পে কেন্দ্রীয় চরিত্র হল ফটিক। ফটিকের বিপরীতে লেখক মাখন-এর চরিত্র অঙ্কন করেছেন। মাখনের চরিত্রটি যে একটি অপ্রধান চরিত্র তা বলাই বাহুল্য। মাখনকে সমগ্র গল্পে মাত্র দুবার তাকে দেখা গেছে। মাখন চরিত্র অঙ্কনের ক্ষেত্রে লেখকের একমাত্র উদ্দেশ্য হল ফটিক চরিত্রের অবাধ্যতা, দুরন্ততা, চঞ্চলতাকে আরও স্পষ্ট করে দেখানো। মাখন, ফটিকের বিপরীত। সে শান্ত, বাধ্য। গল্পের শুরুতে নদীতীরে শালকাঠের গুঁড়িকে ঠেলে যে অভিনব খেলার আয়োজন করেছিল ফটিকসহ অন্যান্য ছেলেরা, তাতে বাধা সৃষ্টি করেছিল মাখন। কাঠের গুঁড়ি যাতে সরাতে না পারে তাই মাখন শালকাঠের গুঁড়ির ওপর বসে গিয়েছিল। কিন্তু শেষরক্ষা আর হয়নি। ফটিকের নেতৃত্বে ছেলের দল মাখনসহ গুঁড়ি ঠেলতে থাকে আর তারই অনিবার্য ফলস্বরূপ মাখন ভূমিসাৎ হয়। লজ্জায় অপমানে দিশেহারা মাখন ফটিককে অন্ধভাবে মারতে থাকে। এবং কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি চলে যায়।
ফটিক দুরন্ত হলেও সে সৎ ও সরল। মাখন অসৎ ও মিথ্যাবাদী। নিজের অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মায়ের কাছে মিথ্যে কথা বলে। মাকে মিথ্যে করে জানায় ফটিক তাকে মেরেছে কিন্তু সে যে ফটিককে মেরেছে তা স্বীকার করেনি। স্বাভাবগত শান্ত, ফলত বাধ্য মাখন-এর পক্ষ নিয়েছে মা।
মাখন পড়াশোনায় মনোযোগী। সবার কাছে সে ভালো। ফটিকের মায়ের কাছে বিশ্বম্ভরবাবু ‘মাখনের সুশান্ত সুশীলতা ও বিদ্যানুরাগের বিবরণ শুনিলেন।’
মাখন আসলে খুব জেদি। তার জেদের জন্যই ছেলেদের খেলা পণ্ড হয়েছে। মাখন তার নিজের জেদ ও একগুঁয়েমির জন্য কাঠের গুঁড়ির ওপর বসে ছেলেদের মজার খেলায় বাধা দিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত নিজেই পড়ে গেছে।
মাখন শান্ত, সুশীল, বিদ্যাগুরাগী, মনোযোগীও বাধ্য হলেও তার চরিত্রের ত্রুটি আছে। সে জেদি, মিথ্যাবাদী, শিশুসুলভ সরলতা তার মধ্যে একেবারেই নেই।
১৭। “স্কুলে এতবড়ো নির্বোধ এবং অমনোযোগী বালক আর ছিল না।”- কোন্ বালকের কথা বলা হয়েছে ? তার নির্বোধ ও অমনোযোগিতার পরিচয় দাও।
উত্তরঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উল্লেখযোগ্য গল্প ‘ছুটি’ থেকে গৃহীত আলোচ্য অংশটিতে যে বালকের কথা বলা হয়েছে সে হল ফটিক।
এই গল্পের প্রধান চরিত্র গ্রাম্য সরল, পড়াশোনায় একেবারে অমনোযোগী ফটিক ভাগ্যের পরিহাসে মাতৃস্নেহাঞ্চল থেকে কলকাতায় মামারবাড়িতে আসে। তার চঞ্চলতা ও পড়াশোনার প্রতি উদাসীনতা দেখে বিশ্বম্ভরবাবু ফটিককে কলকাতায় নিয়ে আসেন, এবং কলকাতার স্কুলে ভরতি করিয়ে দেন। সহানুভূতিহীন, ভালোবাসাহীন, স্নেহহীন পরিবেশে ফটিকের মতো অমনোযোগী ছেলে স্কুলের পড়াশোনাতেও মন দিতে পারল না। তথাকথিত শিক্ষাব্যবস্থায় ফটিক শুধু গর্দভের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মার খেয়েছে এবং নীরবে সব সহ্য করেছে। শিক্ষকের কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারত না ফটিক, ফলে হৃদয়হীন অন্তঃসারশূন্য মাস্টারমশাই ফটিককে নির্বোধ বলে মনে করেছে। মুক্তপ্রাণা সরল ফটিককে মাস্টারমশাই বুঝতে পারেননি। বিদ্যালয়ের পুঁথিগত পড়াশোনা না পারাকে চরম ব্যর্থতা বলে মনে করে ফটিককে বিদ্যালয়ের সবচেয়ে নির্বোধ ও অমনোযোগী ছাত্র হিসাবে তার ওপর অত্যাচার করেছে।
১৮। “তখন তাহার চিত্ত অধীর হইয়া উঠিত।”- কার চিত্ত অধীর হয়ে উঠত ? কেন তার চিত্ত অধীর হয়ে উঠত ?
উত্তরঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উল্লেখযোগ্য ছোটোগল্প ‘ছুটি’ থেকে গৃহীত আলোচ্য অংশে মুক্তপ্রাণ গ্রাম্যবালক ফটিক-এর চিত্ত অধীর হয়ে উঠত।
বিশ্বম্ভরবাবু বনের মুক্তবিহঙ্গকে কলকাতায় নিয়ে এসে খাঁচায় পুরলেন। ফটিক মায়ের স্নেহাঞ্চল ও প্রকৃতির শ্যামাঞ্চল থেকে নির্বাসিত হয়ে শহরের বদ্ধ জীবন কাটাতে লাগল। এই অবস্থার মধ্যে মামির ভর্ৎসনা, স্কুলের মাস্টারমশাই-এর হৃদয়হীন প্রহার ও মামাতো ভাইদের নির্মম অপমানজনক আচরণ সব মিলিয়ে ফটিক তার সহজ চাপল্য হারিয়ে এক ভীরু জীবের মত অসহায় হয়ে গেল। হৃদয়হীন এই পরিবেশে ফটিকের মনে বার বার জেগে উঠত তার গ্রাম্য জীবনের স্মৃতি। তার মনে পড়ত ঘুড়ি ওড়ানোর সেই বিশাল মুক্ত মাঠ, স্বরচিত গান গেয়ে অকর্মণ্যভাবে ঘুরে বেড়ানো সেই নদীতীর, যখন-তখন ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কাটবার স্রোতস্বিনী, খেলার সঙ্গীদের, স্বাধীনতা এবং সর্বোপরি অত্যাচারিণী মায়ের কথা। এই অবস্থায় বদ্ধ জীবনে থাকা ফটিক কখনও খোলা ছাদে দু-একটি ছেলেমেয়েদেরকে খেলতে দেখলে অধীর হয়ে উঠত।
১৯। “মামা, মার কাছে কবে যাব।”- বক্তা কে ? বক্তার এইরূপ বলার কারণ কী ?
উত্তরঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘ছুটি’ গল্পের প্রধান চরিত্র হতভাগ্য ফটিক হল আলোচ্য উক্তিটির বক্তা।
চঞ্চল ফটিক কেমন করে স্তিমিত হয়ে এল শহরের কঠিন প্রাচীরে প্রতিহত হয়ে, তার আকুল কান্না কীভাবে স্তব্ধ হয়ে গেল, কেমন করে এই মুক্ত-পাগল বালক চিরকালের মতো হারিয়ে গেল তার করুণ কাহিনি হল ‘ছুটি’। উদার-মুক্ত প্রকৃতির কোল থেকে, কলকাতায় ফটিকের এক দমবন্ধ করা পরিবেশে থাকতে হয়েছিল। একদিকে তেরো-চোদ্দো বছরের বয়ঃসন্ধিকালীন পরিবর্তন এবং সেখানে স্নেহের, ভালোবাসার পরিবর্তে অবহেলা, তাচ্ছিল্য, অপমান, লাঞ্ছনা। ক্লান্ত ফটিক দস্যি বালকের পরিবর্তে এক ভীরু জীবে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু মাঝে মাঝেই তার গ্রামের কথা, মায়ের কথা মনে পড়ত। তার অসহায়-অব্যক্ত বেদনা কোথাও প্রকাশ করবার উপায় ছিল না। মায়ের উপর স্বাভাবিক ভাবে রাগ, অভিমান হলে ফটিকের মন সেই অত্যাচারিণী, অবিচারিণী মায়ের কাছে যেতে চাইত, কারণ মায়ের স্নেহ-ভালোবাসা সর্বশ্রেষ্ঠ, নিখাদ সোনার মত উজ্জ্বল। তাই অসহায় ফটিক নিরুপায় হয়ে মামার কাছে বাড়ি যাওয়ার জন্য কাতর অনুরোধ করেছিল। কিন্তু পুজোর ছুটির আগে তার বাড়ি যাওয়া সম্ভবপর নয় জেনে ফটিক হতাশ হয়ে গিয়েছিল।
২০। “পরদিন প্রাতঃকালে ফটিককে আর দেখা গেল না।”- প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ব্যাখ্যা করো।
উত্তরঃ রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত বহুচর্চিত ছোটোগল্প হল ‘ছুটি’। প্রকৃতির উদার অসীমতায় মুক্তিলাভের ইচ্ছায় কাতর এক গৃহবন্দি বালকের অসহায় বেদনা ‘ছুটি’ গল্পে রূপ নিয়েছে।
স্বাভাবিক বয়সকালীন চাপল্য ও পড়াশোনায় উদাসীনতার কারণে ফটিকের মামা, ফটিককে কলকাতায় নিয়ে আসে। বিধবা অসহায় মা ফটিকের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সেই সিদ্ধান্তে রাজি হয়। কিন্তু হতভাগ্য ফটিক কলকাতায় মামার বাড়িতে মামির কাছে দুর্বিষহ ছাড়া আর কিছু নয়। নিজের তিন সন্তান থাকলেও সদ্য কৈশোরে পা রাখা, গ্রাম্য, অশিক্ষিত ফটিককে তিনি কোনোদিন ভালোবাসেননি। স্নেহমমতা দিয়ে নিজের কাছে টেনে নেননি। ফলে একদিকে মায়ের স্নেহাঞ্চল-বঞ্চিত অন্যদিকে মামির ভর্ৎসনা, স্নেহহীনতা, বিদ্যালয়ের মাস্টারমশাই-এর অমানবিক আচরণ, মামাতো ভাইদের অপমান; সবকিছুর মধ্যে ফটিক একেবারে অসহায় ভীরু জীবে পরিণত হয়। স্বাভাবিকভাবে উদাসীন ফটিক স্কুলের বই হারালে মামির ভর্ৎসনা শোনে। বয়ঃসন্ধিকালীন ধর্ম অনুসারে ফটিক এই সময় স্নেহের কাঙাল। সেখানে নারী মাত্র দেবী এবং তার ভালোবাসা ও স্নেহ কাম্য সেখানে মামি কোনোদিন কণামাত্র স্নেহ নিয়ে ফটিকের দিকে তাকায়নি। এমত অবস্থায় একদিন স্কুল থেকে ফেরার পর মাথাব্যথা ও গা শিরশির করে ফটিকের জ্বর আসে। ফটিকের অসুস্থতার কথা জানতে পারলে মামি কীরকম ব্যবহার করবে তা সে স্পষ্টভাবেই বুঝতে পেরেছিল এবং এই জ্বরে একমাত্র সে মা ছাড়া আর কারো কাছে সেবা ও ভালোবাসা পেতে পারে তা কল্পনাও করতে পারে না। তাই মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য অসহায়, নিরুপায় ফটিক সবার অজান্তে মামাবাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। আলোচ্য অংশে তাই ফটিককে আর পরেরদিন সকালে দেখতে পাওয়া যায় না।
২১। “দাও ওকে বাড়ি পাঠিয়ে দাও।”- কে কাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিতে চেয়েছে ? উক্তিটির মধ্য দিয়ে বক্তার চরিত্রের কোন্ বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায় ? ১+৪
উত্তরঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘ছুটি’ গল্পের অন্তর্গত আলোচ্য অংশটির বক্তা হল বিশ্বম্ভরবাবুর স্ত্রী অর্থাৎ ফটিকের মামি ফটিককে বাড়ি পাঠিয়ে দিতে চেয়েছে।
স্বহৃদয় বিশ্বম্ভরবাবু ফটিকের ভবিষ্যতের কথা ভেবে কলকাতায় নিজের কাছে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু মাতৃ স্নেহাঞ্চল ছেড়ে মামির হৃদয়হীন পরিবেশে ফটিক থাকতে পারেনি। কণামাত্র স্নেহের দৃষ্টিতে এই হতভাগ্য ছেলেটার প্রতি তিনি কোনোদিন তাকাননি। বই হারানোর কারণে মামির শ্লেষাত্মক বাক্যে তীব্র জ্বালা সহ্য করতে হয় তাকে। গৃহত্যাগী জ্বরাক্রান্ত ফটিককে যখন পুলিশ ফিরিয়ে আনে তখনও সামান্য সহানুভূতি না দেখিয়ে নির্মম কণ্ঠে ফটিককে বাড়ি ফিরিয়ে দিয়ে আসার কথা জানিয়েছিল।
একজন অসুস্থ মানুষকে দেখে পথের পথিকেরও দয়ামায়া হয়। কিন্তু ফটিকের মামি নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন ও অমানবিক। তিনি মাতৃকুলের কলঙ্ক তাই সরল গ্রাম্য বালক ফটিকের মা হয়ে উঠতে পারেননি তিনি কখনও। এমন নির্মম নারী চরিত্র মানব সংসারে বিরল। তাঁর এই ধরনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ফটিককে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিল।
২২। “মামা, আমার ছুটি হয়েছে কি।”- প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ব্যাখ্যা লেখো।
উত্তরঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘ছুটি’ গল্প থেকে আলোচ্য অংশটি নেওয়া হয়েছে। এই গল্পের প্রধান চরিত্র গ্রাম্য, সরল, দুরন্ত, অবাধ্য, দস্যি বালক ফটিক। ফটিকের ভবিষ্যতের কথা ভেবে মামা বিশ্বম্ভরবাবু ফটিককে কলকাতায় নিজের কাছে রাখার সিদ্ধান্ত নেন। সদ্য বিধবা, সহায়সম্বলহীনা ফটিকের মা দুরন্ত ছেলের এই সুব্যবস্থার সিদ্ধান্তকে মেনেও নেন। কিন্তু যে অবাধ্য, দুর্বিনীত, চঞ্চল বালককে গল্পের প্রথমে দেখা যায়, গল্পের শেষে সে পরিবর্তিত এক অন্য কিশোর। মামার বাড়ির অনাদর, অবহেলা, বিদ্যালয়ের শহুরে সতীর্থদের অবজ্ঞা, উপহাস, সর্বোপরি মামির স্নেহহীন নিপীড়নে ফটিক তার সহজ চাপল্য হারিয়ে হয়ে ওঠে ভীরু জীবের মতো অসহায়।
পুজোর ছুটিতে মামার বাড়ি যাওয়া। সেই বহু প্রত্যাশিত ছুটির অপেক্ষায় তার অধৈর্য প্রহর কেটেছে। কিন্তু এর মধ্যে বই হারানোর জন্য মামির কাছে এবং স্কুলে মাস্টার মশাইয়ের কাছে তিরস্কৃত হয়। নিজের দৈন্যতা ও হীনতার মর্মবেদনায় তার জ্বর আসে। অসুস্থ অবস্থায় মায়ের স্নেহের আশায় মামাবাড়ি ছেড়ে অজানা পথে বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু হতভাগ্য নিরুদ্দিষ্ট বালক ফটিক যখন আবার মামাবাড়ি ফিরে আসে তখন তার শেষ যাত্রার সময়। প্রচন্ড জ্বরে ফটিকের প্রলাপ বাক্যের মধ্যেও ছিল ছুটি পাওয়ার তীব্র আকুলতা। রোগশয্যায় চারপাশে অবুঝ-বোবা দৃষ্টি নিয়ে সে খুঁজে ফিরেছে মা’কে। কঠিন দেয়ালে বাধা পেয়ে তার আশা ফিরে এসেছে শূন্যতায়। শহর থেকে গ্রামে ফেরার জন্য তার ব্যাকুলতা ছিল তীব্রতর। খাঁচার জালে বন্দি বনের পাখির মতোই তার অসহ্য যন্ত্রণা তাকে মুক্তির জন্য ব্যাকুল করে তোলে। অসহায় ফটিক তাই বারবার প্রশ্ন করেছিল-‘কবে তার ছুটি হবে ?’
২৩। “এক বাঁও মেলে না। দো বাঁও মেলে-এ-এ-না।”- প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ব্যাখ্যা করো।
উত্তরঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ছোটো গল্পগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘ছুটি’ গল্প। প্রকৃতির উদার অসীমতায় মুক্তিলাভের ইচ্ছায় কাতর এক গৃহবন্দি বালকের অসহায় বেদনা ‘ছুটি’ গল্পে রূপ নিয়েছে। এই গল্পের শেষ হয়েছে শহরের কৃত্রিম অমানবিক পরিবেশে ফটিকের করুণ মৃত্যুতে। এই নিরাভরণ সাদামাটা গল্পটি রসোত্তীর্ণ হয়েছে এক দূরায়ত জীবনবোধের আবেদনে। ‘ছুটি’ নিছক এক শহরের পিঞ্জরে আবদ্ধ গ্রাম্যবালকের মৃত্যুর বেদনাময় কাহিনি নয়। গল্পটি অসামান্য মাত্রা পায় জল মাপার জন্য ‘এক বাঁও মেলে না, দো বাঁও মেলে-এ-এ না’, -স্টিমারের খালাসিদের এই রশি ফেলার চিত্রকল্পের মাধ্যমে। ফটিকের চেতনার অতলে এই অভিজ্ঞতালব্ধ চিত্রকল্প নিহিত ছিল, মৃত্যুর মুহূর্তে সেই ছবি যেন ভেসে উঠেছে তার অবচেতন দর্পণে। বালক ফটিকের মৃত্যু যেন একটি সাংকেতিক চিত্রকল্পের অন্তহীন ব্যঞ্জনা আনে- ‘যে অকূল সমুদ্র যাত্রা করিতেছে, বালক রশি ফেলিয়াও কোথাও তাহার তল পাইতেছে না।’ এই সুদুর অকূল সমুদ্রের বিশাল চিত্রপট পাঠক-হৃদয়ে ক্রমশ ছড়িয়ে যেতে থাকে যেন, সেই নান্দনিক ইঙ্গিতেই নিহিত আছে গল্পটির গূঢ় রস ও রহস্য।
২৪। “প্রকৃতির সাথে মানব-এর অছেদ্য বন্ধন নষ্ট হওয়ার ফলে ফটিকের মৃত্যু।”- বক্তব্যটির সত্যতা যাচাই করো।
অথবা, প্রকৃতির সঙ্গে ফটিকের অচ্ছেদ্য বন্ধনের পরিচয় দাও।
উত্তরঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্যান্য ছোটো গল্পগুলির মতো ‘ছুটি’ গল্পেও প্রকৃতির সঙ্গে মানবমনের নিগূঢ় সম্পর্কের চিত্র এঁকেছেন। গ্রাম্য প্রকৃতির উদার অসীম মুক্ত পরিবেশে বেড়ে ওঠা দুরন্ত বালক ফটিক কেমন করে শহরের চার দেয়ালের কঠিন বাঁধনে বন্দি হয়ে রইল, কেমন করে এই মুক্ত পাগল বালক চিরকালের মতো ছুটি নিয়ে হারিয়ে গেল- তারই বাস্তব করুণ কাহিনি হল ‘ছুটি’।
গ্রামবাংলার উদার আকাশের নীচে, পথে-প্রান্তরে, নদীর ঘাটে ছুটির আনন্দে দস্যি ছেলেদের সঙ্গে নিয়ে সারাদিন ছুটে বেড়ানোই ছিল ফটিকের কাজ। কখনও ‘তাইরে-নাইরে নাইরে না’ স্বরচিত গান গেয়ে মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়ানো, কখনও ঢাউস ঘুড়ি নিয়ে ওড়ানো, যখন-তখন ঝাঁপ দিয়ে নদীতে সাঁতার কাটা-এইসবই ছিল ফটিকের প্রতিদিনের খেলাধুলার অঙ্গ। নিয়মমাফিক পড়াশোনা বা সাংসারিক কাজে তার কোনোদিনই মন ছিল না। ফটিক ছিল বনের মুক্ত পাখি আর প্রকৃতি ছিল তার স্বচ্ছন্দ্য, স্বাধীন চরাচর ক্ষেত্র। অনন্ত-উদার নীল আকাশে আপন মনে উড়ে বেড়ানো আর গান গাওয়াতেই ছিল তার প্রাণের মুক্তি, আত্মার আনন্দ। তাই গ্রাম্য-প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ফটিক কলকাতার শহরে ইট, কাঠ, পাথরের কারাগারে বন্দি হয়ে বাঁচল না।
প্রকৃতির বুকে বেড়ে ওঠা, প্রকৃতির ভাষা বোঝা সহজ-সরল নিষ্পাপ ফুল। ফটিক অন্তরঙ্গ তাৎপর্যেই গ্রামীণ প্রকৃতির সন্তান। কলকাতা তার পক্ষে প্রবাসজীবন। তাই গ্রামে ফিরতে সে ব্যাকুল। তার নিজের মা এবং প্রকৃতি মা এখানে অভিন্ন। মা-ই তার কাছে প্রকৃতির প্রতীক।
২৫। ‘ছুটি’ গল্পে রবীন্দ্রনাথ ফটিকের চরিত্রে বয়ঃসন্ধিকালের বিড়ম্বনা এঁকেছেন, তার পরিচয় দাও।
উত্তরঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘ছুটি’ গল্পের প্রধান চরিত্র ফটিক। তেরো-চোদ্দো বছরের বালক ফটিক। এই তেরো-চোদ্দো বছর হল বয়ঃসন্ধিকাল। এই সময় শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধিজনিত কারণে নানারকম আবেগ-অনুভূতি, কৌতূহল এবং চারপাশের মানুষের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পালটে যায়।
ফটিক চরিত্রের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ সুনিপুণভাবে এই বয়সটির স্বভাব তুলে ধরে বয়সটিকে বালাই বলেছেন। নানারকম শারীরিক পরিবর্তন লক্ষ করা যায় বলেই শৈশবের লালিত্য চলে চায়। গলার স্বর পরিবর্তিত হয়, ফলে গলার স্বরের মিষ্টতা কমে যায়। আধো কথা ন্যাকামি আর পাকা পাকা কথা জ্যাঠামি বলে মনে হয়। কাপড়চোপড়ের পরিমাণ রক্ষা না করে তার শরীর বেমানান রূপে বেড়ে ওঠে। সেজন্য লোকে তাকে নিন্দা করে। সেও কারোর সঙ্গে সহজে মিশতে পারে না। শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনগুলির জন্য সে নিজেকে সর্বদা অপরাধী মনে করে। এই বয়সের স্বাভাবিক অনিবার্য ত্রুটিও ক্ষমার যোগ্য হয় না। এই বয়সের কিশোর স্নেহ-ভালোবাসার কাঙাল হয়। যে তাকে স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে আপন করতে পারে, তার কাছে সে আত্মবিক্রয়ও করে থাকে।
এইরকম এক সংবেদনশীল বয়স ধর্মের মধ্যে থাকা ফটিকের কপালে জুটেছিল মামির স্নেহহীন ভর্ৎসনা। ফলে ফটিকের অবস্থা অনেকটা প্রভুহীন পথের কুকুরের মতোই হয়েছিল। এই সময় মা হল শ্রেষ্ঠ আশ্রয়স্থল। কিন্তু ফটিক মায়ের স্নেহাঞ্চল থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। বয়ঃসন্ধিকালের বিড়ম্বনার সার্থক সাযুজ্যে ফটিক রবীন্দ্রনাথের অনবদ্য চরিত্রসৃষ্টি।
২৬। “দেখ, মার খাবি। এইবেলা ওঠ।”-বক্তা কে, কাকে বলা হয়েছে? বক্তার এইরূপ বলার কারণ কী ? ২+৩
উত্তরঃ প্রকৃতিপ্রেমিক মানবতাবাদী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘ছুটি’ গল্পে প্রধান চরিত্র ফটিক হল এই উক্তিটির বক্তা। ফটিকের নিজের ছোটোভাই মাখনলালকে উদ্দেশ্য করে একথা বলা হয়েছে।
নদীর ধারে পড়ে থাকা শাল কাঠের গুঁড়িকে গড়িয়ে গড়িতে মজার খেলায় রত হয়েছিল ছেলের দল। এই দলের সর্দার ফটিকের নেতৃত্বে উদ্দাম ছেলের দল যখন কাঠের গুঁড়ি সরানোর মজার খেলা শুরু করে তখনই মাখনলাল তার অকাল তত্ত্বজ্ঞানী গম্ভীর রূপ নিয়ে তার উপর বসে পড়ে। ফলে খেলায় সাময়িক বাধার সৃষ্টি হয়। মাখনলালের বড়োদাদা এবং ছেলের দলের সর্দার হিসেবে নিজের ক্ষমতার আস্ফালন করতে ফটিক আলোচ্য উক্তিটি করেছিল। মজার খেলাকে সাবলীল করতে কাঠের গুঁড়ি থেকে মাখনলালকে নেমে আসার কথা বলা হয়েছে। মাখনলালের কারণে যদি খেলা বন্ধ হয় তবে ফটিকের হাতে সে মারও খাবে এ কথাও জানিয়ে দিয়েছে। আলোচ্য উক্তিটির মধ্য দিয়ে প্রাণচঞ্চল, উদ্দাম ফটিকের জেদ ও শাসন ফুটে উঠেছে।
২৭। “একেবারে অন্ধভাবে মারিতে লাগিল।”- কে, কাকে, কেন মারিতে লাগল ? উক্ত চরিত্রের কোন্ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায় ? ২+৩
উত্তরঃ আলোচ্য উক্তিটি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত ছোটোগল্প ‘ছুটি’ থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোচ্য অংশে মাখনলাল, তার দাদা ফটিককে মারতে লাগল।
নদীর ধারে এক শাল কাঠের গুঁড়িকে ঠেলে ঠেলে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার ভিন্ন এক মজার খেলার কৌশল ফটিকসহ ছেলের দল আবিষ্কার করেছিল। কিন্তু সেই খেলাতে বাধা সৃষ্টি করার জন্য ফটিকের নিজের ছোটোভাই মাখনলাল কাঠের গুঁড়ির ওপর বসে পড়ে। অনেক অনুরোধ করা সত্ত্বেও সে কাঠের গুঁড়ি থেকে নামতে রাজি না হওয়ায় ছেলের দলের খেলার আনন্দ বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। এমত অবস্থায় ফটিকের পরামর্শে মাখনসহ কাঠের গুঁড়ি ঠেলার পরিকল্পনা করা হয়। তাতে আরও বেশি আনন্দ। মাখনসহ কাঠের গুঁড়ি ঠেলার সঙ্গে সঙ্গে অনিবার্যভাবে মাখন মাটিতে পড়ে যায়। নিজের জেদকে চরিতার্থ করতে না পেরে রাগবশত ফটিককে অন্ধভাবে মারতে থাকে।
মাখন, ফটিকের নিজের ভাই হলেও চরিত্রগত দিক দিয়ে সে একেবারে ফটিকের বিপরীত। শৈশবের চাপল্য তার মধ্যে নেই। তাই লেখক তাকে ‘অকাল তত্ত্বজ্ঞানী’ বলে পরিহাস করেছেন। খেলার আনন্দে আনন্দিত হওয়ার পরিবর্তে মাখন খেলা ভন্ডুল করতে বেশি আগ্রহী। মাখন জেদি তাই সবাই তাকে অনুরোধ করলেও সে কাঠের গুঁড়ি থেকে নামে না। নিজের জেদের কাছে পরাজিত হলে অপমানজনিত কারণে ফটিককে মারতে থাকে।
২৮। “বিশ্বম্ভরের এত বয়স হইল, তবু কিছুমাত্র যদি কাণ্ডজ্ঞান আছে।”– বক্তা কে ? বক্তার এইরূপ বলার কারণ কী ?
উত্তরঃ উদ্ধৃত বাক্যাংশের বক্তা হলেন কলকাতাবাসী, স্নেহহীনা নারী ফটিকের মামি, অর্থাৎ বিশ্বম্ভরবাবুর স্ত্রী।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘ছুটি’ গল্পে দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকার পর বিশ্বম্ভরবাবু কলকাতায় ফিরে এসে বোনের ভাগ্যবিপর্যয়ের কথা জানতে পারেন। সদ্য স্বামীহারা বিধবা বোনের খোঁজখবর নেওয়ার আশায় তিনি গ্রামে আসেন। কিছুদিন তাদের সঙ্গে আনন্দেই কাটান। বোন ও বোনের সন্তানদের প্রতি স্বাভাবিক ভালোবাসার টানে তাদের অভাব-অভিযোগের কথা তার কানে আসে। বিশ্বম্ভরবাবু জানতে পারেন, ফটিক ও মাখনের মধ্যে কোনো বনিবনা নেই। প্রতিনিয়ত তারা ঝগড়া, মারপিট করে। তা ছাড়া ফটিক খুব দুরন্ত ও পড়াশোনায় অমনোযোগী। তাই বোনকে চিন্তামুক্ত করতে, ফটিককে পড়াশোনায় মনোযোগী করে তুলতে তিনি সিদ্ধান্ত নেন ফটিককে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে নিজের কাছে রাখবেন। তার এই সিদ্ধান্ত সাধুবাদযোগ্য হলেও মানবচরিত্র সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান না থাকার কারণে তিনি নিজের পরিবারে ও ফটিকের জীবনে বিপর্যয় ডেকে এনেছিলেন। কলকাতায় তার তিন সন্তান-সহ পরিবারের মধ্যে ফটিকের মতো অশিক্ষিত, অপরিচিত গ্রাম্য বালক কী ধরনের বিপদ হতে পারে, তা তিনি কল্পনা করতে পারেননি। তা ছাড়া নিজের স্ত্রীকেও তিনি সঠিকভাবে চিনতে পারেননি। বিশ্বম্ভরবাবুর স্ত্রী অর্থাৎ ফটিকের মামি প্রথম থেকেই ফটিককে বোঝাস্বরূপ মনে করেছে। নিজের সন্তানদের মধ্যে এই তেরো বছরের বালক যে কী ভয়ানক বিপদের কারণ হতে পারে, তা বিশ্বম্ভরবাবু বুঝতে পারেননি বলে ফটিককে কলকাতায় নিয়ে আসাকে তিনি কান্ডজ্ঞানহীন কাজ বলেছেন।
২৯। ছোটোগল্প হিসেবে ‘ছুটি’ গল্পের সার্থকতা আলোচনা করো। ৫
উত্তরঃ কোনো রচনার নামকরণ নির্বাচন কীভাবে হবে তা মূলত নির্ভর করে রচয়িতা, পাঠকের অন্তরে কোন্ বিশেষ বস্তুটির মাধ্যমে নাড়া দিতে চান তার উপরেই । ছোটগল্পের সার্থক স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথের অমর রচনা ‘ছুটি’ গল্পটিকে এবার আলোচনার কেন্দ্রে আনা যাক। গল্পের প্রধান চরিত্র কিশোর ফটিক গ্রামের স্বাধীন মুক্ত জীবন ত্যাগ করে শহরের বন্দি জীবনে প্রবেশ করে। কিন্তু স্নেহ-মমতাহীন নাগরিক পরিবেশে সে খাপ খাইয়ে চলতে পারেনি। চাতক পাখির মত একটানা মুক্তি চেয়েছে সে। নির্মম শহুরে পরিবেশ থেকে মুক্তির জন্য তার অন্তর কেবলই আকুলি-বিকুলি করেছে, কিন্তু নিয়তি তাকে চিরকালের জন্যে দিয়েছে ছুটি। আর তাই বিষয়বস্তুর বলে বিচারে গল্পটি’র ‘ছুটি’ নামকরণ শুধুমাত্র প্রাসঙ্গিক ছিল তা নয়, তা হয়ে উঠেছে অনিবার্য ও শিল্প সৌন্দর্য মণ্ডিত।
পরিশেষে বলা যেতে পারে কোনো বিষয় বা বস্তুর উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া কোনো জিনিসই বেশীদিন টিকে থাকে না। প্রয়োজন বা সময়ের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে একটি নাম স্বাভাবিক নিয়মেই মানুষের অন্তরে গেঁথে যায়। মানুষ তার রুচিবোধ ও সৌন্দর্য বোধের কারণেই সেই নাম গ্রহণ করে থাকে। আর সৃজনশীল মানুষের কাছে সেই নামটি ধীরে ধীরে অনিবার্য হয়ে ওঠে।
৩০। “মা, এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।”- কে, কাকে উদ্দেশ করে কথাটি বলেছে ? ছুটির জন্য বক্তার এই আকুলতার কারণ কী ছিল ? শেষপর্যন্ত বক্তা তার কাঙিক্ষত ছুটি কীভাবে পেয়েছিল ? ১+২+২
উত্তরঃ বাংলা সাহিত্যের গল্পকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘গল্পগুচ্ছ’ গ্রন্থের ‘ছুটি’ গল্প থেকে উক্ত প্রশ্নটি এসেছে। এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ফটিক। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ফটিক তার মা-কে উদ্দেশ করে বলেছে।
ফটিকের মামা বিশ্বম্ভরবাবু ফটিককে কলকাতায় পড়াশোনার জন্য নিয়ে গেলেও একদিকে মামার বাড়িতে মামির অনাদর, অন্যদিকে শহরের বদ্ধ জীবন ফটিককে কখনোই পড়াশোনায় আকৃষ্ট করতে পারেনি। ফলে স্কুলে সে ‘নির্বোধ এবং অমনোযোগী’ হিসেবে চিহ্নিত হয়। মাস্টারমশাই তাকে পড়া না পারার জন্য মারতেন, এমনকি তার মামাতো ভাইরা পর্যন্ত তার সঙ্গ এড়িয়ে চলা পছন্দ করত। ঘরে এবং বাইরে এত অনাদর এবং উপেক্ষার মধ্যে থাকতে থাকতেই ফটিকের মা-র কাছে যাওয়ার ইচ্ছা হত। তার মামা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে কার্তিক মাসে পুজোর ছুটির সময় সে বাড়ি যাবে। তখন থেকেই শুরু হয় ছুটির জন্য ফটিকের অধীর অপেক্ষা।
অসুস্থ হওয়ার পরে ফটিক নিজেই নিজের ছুটি করে নিতে চেয়েছিল, কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে। কিন্তু মামার উদ্যোগে পুলিশের গাড়ি তাকে ফিরিয়ে আনে। নশ্বর জীবনে যে ছুটি ফটিক চেয়েছিল সে তা পায়নি, কিন্তু মৃত্যু তাকে সেই ছুটির সুযোগ করে দিয়েছে। ছুটিতে সে তার মার কাছে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু সফল হয়নি। সেই মা-কে পাশে রেখেই ফটিক যাত্রা করেছে অনন্ত ছুটির দেশে।