বোঝাপড়া কবিতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিষয় বস্তু, MCQ প্রশ্নোত্তর | Bojha pora Question Answer

WhatsApp Channel Join Now
Telegram Group Join Now

বোঝাপড়া —রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

মনেরে আজ কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে।
কেউ বা তোমায় ভালোবাসে
কেউ বা বাসতে পারে না যে,
কেউ বিকিয়ে আছে,
কেউ বা সিকি পয়সা ধারে না যে,
কতকটা যে স্বভাব তাদের
কতকটা বা তোমারো ভাই,
কতকটা এ ভবের গতিক—

সবার তরে নহে সবাই।
তোমায় কতক ফাঁকি দেবে
তুমিও কতক দেবে ফাঁকি,
তোমার ভোগে কতক পড়বে
পরের ভোগে থাকবে বাকি,
মান্ধাতারই আমল থেকে
চলে আসছে এমনি রকম—
তোমারো কি এমন ভাগ্য
বাঁচিয়ে যাবে সকল জখম!
মনেরে আজ কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে।

অনেক ঝঞ্ঝা কাটিয়ে বুঝি
এলে সুখের বন্দরেতে,
জলের তলে পাহাড় ছিল
লাগল বুকের অন্দরেতে,
মুহূর্তেকে পাঁজরগুলো
উঠল কেঁপে আর্তরবে—
তাই নিয়ে কি সবার সঙ্গে
ঝগড়া করে মরতে হবে?
ভেসে থাকতে পার যদি
সেইটে সবার চেয়ে শ্রেয়,
না পার তো বিনা বাক্যে
টুপ করিয়া ডুবে যেও।
এটা কিছু অপূর্ব নয়,
ঘটনা সামান্য খুবই
শঙ্কা যেথায় করে না কেউ
সেইখানে হয় জাহাজ-ডুবি।
মনেরে তাই কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে।

তোমার মাপে হয় নি সবাই
তুমিও হও নি সবার মাপে,
তুমি মর কারো ঠেলায়
কেউ বা মরে তোমার চাপে-
তবু ভেবে দেখতে গেলে
এমনি কিসের টানাটানি ?
তেমন করে হাত বাড়ালে
সুখ যায় অনেকখানি।
আকাশ তবু সুনীল থাকে,
মধুর ঠেকে ভোরের আলো,
মরণ এলে হঠাৎ দেখি
মরার চেয়ে বাঁচাই ভালো।
যাহার লাগি চক্ষু বুজে
বহিয়ে দিলাম অশ্রুসাগর
তাহারে বাদ দিয়েও দেখি
বিশ্বভুবন মস্ত ডাগর।
মনেরে তাই কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে।

নিজের ছায়া মস্ত করে
অস্তাচলে বসে বসে
আঁধার করে তোল যদি
জীবনখানা নিজের দোষে,
বিধির সঙ্গ বিবাদ করে
নিজের পায়েই কুড়ুল মার,
দোহাই তবে এ কার্যটা
যত শীঘ্র পার সারো।
খুব খানিকটে কেঁদে কেটে
অশ্রু ঢেলে ঘড়া ঘড়া
মনের সঙ্গ এক রকমে
করে নে ভাই, বোঝাপড়া।
তাহার পরে আঁধার ঘরে
প্রদীপখানি জ্বালিয়ে তোলো—
ভুলে যা ভাই, কাহার সঙ্গে
কতটুকুন তফাত হল।
মনেরে তাই কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে।

কবি পরিচিতিঃ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১–১৯৪১) : জন্ম কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত ভারতী ও বালক পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। কথাকাহিনী, সহজপাঠ, রাজর্ষি,ছেলেবেলা, শিশু, শিশু ভোলানাথ, হাস্যকৌতুক, ডাকঘর প্রভৃতি রচনা শিশু ও কিশোর মনকে আলোড়িত করে। দীর্ঘ জীবনে অজস্র কবিতা, গান, ছোটোগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ লিখেছেন, ছবি এঁকেছেন। ১৯১৩ সালে Song Offerings-এর জন্য এশিয়ার মধ্যে তিনিই প্রথম নোবেল পুরস্কার পান। দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র ভারত ও বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত তাঁর রচনা। পাঠ্য কবিতাটি তাঁর ক্ষণিকা কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।

• শব্দার্থ ও টীকা।

১.বােঝাপড়া— সমঝােতা, মীমাংসা
২.কহ— বলাে
৩.সত্যরে— যা ঠিক
৪.লও— গ্রহণ করাে
৫.সহজে— (এখানে) স্পষ্ট, বুঝতে কষ্ট হয় না এমন
৬.বিকিয়ে— বিক্রি হয়ে গিয়ে, (এখানে) বশ্যতা বা আনুগত্য স্বীকার করে
৭.সিকি পয়সা— চার আনা মূল্যের মুদ্রা / চারভাগের এক ভাগ
৮.ধারে না— ধার করেনি, ঋণী নয়
৯.ভবের— পৃথিবীর
১০.গতিক— নিয়ম
১১.তরে— জন্যে
১২.ভােগে— ব্যবহারে
১৩.মান্ধাতা— পুরাণ অনুসারে সূর্যবংশের অতি প্রাচীন একজন রাজা। অতি প্রাচীন কাল বােঝাতে চাইলে ‘মান্ধাতার আমল’ বলা হয়।
১৪.মান্ধাতার আমল— সুপ্রাচীন কাল, রাবণ রাজার সমসাময়িক মান্ধাতার যোগ বা অতি প্রাচীনকাল
১৫.জখম— আঘাত
১৬.ঝঞ্ঝা— ঝড়
১৭.বন্দরেতে— সমুদ্র বা বড়াে নদীর তীরবর্তী যে জায়গায় জাহাজ বা নৌকা
এসে দাঁড়ায় সেখানে
১৮.অন্দরেতে— ভিতরে
১৯.পাঁজর— বুকের বাম পাশের হাড়, পঞ্জর
২০.আর্তরবে— কাতর ধবনিতে
২১.শ্রেয়— উপযুক্ত, সংগত
২২.অপূর্ব— যা আগে কখনও হয়নি
২৩.শঙ্কা— ভয়
২৪.সুনীল— গাঢ় নীল
২৫.মাপে— (এখানে) উপযুক্ত হয়ে, মানানসই হয়ে, করো মতো না হয়ে
২৬.মধুর— খুব মিষ্টি, মনােহর
২৭.ঠেকে— মনে হয়
২৮.লাগি— জন্য
২৯.অশ্রুসাগর— অনেক পরিমাণ চোখের জল
৩০.বিশ্বভুবন— পৃথিবী
৩১.মস্তো— অনেক বড়াে,বিশাল
৩২.ডাগর— বিরাট, প্রকাণ্ড,বড়ো
৩৩.অস্তাচল— সূর্য যেখানে ডুবে যায়, (এখানে) জীবনের হতাশাজনক পরিস্থিতি
৩৪.আঁধার— অন্ধকার
৩৫.বিধির— ভাগ্যের, বিধাতার
৩৬.বিবাদ— ঝগড়া
৩৭.দোহাই— কারওর নাম নিয়ে শপথ বা দিব্যি, (এখানে) মিনতি
৩৮.কাৰ্যট— কাজটা
৩৯.শীঘ্র— তাড়াতাড়ি
৪৯.সারাে— শেষ করাে
৪১.খানিকটে— কিছুটা
৪২.অশ্রু— চোখের জল
৪৩.ঘড়া— বড়াে আকারের কলশ
৪৪.তফাত— পার্থক্য
৪৫.মন্দ— (এখানে) খারাপ অবস্থা

উৎসঃ

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘বোঝাপড়া’ কবিতাটি তাঁর ‘ক্ষণিকা’ কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।

সারাংশঃ

কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত বোঝাপড়া কবিতায় তিনি বলেছেন, জীবনে ভালােমন্দ যাই আসুক না কেন, আমাদের তা মেনে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। প্রতিটি মানুষের স্বভাব ও চরিত্র আলাদা। তাদের সামাজিক পরিচয়ও হয় ভিন্ন ভিন্ন। পরিস্থিতির চাপে আমরা অনেক সময় অন্যদের সঙ্গে আশানুরূপ ব্যবহার করতে পারি না। স্বার্থের কারণে কখনও আমরা অন্যদের ঠকাই আবার কখনও অন্যদের কাছে ঠকে যাই। এইভাবে সুদূর অতীত থেকেই চলে আসছে অল্পবিস্তর মেনে নেওয়া ও মানিয়ে নেওয়ার পালা। একে এড়িয়ে যাওয়া আমাদের কারাের পক্ষেই সম্ভব নয়।
বহু ঝড়-ঝঞ্জা পেরিয়ে জীবনে সুখ পাওয়া যায়। কোথায়, কীভাবে আঘাত আসে কেউ বলতে পারে না।সুতরাং, দুঃখ-ভারাক্রান্ত মনে থাকা ঠিক নয় বরং সমস্ত কিছু সহ্য করে টিকে থাকাই শ্রেয়। মনের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে সুন্দরের সন্ধান করাই জীবনের সাধনা। মনকে বোঝাতে হবে, ভালোমন্দ যা-ই আসুক সহজভাবে সব কিছু গ্রহণ করতে হবে। তাহলে জীবন হবে সহজ, সরল ও সুন্দর।

নামকরণঃ

“নামকে যাহারা নামমাত্র বলিয়া মনে করেন, আমি তাহাদের দলে নই” প্রকৃতপক্ষেই রবীন্দ্রনাথ নামকরণের বিশেষত্বে বিশ্বাসী। তাই তিনি স্বয়ংই আলােচ্য কবিতাটির নামকরণ করেছেন ‘বােঝাপড়া। মনই আমাদের পরিচালক, তাই আমাদের আচরণের মধ্য দিয়েই মনের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। প্রদত্ত কবিতায় কবি সেই মনের সঙ্গে মানুষের বােঝাপড়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন ।

বিপদের সময় আমাদের মনকে দুর্বল করে, বিপথে চালনা করে। কিন্তু কবি চেয়েছেন, দুঃখের মাঝেও আমাদের মনকে বােঝাতে, সত্যের সরল শক্তিকে আঁকড়ে ধরতে।

তবে চঞ্চলা মনের ধর্মই হল ক্ষুধা, তৃয়া ও ঘুমের মতাে ঈর্ষা, ফাঁকি, ঘৃণা প্রভৃতির আকর্ষণে সাড়া দেওয়া। অনাদর্শের হাতছানি, লােভের বাঁধনে মন বাঁধা পড়ে। তার মাঝেও মনের সঙ্গে আমাদের দ্বন্দ্ব করতে হবে, সত্যকে কোনাে মতেই অস্বীকার করা চলবে না। মনকে আরও বােঝাতে হবে, ভালােবাসার দরজা খুলে, বিভেদের প্রাচীর ভুলে, সংগ্রামের দ্রুত তালে তাকে হাঁটতে হবে। এইভাবে কবি আমাদের সামাজিক অবস্থায় মানসিক দ্বন্দ্বকে তুলে ধরেছেন। এই মানসিক দ্বন্দ্বের মধ্যে সমাজ-বর্ণনা ও সত্যপ্রতিষ্ঠার বােঝাপড়া নামকরণটিকে সার্থক করে তুলেছে। অর্থাৎ, নামকরণটি ব্যঞ্জনাধর্মী হয়ে উঠেছে।

MCQ প্রশ্নোত্তর—

১. বোঝাপড়া কবিতাটি লিখেছেন—
(ক) সুকুমার রায় (খ) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
(গ) সুকান্ত ভট্টাচার্য (ঘ) বিনয় ঘোষ

উত্তরঃ (খ) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

২.বোঝাপড়া কবিতাটি নেওয়া হয়েছে যে কাব্যগ্রন্থ থেকে—
(ক) বলাকা (খ) গীতাঞ্জলি (গ) পত্রপুট
(ঘ) ক্ষণিকা

উত্তরঃ (ঘ) ক্ষণিকা

৩.বোঝাপড়া কবিতাই কবি ঝঞ্জা কেটে জীবনে _________ আসার কথা বলেছেন।
(ক) দুঃখ (খ) কষ্ট (গ) সুখ (ঘ) বন্ধুত্ব

উত্তরঃ (গ) সুখ

৪.মুহূর্তেকে __________ উঠলো কেঁপে আর্তরবে—
(ক) পাঁজর গুলো (খ) হৃৎপিণ্ড
(গ) মানুষগুলো (ঘ) হৃদয় খানা

উত্তরঃ (ক) পাঁজর গুলো

৫.শঙ্কা যেথায় করে না কেউ সেইখানে হয় _____________।
(ক) বিপদ (খ) জাহাজডুবি (গ) বাঘের দেখা (ঘ) ভরাডুবি

উত্তরঃ (খ) জাহাজডুবি

৬. “যাহার লাগি চক্ষু বুজে বহিয়ে দিলাম ________।
(ক) অশ্রুনদী (খ) অশ্রুসাগর (গ) দুখের সাগর (ঘ) রক্তনদী

উত্তরঃ (খ) অশ্রুসাগর

৭. “নিজের ছায়া মস্ত করে _________ বসে বসে”।
(ক) পূর্বাচলে (খ) অচলে (গ) অস্তাচলে
(ঘ) পশ্চিমাচলে

উত্তরঃ (গ) অস্তাচলে

৮. “জীবনখানা নিজের দোষে, __________ বিবাদ করে।”
(ক) বিধির সঙ্গে (খ) ভগবানের সঙ্গে
(গ) ঈশ্বরের সঙ্গে (ঘ) মানুষের সঙ্গে

উত্তরঃ (ক) বিধির সঙ্গে

৯. বিধির সঙ্গে বিবাদ করে মানুষ নিজের পায়ে যা মারে তা হল—
(ক) কোদাল্য(খ) হাতুড়ি্য(গ) খাঁড়া (ঘ) কুড়ুল

উত্তরঃ (ঘ) কুড়ুল

১০. ভালো-মন্দ যাহাই আসুক _________ লও সহজে।
(ক) সত্যেরে (খ) জীবনকে (গ) সুন্দরকে (ঘ) দুঃখেরে

উত্তরঃ (ক) সত্যেরে

১১. “কেউ বা মরে তোমার ___________।
(ক) দুঃখে (খ) জ্বালায় (গ) অত্যাচারে (ঘ) চাপে

উত্তরঃ (ঘ) চাপে।

১২. “আকাশ তবু ________ থাকে”
(ক) উদার (খ) সুনীল (গ) মাধুর্য (ঘ) বিশাল

উত্তরঃ (খ) সুনীল।

১৩. “তাহারে বাদ দিয়েও দেখি / বিশ্বভুবন মস্ত ডাগর।”-কাকে বাদ দিয়ে ?
(ক) যার জন্য মনে আনন্দ ছিল না।
(খ) যে অনেক ফাঁকি দিয়েছে
(গ) যার জন্য অশ্রুসাগর বইয়ে দেওয়া হয়েছে
(ঘ) যার জন্য অশ্রু জমা হয়ে রয়েছে

উত্তরঃ (গ) যার জন্য অশ্রুসাগর বইয়ে দেওয়া হয়েছে।

১৪. আঁধার করে তোলো যদি / নিজের _________ দোষে।
(ক) মনটা (খ) চারপাশটা (গ) জীবন খানা (ঘ) পৃথিবীটা

উত্তরঃ (গ) জীবন খানা।

১৫. __________থাকতে পারো যদি / সেইটে সবার চেয়ে শ্রেয়।
(ক) দাঁড়িয়ে (খ) ভেসে (গ) শুয়ে (ঘ) বসে

উত্তরঃ (খ) ভেসে।

This Post Has One Comment

Leave a Reply