ইলিয়াস গল্পের লেখক পরিচিতি | ইলিয়াস গল্পের উৎস | ইলিয়াস গল্প পাঠ | ইলিয়াস গল্পের বিষয় সংক্ষেপ | ইলিয়াস গল্পের নামকরণ | ইলিয়াস গল্পের শব্দার্থ | Class 9 Bengali ilias Story Summary Leo Tolstoy

WhatsApp Channel Join Now
Telegram Group Join Now

নবম শ্রেণির বাংলা প্রশ্নোত্তর

ইলিয়াস গল্পের লেখক পরিচিতি | ইলিয়াস গল্পের উৎস | ইলিয়াস গল্প পাঠ | ইলিয়াস গল্পের বিষয় সংক্ষেপ | ইলিয়াস গল্পের নামকরণ | ইলিয়াস গল্পের শব্দার্থ

ইলিয়াস
লিও তলস্তয়

ইলিয়াস গল্পের লেখক পরিচিতি | নবম শ্রেণির বাংলা

ভূমিকাঃ লিও তলস্তয় রুশ সাহিত্যের একজন খ্যাতনামা লেখক। ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দের ৯ সেপ্টেম্বর রাশিয়ার টুলা প্রদেশে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।

শিক্ষাজীবনঃ ছেলেবেলায় বাড়িতেই তলস্তয়ের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। মাত্র পাঁচ-ছয় বছর বয়সে তিনটি ভাষায় তাঁর হাতেখড়ি হয়– মাতৃভাষা রুশ, জার্মান এবং ফরাসি। ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে কাজান বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন এবং প্রাচ্যদেশের ভাষা শিখতে আরম্ভ করলেও শেষপর্যন্ত তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে কৃষক হওয়ার উদ্দেশ্যে বাবার জমিদারিতে ফিরে আসেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় সফল না হলেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতোই তিনি প্রকৃত অর্থে স্ব-শিক্ষিত ছিলেন। নিজের চেষ্টায় তিনি গ্রিক, আরবি, লাতিন, ইংরেজি সহ বহু ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। চিত্রকলা এবং সংগীতশাস্ত্রেও তলস্তয় দক্ষ ছিলেন।

কর্মজীবনঃ ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং ক্রিমিয়ার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এই সময়েই তাঁর সাহিত্যিক প্রতিভার বিকাশ ঘটে।

সাহিত্যজীবনঃ সেনাবাহিনীতে থাকাকালীন তলস্তয় প্রথম আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস Childhood রচনা করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস হিসেবে এটি The Contemporary তে প্রকাশিত হয়। সেনাবাহিনী ত্যাগ করার পর তিনি আত্মজীবনীমূলক ট্রিলজির দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড প্রকাশ করেন যথাক্রমে Boyhood ও Youth নামে। ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস War and Peace প্রকাশিত হয়। সাহিত্যমহল এই কাহিনিতে গভীরভাবে আলোড়িত হয়। এরপর ১৮৭৩–১৮৭৭ এর মধ্যে তাঁর Anna Karenina উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য ছোটো উপন্যাস হল The Death of Ivan Ilych এবং Father Sergius। এগুলি ছাড়াও তলস্তয় প্রচুর ছোটোগল্প, প্রবন্ধ এবং নাটক লিখেছেন।

সাহিত্যরীতিঃ তলস্তয় দার্শনিকের দৃষ্টিভঙ্গিতে জগৎকে বিচার করেছেন। বাস্তবজীবনের অভিজ্ঞতাকেই তিনি তাঁর লেখার মধ্যে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। জীবনের প্রকৃত অর্থ খোঁজা এবং অতি সহজে ও সংক্ষেপে জীবনের প্রকৃত রূপ তুলে ধরাই তাঁর ছোটোগল্পগুলির উদ্দেশ্য। তাঁর শিক্ষামূলক ছোটোগল্পগুলি নীতিবোধের শিক্ষা দেয়।

ব্যক্তিজীবনঃ ব্যক্তিগত জীবনে তলস্তয়ের মধ্যে প্রচুর পরস্পরবিরোধী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য একসঙ্গে দেখতে পাওয়া যায়। যুবা বয়সে তিনি যেমন একদিকে বেহিসাবি জীবনযাপন করে অর্থের অপচয় করেছেন, তেমন পরিণত বয়সে তিনি সব কিছু ত্যাগ করে সন্তের মতো জীবন কাটিয়েছেন। খ্রিস্টান ধর্মের যাজক সম্প্রদায়ের সমালোচনা করায় তিনি খ্রিস্টধর্ম থেকে বহিষ্কৃত হন। একইভাবে, তিনি রাশিয়ার জার শাসনতন্ত্রের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধেও সরব হন। দরিদ্র চাষির সন্তানদের জন্য তিনি স্কুল তৈরি করেন এবং নিজেই সেখানে শিক্ষকতা করতেন।

শেষজীবনঃ শেষজীবনে তিনি কাউকে না জানিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যান। বাড়ি থেকে অনেক দূরে আস্টাপোভো নামক রেলস্টেশনে প্রচণ্ড শীতে নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দের ৭ নভেম্বর তিনি মারা যান।

ইলিয়াস গল্পের উৎস

লিও তলস্তয় রচিত ইলিয়াস গল্পটি ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে রচিত। গল্পটি তলস্তয়ের Twenty Three Tales নামক গল্প সংকলনে প্রকাশিত হয়। পাঠ্য গল্পটি সেই গল্পটির অনুবাদ। অনুবাদটি করেছেন মণীন্দ্র দত্ত।

ইলিয়াস গল্প পাঠ | নবম শ্রেণির বাংলা | পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ

উফা প্রদেশে ইলিয়াস নামে একজন বাসকির বাস করত। ইলিয়াসের বিয়ের এক বছর পরে যখন তার বাবা মারা গেল তখন সে না ধনী, না দরিদ্র। সাতটা ঘোটকী, দুটো গোরু আর কুড়িটা ভেড়া— এই তার যা কিছু বিষয়-সম্পত্তি। কিন্তু ইলিয়াসের সুব্যবস্থায় তার সম্পত্তি কিছু কিছু করে বাড়তে লাগল। সে আর তার স্ত্রী সকলের আগে ঘুম থেকে উঠে আর সকলের পরে ঘুমোতে যায়। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করে। ফলে প্রতি বছরই তার অবস্থার উন্নতি হতে লাগল।

এইভাবে পঁয়ত্রিশ বছর পরিশ্রম করে সে প্রচুর সম্পত্তি করে ফেলল। তখন তার দুশো ঘোড়া, দেড়শো গোরু-মোষ, আর বারোশো ভেড়া। ভাড়াটে মজুররা তার গরু-ঘোড়ার দেখাশোনা করে, ভাড়াটে মজুরানিরা দুধ দোয়, কুমিস, মাখন আর পনির তৈরি করে। মোট কথা, ইলিয়াসের তখন খুব বোলবোলাও, পাশেপাশের সকলেই তাকে ঈর্ষা করে। বলে : ‘ইলিয়াস তো ভাগ্যবান পুরুষ; কোনো কিছুরই অভাব নেই; ওর তো মরবারই দরকার নেই।’

ক্রমে ভালো ভালো লোকের সঙ্গে তার পরিচয় হতে লাগল। দূর দূরান্ত থেকে অতিথিরা তার সঙ্গে দেখা করতে আসে। সকলকেই স্বাগত জানিয়ে সে তাদের ভোজ্য পানীয় দিয়ে সেবা করে। যে যখনই আসুক, কুমিস, চা, শরবত আর মাংস সব সময়েই হাজির। অতিথি এলেই একটা বা দুটো ভেড়া মারা হয়; সংখ্যায় বেশি হলে ঘোটকীও মারা হয়।

ইলিয়াসের দুই ছেলে, এক মেয়ে। সকলেরই বিয়ে হয়ে গেছে। ইলিয়াস যখন গরিব ছিল, ছেলেরা তার সঙ্গে কাজ করত, গোরু-ভেড়া চরাত। কিন্তু বড়লোক হওয়ার পরে তারা আয়েশি হয়ে উঠল। বড়োটি এক মারামারিতে পড়ে মারা গেল। ছোটোটি এমন এক ঝগড়াটে বউ বিয়ে করল যে তারা বাপের আদেশই অমান্য করতে শুরু করল। ফলে ইলিয়াসের বাড়ি থেকে তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হলো।

ইলিয়াস তাকে একটা বাড়ি দিল, কিছু গোরু-ঘোড়াও দিল। ফলে ইলিয়াসের সম্পত্তিতে টান পড়ল। তারপরেই ইলিয়াসের ভেড়ার পালে মড়ক লেগে অনেকগুলো মরে গেল। তার পরের বছর দেখা দিল দুর্ভিক্ষ। খড় পাওয়া গেল না একেবারে। ফলে সে-বছর শীতকালে অনেক গোরু-মোষ না খেয়ে মরল। তারপর ‘কিরবিজ’রা তার সবচাইতে ভালো ঘোড়াগুলো চুরি করে নিয়ে গেল। ইলিয়াসের অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ল। যত তার অবস্থা পড়তে লাগল ততই তার শরীরের জোরও কমতে লাগল। এমনি করে সত্তর বছর বয়সে ইলিয়াস বাধ্য হয়ে তার পশমের কোট, কম্বল, ঘোড়ার জিন, তাঁবু এবং সবশেষে গৃহপালিত পশুগুলোকে বিক্রি করে দিয়ে দুর্দশার একেবারে চরমে নেমে গেল। আসল অবস্থা বুঝে উঠবার আগেই সে একেবারে সর্বহারা হয়ে পড়ল। ফলে বৃদ্ধ বয়সে স্বামী-স্ত্রীকে অজানা লোকের বাড়িতে বাস করে, তাদের কাজ করে খেতে হতো। সম্বলের মধ্যে রইল শুধু কাঁধে একটা বোঁচকা— তাতে ছিল একটা লোমের তৈরি কোট, টুপি, জুতো আর বুট, আর তার বৃদ্ধা স্ত্রী শাম-শেমাগি। বিতাড়িত পুত্র অনেক দূর দেশে চলে গেছে, মেয়েটিও মারা গেছে। বৃদ্ধ দম্পতিকে সাহায্য করবার তখন কেউ নেই।

মহম্মদ শা নামে এক প্রতিবেশীর করুণা হলো বুড়ো-বুড়ির জন্য। সে নিজে ধনীও নয়, গরীবও নয়, তবে থাকত সুখে, আর লোকও ভালো। ইলিয়াসের অতিথি বৎসলতার কথা স্মরণ করে তার খুব দুঃখ হলো। বলল : ‘ইলিয়াস, তুমি আমার বাড়ি এসে আমার সঙ্গে থাকো। বুড়িকেও নিয়ে এসো। যতটা ক্ষমতায় কুলোয় গ্রীষ্মে আমার তরমুজের খেতে কাজ করবে আর শীতকালে গোরু-ঘোড়াগুলোকে খাওয়াবে। শাম-শেমাগিও ঘোটকীগুলোকে দুইতে পারবে, কুমিস তৈরি করতে পারবে। আমি তোমাদের দুজনেরই খাওয়া-পরা দেবো। এছাড়া যদি কখনও কিছু লাগে, বলবে, তাও দেবো ।

ইলিয়াস প্রতিবেশীকে ধন্যবাদ দিল। সে আর তার স্ত্রী মহম্মদ শার বাড়িতে ভাড়াটে মজুরের মতো কাজ করে খেতে লাগল। প্রথমে বেশ কষ্ট হতো, কিন্ত ক্রমে ক্রমে সব সয়ে গেল। যতটা পারত কাজ করত আর থাকত।

বুড়ো-বুড়িকে রেখে মহম্মদ শারও লাভ হলো, কারণ নিজেরা একদিন মনিব ছিল বলে সব কাজই তারা ভালোভাবে করতে পারত। তা ছাড়া তারা অলস নয়, সাধ্যমতো কাজকর্ম করত। তবু এই সম্পন্ন মানুষ দুটির দুরবস্থা দেখে মহম্মদ শার দুঃখ হতো।

একদিন মহম্মদ শার একদল আত্মীয় অনেক দূর থেকে এসে তার বাড়িতে অতিথি হলো। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন মোল্লা। মহম্মদ শা ইলিয়াসকে একটা ভেড়া এনে মারতে বলল। ইলিয়াস তার চামড়া ছাড়িয়ে, সেদ্ধ করে অতিথিদের কাছে পাঠিয়ে দিল । অতিথিরা খাওয়া-দাওয়া করল, চা খেল, তারপর কুমিস-এ হাত দিল। মেঝেয় কম্বলের উপরে পাতা কুশনে গৃহস্বামীর সঙ্গে বসে অতিথিরা বাটি থেকে কুমিস পান করতে করতে গল্প করছিল। এমন সময় কাজ শেষ করে ইলিয়াস দরজার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। তাকে দেখতে পেয়ে মহম্মদ শা অতিথিদের বলল :

‘দরজার পাশ দিয়ে যে বুড়ো মানুষটি চলে গেল তাকে আপনারা লক্ষ্য করেছেন কি ?’ একজন বলল, ‘আমি তাকে দেখিনি। কিন্তু ওর মধ্যে বিশেষ করে দেখবার কিছু আছে নাকি ?’

‘বিশেষত্ব এই যে, একসময় সে এ তল্লাটের সবচেয়ে ধনী ছিল। নাম ইলিয়াস । নামটা আপনারা হয়তো শুনে থাকবেন।’

অতিথি বলল, ‘নিশ্চয়ই। না শোনবার জো কী ? লোকটিকে কখনও চোখে দেখিনি, কিন্তু তার সুনাম ছড়িয়েছিল বহুদূর।’

‘অথচ আজ তার কিছু নেই। আমার কাছে মজুরের মতো থাকে, আর তার স্ত্রী আমার ঘোটকীদের দুধ দোয় ।’

অতিথি সবিস্ময়ে জিভ দিয়ে চুক-চুক শব্দ করল। ঘাড় নাড়তে নাড়তে বলল, ‘সত্যি, ভাগ্য যেন চাকার মতো ঘোরে; একজন উপরে ওঠে তো আর একজন তলায় পড়ে যায়। আহা, বলুন তো, বুড়ো লোকটা এখন নিশ্চয়ই খুব বিষন্ন ?’

‘কী জানি, খুব চুপচাপ আর শান্ত হয়ে থাকে। কাজও করে ভালো ।’

অতিথি বলল, ‘লোকটির সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি কি ? জীবন সম্পর্কে ওকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে চাই আমি।’

গৃহস্বামী বলল, ‘নিশ্চয়ই পারেন।’ তারপর তাঁবুর বাইরে গিয়ে ডাকল : বাবাই, একবার এদিকে এসো তো। তোমার বুড়িকেও সঙ্গে নিয়ে এসো। আমাদের সঙ্গে একটু কুমিস পান করবে।’

ইলিয়াস আর তার স্ত্রী এল। ইলিয়াস অতিথি ও গৃহস্বামীকে নমস্কার করল, প্রার্থনা করল, তারপর দরজার পাশে এক কোণে বসল। তার স্ত্রী পর্দার আড়ালে গিয়ে কর্ত্রীর পাশে বসল।

ইলিয়াসকে এক বাটি কুমিস দেওয়া হলো। সে আবার অতিথি ও গৃহস্বামীকে মাথা নীচু করে নমস্কার করল এবং একটু খেয়ে বাকিটা নামিয়ে রাখল।

অতিথি তাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা বাবাই, আমাদের দেখে তোমার অতীত জীবনের সুখ-সমৃদ্ধির কথা স্মরণ করে এবং এখনকার দুরাবস্থার কথা ভেবে কি খুব কষ্ট হচ্ছে ?’

ইলিয়াস হেসে বলল, ‘সুখ-দুঃখের কথা যদি বলি, আপনারা হয়তো আমার কথা বিশ্বাস করবেন না। বরং আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করুন। তিনি মেয়েমানুষ, তাঁর মনেও যা মুখেও তাই। এ বিষয়ে তিনি পুরো সত্য বলতে পারবেন।’

অতিথি তখন পর্দার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আচ্ছা ঠাকমা, আগেকার সুখ আর এখনকার দুঃখ সম্পর্কে তোমার মনের কথাটা বলো তো !’

পর্দার আড়াল থেকে শাম-শেমাগি বলতে লাগল : ‘এই হল আমার মনের কথা : পঞ্চাশ বছর এই বুড়ো আর আমি একত্র বাস করেছি, সুখ খুঁজেছি; কিন্তু কখনও পাইনি। আর আজ এখানে এই আমাদের দ্বিতীয় বছর, যখন আমাদের কিছুই নেই, যখন আমরা ভাড়াটে মানুষের মতো বেঁচে আছি, তখন আমরা পেয়েছি সত্যিকারের সুখ; আজ আর কিছুই চাই না ।’

অতিথিরা বিস্মিত। গৃহস্বামীও বিস্মিত। সে উঠে দাঁড়াল। পর্দা সরিয়ে বুড়ির দিকে তাকাল। দুই হাত ভেঙে বসে সে স্বামীর দিকে চেয়ে হাসছে। স্বামীও হাসছে ।

বুড়ি আবার কথা বলল: ‘আমি সত্য কথাই বলছি, তামাশা করছি না। অর্ধ-শতাব্দী ধরে আমরা সুখ খুঁজেছি; যতদিন ধনী ছিলাম, কখনও সুখ পাইনি। কিন্তু আজ এমন সুখের সন্ধান আমরা পেয়েছি যে আর কিছুই আমরা চাই না ।’

‘কিন্তু এখন কীসে তোমাদের সুখ হচ্ছে ?’

‘বলছি। যখন ধনী ছিলাম, বুড়োর বা আমার এক মুহূর্তের জন্যও শান্তি ছিল না, —কথা বলবার সময় নেই। অন্তরের কথা ভাববার সময় নেই, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করবার সময় নেই। দুশ্চিন্তারও অন্ত ছিল না। হয়তো অতিথিরা এলেন— এক দুশ্চিন্তা : কাকে কী খেতে দিই, কী উপহার দিই যাতে লোকে নিন্দা না করে। আবার অতিথিরা চলে গেলে মজুরদের দিকে নজর দিতে হয়; তারা যেমন কম খেটে বেশি খেতেই ব্যস্ত, তেমনি আমরাও নিজেদের স্বার্থে তাদের উপর কড়া নজর রাখি, —সেও তো পাপ। অন্যদিকে দুশ্চিন্তা— এই বুঝি নেকড়েতে ঘোড়ার বাচ্চা বা গোরুর বাছুরটা নিয়ে গেল। কিংবা চোর এসে ঘোড়াগুলোই নিয়ে সরে পড়ল। রাতে ঘুমাতে গেলাম, কিন্তু ঘুমোবার উপায় নেই, মনে দুশ্চিন্তা— ভেড়ি বুঝি ছানাগুলোকে চেপে মেরে ফেলল। ফলে সারারাত ঘুমই ছিল না। একটা দুশ্চিন্তা পেরোতেই আর একটা এসে মাথা চাড়া দিত, —শীতের জন্য যথেষ্ট খড় মজুত আছে তো ! এছাড়া বুড়োর সঙ্গে মতবিরোধ ছিল; সে হয়তো বলল এটা এভাবে করা হোক, আমি বললাম অন্যরকম। ফলে ঝগড়া। সেও তো পাপ। কাজেই এক দুশ্চিন্তা থেকে আর এক দুশ্চিন্তায়, এক পাপ থেকে আর এক পাপেই দিন কাটত, সুখী জীবন কাকে বলে কোনোদিন বুঝিনি।’

‘আর এখন ?’

‘এখন বুড়ো আর আমি একসঙ্গে সকালে উঠি, দুটো সুখ-শান্তির কথা বলি। ঝগড়াও কিছু নেই, দুশ্চিন্তাও কিছু নেই, —আমাদের একমাত্র কাজ প্রভুর সেবা করা। যতটা খাটতে পারি স্বেচ্ছায়ই খাটি, কাজেই প্রভুর কাজে আমাদের লাভ বই লোকসান নেই। বাড়িতে এলেই খাবার ও কুমিস পাই। শীতকালে গরম হবার জন্য লোমের কোর্ট আছে, জ্বালানি আছে। আত্মার কথা আলোচনা করবার বা ভাববার মতো সময় আছে, সময় আছে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করবার। পঞ্চাশ বছর ধরে সুখ খুঁজে খুঁজে এতদিনে পেয়েছি।’

অতিথিরা হেসে উঠল। কিন্তু ইলিয়াস বলল, ‘বন্ধুগণ হাসবেন না। এটা তামাশা নয়। এটাই মানুষের জীবন, আমার স্ত্রী আর আমি অবুঝ ছিলাম, তাই সম্পত্তি হারিয়ে কেঁদেছিলাম। কিন্তু ঈশ্বর আমাদের কাছে সত্যকে উন্মুক্ত করেছেন। আর সে কথা যে আমরা আপনাদের বললাম তা ফুর্তির জন্য নয়, আপনাদের কল্যাণের জন্য।’

তখন মোল্লা বললেন :

‘এটা খুবই জ্ঞানের কথা। ইলিয়াস যা বলল সবই সত্য এবং পবিত্র গ্রন্থে লেখা আছে।’

শুনে অতিথিরা ভাবতে বসল।

(সম্পাদিত)
তরজমা : মণীন্দ্র দত্ত

ইলিয়াস গল্পের বিষয় সংক্ষেপঃ

পশ্চিম রাশিয়ার উফা প্রদেশে বাস্কির গোষ্ঠীভুক্ত ইলিয়াস নামে এক ব্যক্তি বাস করত। ইলিয়াসের বিয়ের এক বছর পর যখন তার বাবা মারা যান, তিনি খুব বেশি সম্পত্তি রেখে যেতে পারেননি। কিন্তু ইলিয়াসের বুদ্ধিতে এবং স্বামী-স্ত্রীর কঠোর পরিশ্রমে ক্রমশ তাদের অবস্থার উন্নতি হতে থাকে। পঁয়ত্রিশ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে দুশো ঘোড়া, দেড়শো গোরু-মোষ, বারোশো ভেড়ার মালিক হয়ে ওঠে ইলিয়াস। দূরদূরান্ত থেকে আসা অতিথিদের আগমনে ইলিয়াসের প্রাসাদ গমগম করত। ইলিয়াসের প্রতিপত্তি বৃদ্ধিতে প্রতিবেশীরা তাকে হিংসা করতে শুরু করে।

ইলিয়াসের দুই ছেলে ও এক মেয়ে ছিল। তাদের সকলেরই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। ইলিয়াস বড়োলোক হওয়ার পর ধনসম্পত্তির অহংকারে তার ছেলেরা বিলাসী ও অলস হয়ে ওঠে। এইসময় তার বড়ো ছেলে একটি মারামারির ঘটনায় মারা যায়। ছোটো ছেলের বউও খুব ঝগড়াটে হওয়ায় ইলিয়াস তাদের সম্পত্তির ভাগ দিয়ে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়।

পরবর্তীকালে মড়ক, দুর্ভিক্ষ এবং কিরবিজদের অত্যাচারে ক্রমশ ইলিয়াসের সম্পত্তি কমতে থাকে। সত্তর বছর বয়সে ইলিয়াস বাধ্য হয়েই তার শেষ সম্বল পশমের কোর্ট, কম্বল, ঘোড়ার জিন, তাঁবু এবং গৃহপালিত পশুগুলি বিক্রি করে সর্বহারা হয়ে পড়ে। ইতিমধ্যে ইলিয়াসের বিতাড়িত পুত্রও অনেক দূরদেশে চলে যায়। আবার তাদের মেয়েটি মারা যাওয়ায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে সাহায্যের কেউ থাকে না। তাই শেষ সম্বলটুকু নিয়ে ইলিয়াস ও তার স্ত্রী শাম-শেমাগি অচেনা এক ব্যক্তির বাড়িতে আশ্রয় নেয় এবং তাদের বাড়িতে মজুর হিসেবে কাজকর্ম করে কোনোরকমে দিন কাটায়। মহম্মদ শা নামে ইলিয়াসের এক প্রতিবেশী ছিল। তার অবস্থা খুব সচ্ছল না হলেও সে ভালো মনের মানুষ ছিল। ইলিয়াসের আতিথ্যের কথা মনে করে সে বৃদ্ধ ইলিয়াস দম্পতিকে নিজের বাড়িতে কাজের বিনিময়ে আশ্রয় দেয়। মহম্মদ শা-র এই উপকারের বিনিময়ে বৃদ্ধ ইলিয়াস ও তার স্ত্রী তাদের সাধ্যমতো পরিশ্রম করত।

একদিন মহম্মদ শা-র বাড়িতে এক ধর্মপ্রাণ মোল্লাসাহেব সহ কিছু অতিথি আসেন। মহম্মদ শা তাঁদের আপ্যায়নের ফাঁকেই বৃদ্ধ ইলিয়াসকে দেখিয়ে অতিথিদের জানায় যে ইলিয়াস একসময় তাদের এলাকার ধনী ও অতিথিপরায়ণ ব্যক্তি ছিল। সেসময় তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল দূরদূরান্তে। বর্তমানে ইলিয়াস ও তার স্ত্রী সর্বহারা হয়ে তার বাড়িতেই মজুরের কাজ করে। এ কথা শুনে অতিথি খুব অবাক হয়ে জানান যে ভাগ্যের চাকা কাউকে ওপরে ওঠায় আবার কাউকে নীচে নামায়। বৃদ্ধ ইলিয়াসের সঙ্গে অতিথিরা কথা বলে তার অতীত জীবনের সুখসমৃদ্ধি এবং বর্তমান দুরবস্থায় তার মানসিক অবস্থার কথা জানতে চান। ইলিয়াস জানায় যে এই বিষয়ে তার স্ত্রী শাম-শেমাগি সম্পূর্ণ সত্যটা বলতে পারবে।

প্রশ্নের উত্তরে শাম-শেমাগি বলে তারা পঞ্চাশ বছরের ধনী জীবন কাটালেও সেই সময় সুখের সন্ধান পায়নি। কিন্তু বর্তমানে সর্বহারা ভাড়াটে মজুর হয়েও তারা যে সুখ পেয়েছে তারপর তাদের জীবনে আর কিছু চাই না। বৃদ্ধা আরও বলে যে যখন তারা ধনী ছিল তখন তাদের মনে এক মুহূর্তের জন্যও শান্তি ছিল না, মনের কথা বলার বা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনার সময়ও ছি না। সর্বদা পাপবোধ এবং দুশ্চিন্তায় তাদের দিন কাটত। কিন্তু এখন তাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অন্তরের কথা আলোচনা হয়, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনার সময়ও এখন তাদের রয়েছে। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর মনিবের জীবন কাটালেও এখনই তারা প্রকৃত সুখের হদিস পেয়েছে।

এ কথা শুনে অতিথিরা হেসে উঠলে ইলিয়াস বলে এটাই জীবনের সারসত্য। সম্পত্তির মোহে অন্ধ ছিল বলে তারা সম্পত্তি হারিয়ে কেঁদেছিল। কিন্তু ঈশ্বর তাদের সম্পত্তিহারা করলেও জীবনের প্রকৃত সত্য ও সুখের হদিস দিয়েছেন।

এ কথা শুনে মোল্লাসাহেব বলেন যে ইলিয়াসের সকল কথাই সত্য এবং জ্ঞানের কথা। এগুলি পবিত্র গ্রন্থে লেখা আছে। মোল্লা সাহেবের কথা শুনে অতিথিরা চিন্তামগ্ন হলেন।

ইলিয়াস গল্পের নামকরণঃ

যে কোনো সাহিত্যকর্মের ক্ষেত্রেই নামকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নামের মধ্য দিয়েই সাহিত্যের মূল ভাবটি পাঠকের কাছে স্পষ্ট হয়। যে-কোনো সাহিত্যকর্মেই সাধারণত ঘটনা বা চরিত্র অনুযায়ী কিংবা ব্যঞ্জনাধর্মী নামকরণ হয়ে থাকে। লিও তলস্তয় রচিত গল্পটির ইলিয়াস নামটি স্পষ্টতই চরিত্রকেন্দ্রিক।

গল্পের নাম-চরিত্রই এখানে গল্পের মুখ্য চরিত্র যাকে কেন্দ্র করে কাহিনি বিস্তার লাভ করেছে। একজন সাধারণ বাসকির ইলিয়াস কঠোর পরিশ্রমে এবং বুদ্ধির দ্বারা ক্রমশ ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হয়। পঁয়ত্রিশ বছরের নিরলস প্রচেষ্টায় অর্জিত সুনামের কারণে দূরদূরান্তে ইলিয়াসের প্রতিপত্তির কথা ছড়িয়ে পড়ে। ইলিয়াস ছিল অতিথিপরায়ণ মানুষ। তার বাড়িতে আসা অতিথিদের সে আন্তরিকতার সঙ্গে খাতির-যত্ন করত। কিন্তু ভাগ্যের নিদারুণ পরিহাসের কারণে সর্বহারা হয়ে পড়ে তারা। ফলস্বরূপ ইলিয়াস দম্পতি মহম্মদ শা নামক এক প্রতিবেশীর বাড়িতে কাজের বিনিময়ে আশ্রয় ও খাবার পায়। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের ধনী বিলাসবহুল জীবন কাটিয়েও যে সুখ ইলিয়াস ও তার স্ত্রী পায়নি, ভাড়াটে মজুরের জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে তারা সেই সুখের সন্ধান পায়। নিজের জীবনের এই আচমকা পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই ইলিয়াস প্রকৃত সত্য জানতে পারে। তাই সে অকপটে স্বীকার করেছে যে, সে এবং তার স্ত্রী সম্পত্তির মোহে অন্ধ ছিল বলেই সম্পত্তি হারিয়ে কেঁদেছিল।

কিন্তু ভাড়াটে মজুরের জীবনেই ঈশ্বর তাদের কাছে জীবনের প্রকৃত সত্যকে তুলে ধরেছেন। নিজের জীবন থেকে পাওয়া শিক্ষা বা জীবনদর্শনের সন্ধান ইলিয়াস সমস্ত অতিথিদের দান করেছে এবং পাঠকের কাছেও তা মহৎ দৃষ্টান্তে পরিণত হয়েছে। বাবার মৃত্যুর পর ইলিয়াসের জীবনসংগ্রামের ঘটনা দিয়েই গল্পের শুরু। আবার শেষে ইলিয়াসের জীবনসংগ্রাম থেকে পাওয়া জীবনদর্শনেই গল্পের পরিণতি। তাই সব দিক বিচার করে গল্পের চরিত্রকেন্দ্রিক নামকরণটি যে সার্থক, তা বলাই যায়।

ইলিয়াস গল্পের শব্দার্থ

» প্রদেশ— অঞ্চল
» ঘোটকী— স্ত্রী ঘোড়া
» ভাড়াটে— ভাড়া খাটে এমন
» মজুর— শ্রমিক
» বোলবোলাও— প্রতিপত্তি, প্রভাব
» ঈর্ষা— হিংসা
» ক্রমে— একে একে
» ভোজ্য— খাদ্য
» পানীয়— তরল খাবার
» মড়ক— মহামারি, রোগের কারণে ক্রমাগত মৃত্যু
» দুর্ভিক্ষ— খাবারের অভাব
» কিরবিজ— এক ধরনের জাতি
» তাঁবু— অস্থায়ীভাবে থাকার জন্য কাপড়ের আচ্ছাদন
» দুর্দশা— খুব খারাপ অবস্থা
» সম্বল— একমাত্র অবলম্বন
» কুমিস— ভেড়ার দুধ ফেনিয়ে তৈরি করা এক ধরনের ঘন পানীয়
» সর্বহারা— সব কিছু হারিয়েছে যার
» বোঁচকা— পোঁটলা
» বিতাড়িত— তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে যাকে
» দম্পতি— স্বামী ও স্ত্রী
» দুইতে— দোহন করতে অলস:
» তল্লাট— অঞ্চল
» সবিস্ময়ে— বিস্ময়ের সাথে, অবাক হয়ে
» বিষণ্ণ— বিষাদগ্রস্ত
» গৃহস্বামী— গৃহের কর্তা
» মজুত— জমা
» মাখন— দুধ থেকে তৈরি খাবার বিশেষ
» ঘোড়ার জিন— ঘোড়ার পিঠে বসবার জন্য তৈরি আসন
» অর্ধশতাব্দী— পঞ্চাশ বছর

Leave a Reply