আগুন নাটক – বিজন ভট্টাচার্য | Aagun Natok – Bijon Bhattacharya
আগুন নাটক – বিজন ভট্টাচার্য একাদশ শ্রেণি বাংলা দ্বিতীয় সেমিস্টার | Aagun Natok – Bijon Bhattacharya Class 11 Bengali 2nd Semester wbbse
1. একাদশ শ্রেণির বাংলা সিলেবাস ও প্রশ্ন প্যাটার্নClick Here
2. একাদশ শ্রেণির বাংলা সমস্ত অধ্যায়ের প্রশ্নোত্তর Click Here
3. একাদশ শ্রেণির সমস্ত বিষয়ের মডেল প্রশ্নপত্র Click Here
নাটকের প্রেক্ষাপট : নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্যের প্রথম নাটক আগুন। নাটকের প্রেক্ষাপট পঞ্চাশের মন্বন্তর। একদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা, আরেকদিকে অসাধু ব্যবসায়ীদের কালোবাজারি- এই দুইয়ের পরিণতিতে বাংলার বুকে নেমে এসেছিল এক ভয়ঙ্কর মন্বন্তর। ১৩৫০ বঙ্গাব্দের এই দুর্ভিক্ষকে পঞ্চাশের মন্বন্তর আখ্যা দেওয়া হয়। সাধারণ কৃষিজিবি থেকে কারখানার শ্রমিক, এমনকি শহুরে মধ্যবিত্তদের পরিবারেও অন্নাভাব দেখা দিয়েছিল। আলোচ্য নাটকটি ১৯৪৩ খ্রীষ্টাব্দে রচিত হয়। আগুন নাটকটির অভিনয়ের মধ্য দিয়েই ভারতীয় গণনাট্য সংঘের পথ চলা শুরু হয়েছিল। আগুন একটি একাঙ্কিকা। পাঁচটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আপাত বিচ্ছিন্ন দৃশ্য নিয়ে একাঙ্কিকাটিকে নির্মাণ করা হয়েছে। তাঁর প্রথম নাটক সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বিজন ভট্টাচার্য লিখেছেন, “তদানীন্তন সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আগুন ছিল একটি পরীক্ষামূলক ক্ষুদ্র নাটিকা”।
মন্বন্তরের পটভূমিতে নিরন্ন মানুষের অসহায়তাকে মননশীল দৃষ্টিতে দেখেছেন নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য। ইংরেজ শাসিত ভারতবর্ষের পটভূমিতে কালোবাজারি, চোরাকারবারি, মহাজনদের স্বার্থপরতাকে নাট্যকার নিপুণ তুলির টানে অঙ্কন করেছেন। মধ্যবিত্ত মানুষের জীবন সংগ্রামকেও বাস্তবগ্রাহ্য করে তুলেছেন গণনাট্যের পুরোধা পুরুষ বিজন ভট্টাচার্য।
অন্নহীন, নিরন্ন মানুষদের সমাজের তথাকথিত উচ্চশ্রেণির মানুষেরা কীরূপ হেয় জ্ঞান করেন তার পরিচয় আমরা পাই এই নাটকে। আরো দেখতে পাই কীভাবে সামান্য চালের প্রত্যাশায় মানুষ ঠেলাঠেলি করে একান্ত বাধ্য হয়েই চাল সংগ্রহের লাইনে দাঁড়ায়। আর এই ঠেলাঠেলি করার ফলে নাটকের চতুর্থ পুরুষটিকে মহাজনের লোকেরা নৃসংশভাবে প্রহার করে। যখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, তখনই মানুষ ঘুরে দাঁড়াতে বাধ্য হয়। তাই মানুষেরা ঐক্যবদ্ধ হবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। তাদের কন্ঠে ধ্বনিত হয়- “এখন বাঁচতে হবে। বাঁচতে হলে মিলেমিশে থাকতে হবে, ব্যাস”।
প্রথম দৃশ্য
প্রত্যুষ কাল। অস্পষ্ট আলোয় কিছুই ভালো করে ঠাহর করা যাচ্ছে না। সাংসারিক টুকিটাকি জিনিসপত্তরগুলো দেখাচ্ছে আবছা আবছা। অপরিচ্ছন্ন পরিবেশের মাঝখানে দেখা যায় একটা মেটে জালা। তারই গা ঘেঁসে একটা বাঁশের আলনার ওপর দেখা যায় ঝুলন্ত দু-একখানা নোংরা কাপড়, একটা ছেঁড়া চট আর একখানা পুরোনো ছেঁড়া কাঁথা। মেঝের উপর জন তিনেক লোক কাপড় মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে ঘুমুচ্ছে। খুব অস্পষ্ট নীল আলোয় স্টেজের এক পাশে এদেরকে দেখা যাচ্ছে। একটা মোরগ ডেকে উঠল। একজন একটু নড়েচড়ে পাশ ফিরল। ঘুমের ঘোরে কে যেন আপন মনেই বিড়বিড় করে উঠে চুপ করে গেল। মোরগটা আবার ডেকে উঠল। একটু চুপচাপ। দূর গাঁয়ের আজানের শব্দও কানে ভেসে আসছে। একটা কাক ডানা ঝাপটে ডেকে উঠল। আবার একটু চুপচাপ। মোরগটা আবার ডেকে উঠল। একটু পরে একটা হাই তোলার শব্দ কানে এল। মনে হল কে যেন আড়মোড়াও ভাঙছে।
পুরুষ : (হাই তুলছে)। হা-া-া-উ-য়েঃ। (আড়মোড়া ভাঙল) ই-ঞ-ঞ-ঞ-ও-স্-… এইবার উঠতি হয়। আর শুয়ে থাকলি ওদিকি আবার সব গোলমাল হয়ে যাবেনে। বুঝিছো তো ঠেলাডা মণিচাঁদ কাল দেরিতে যাইয়ো একদম সেই নাইনির পেছনে। ওদিকি চাল পাতি পাতি সেই বেলা বারোডা। তাতেও আবার কথা আছে, চাল পাবা কি পাবা না। হয় তো পালেই না। কুড়োনের মা তো দ্যাখলাম কাল শুধু হাতে ফিরে আল্যো।
একটা বিড়ি ধরায় লোকটা শুয়ে শুয়ে। অস্পষ্ট আলোয় বিড়ির আগুনের আনাগোনা বেশ সুস্পষ্ট- এই নেত্য, বলি চিৎপাত হয়ে ঘুমোচ্ছিস যে বড় আরামে। এদিকি ফরসা হয়ে আল্যো খেয়াল আছে। উঠে পড়। উঠে পড়। চাল আজ আর পাতি হবে নানে দেহিসখেন।
আবার একটু চুপচাপ। লোকটা পাশ ফিরে শুয়ে বিড়ি টানে। হঠাৎ উঠে বসে গা ঝেড়ে -নাঃ, এই রহম ভাবে সময় নষ্ট করলিই হইছে আর কি! (পাশের ঘুমন্ত স্ত্রীলোকটির গায়ে ঠেলা মারে।) হ্যাদে ও নেত্যর মা, ওঠ এইবেলা। আর কত ঘুমুবি ক’ দিনি। কলমি শাক, দাঁতন কাঠি আর কলাটলা ঝা কিছু রাখিছিস খপ করে গোছায়ে নে। ঐগুলো বিক্রি করে শেষ পরে তো নাইনি গে চাল কিনবি। বাত সকালে যাবি ততই ভালো। নে উঠে পড়, আর দেরি করিস নে…কই। উঠলি নে এহনও। তো থাক শুয়ে তোরা, আমি চল্লাম। গামছাখানা বার দুয়েক ঝেড়ে কাঁধের ওপর ফেলে লোকটা ব্যস্তভাবে বেরিয়ে পড়ে। একটু পরেই উঠে বসে নেত্যর মা। নেত্যর গায়ে ঠেলা মেরে বলে
নেত্যর মা : নিতাই, নিতু! ও বাবা নেত্য। নে, উঠে পড় বাবা এইবেলা। একটা মোরগ ডেকে উঠল দূরে। একটা কুকুর ডাকছে শোনা যায়।
নেত্য : (আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে)। কি হইছে কি সকালবেলাই। আচ্ছা তাল হইছে রোজ সকালে। একটু ঘুমোনোর জো নেই। কী এক নাইনির তাল হইছে।
নেত্যর মা : ঘুমোসখন বাবা, ঘুমোসখন। দুপুরবেলা ঘুমোসখন। এখন চল নে উঠে পড় খপ করে। নেত্যর মা তাড়াতাড়ি ওর বাজারের সওদাগুলো একটা ঝুড়িতে গোটো করে আনে। কলমি শাগুলোর ওপর নেতার মা বার-দুয়েক জলের ছিটে দিয়ে দেয়। তারপর ছেলেকে নিয়ে দ্রুতপদে বেরিয়ে পড়ে।
দ্বিতীয় দৃশ্য
প্রথম দৃশ্যটা শেষ হতেই অস্পষ্ট নীল আলোর ফোকাসটা দ্বিতীয় দৃশ্যের ওপর এসে পড়ে। একখানা চালাঘর। সামনে একফালি উঠোন। ঘরের চৌকাঠের কাছে দাঁড়িয়ে একজন কৃষাণি। আর বাইরের খোলা জায়গাটায় দাঁড়িয়ে জনৈক কৃষাণ। খালি গা, হাঁটু পর্যন্ত কাপড় গুটানো। মাথায় গামছা ফেটা বাঁধা। হাতের কাস্তে দিয়ে পিঠ চুলকাচ্ছে।
কৃষাণ : এই আর কড়া দিন বউ, বুঝলি। তারপর কলেকষ্টে এই চৈতেলির ফসলগুলো মাচায় তুলতি পারলি হয়, কিছুদিনের মত নিশ্চিন্দি, কী বলিস।… ওমা, তা কথা কইতি কী হচ্ছে তোর, মুখপানে চাইয়্যে শুধু দাড়ায়ে আছিস। (ঈষৎ হেসে) ও রকম করে চাইস নে, সকাল বেলাই কাজ পণ্ড করিসনে বউ, এই কয়ে দেলাম।
বউ দুলে ওঠে
-এই চৈতেলির ফসলডা মাচায় তোলবো… না থাক, আর বলে কী হবে। মনে মনে এ পয্যন্ত তো কত কিছু করবো বলে ঠিক করলাম, পাল্লাম কই এখনতরি। দেখি…। আর কটা দিন একটু কষ্ট কর। (পেছন ফিরে একটু এগিয়ে গিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ায়) আর দ্যাক, একটু তাড়াতাড়ি ফিরিস। মাঠের থে ফিরে এসে ধড়ে যেন প্রাণ আর তিষ্ঠতি চায় না। তুই আসবি সেই দুটোয়, তারপর রাঁধবি। তারপর খাব। একটু তাড়াতাড়ি ফিরিস। কেষ্টর মার সঙ্গে সকাল সকাল গে নাইনির একেবারে পেরথমে দাঁড়াতি পারিস নে! বাইরে একটা গোরু হামলে উঠল। কৃষাণ গোরুকে লক্ষ করে বলে
-আরে রও যাই, মাঠে যাবার জন্যি একেবারে পাগল হয়ে উঠেচো এর মধ্যি। (বউ এর প্রতি) তা ওই কথা, বুঝলি। কেষ্টর মা-র সঙ্গে আগেভাগে গে নাইনির একেবারে সে পেরথমে দাঁড়াবি। (একটু হেসে) ফের আবার ওই রকম করে তাকাচ্ছিস মুখপানে।
প্রস্থান
তৃতীয় দৃশ্য
দৃশ্যান্তর হতেই নীল আলোর ফোকাসটা সট করে সরে গিয়ে অন্য দৃশ্যের ওপর গিয়ে পড়ে।
দূরে কলের ভোঁ শোনা যাচ্ছে। আর এদিকে ছোটো একটা বারান্দার ওপরে উবু হয়ে বসে আছে সতীশ। কারখানার জনৈক শ্রমিক। কাক ডাকছে সকালবেলা। ঘরের ভেতর ঘুমুচ্ছে সতীশের বউ, মেয়ে। তাদের দেখা যাচ্ছে না, সতীশ বারান্দার ওপর বসে আপন মনে বিড়ি টেনে চলেছে। খালি গা, মাথার চুল উস্কোখুস্কো-মজবুত শরীর। বিড়িটা শেষ করে ফেলে দিল তার সামনে। তারপর মাথার চুলের মধ্যে হাত গুঁজে বসল। একটু পরে ঘাড় বেঁকিয়ে ও তার ঘুমন্ত মেয়েকে লক্ষ করে বলে ওঠে
সতীশ আরে এ ফুলকি। ফুলকি উঠলি। বাপরে ঘুম! যে যেমনি মা তার তেমনি বেটী। কুম্ভকর্ণ আর বলে কাকে। সেই সাঁঝের বেলায় শুইছিস বিছানায়। (একটু কাশে)
একটু পরে সতীশ তার সহকর্মীকে ডাকে
আরে জুড়োন! জুড়োন উঠেছিস!
বাইরে থেকে উত্তর আসে-আরে বোল না বে।
-তা কি যাচ্ছিস নাকি কাজে ?
জুড়োন : আরে হাঁরে। তুই? তুই কারখানায় যাচ্ছিস না ?
সতীশ : আরে কারখানায় যাব না তো যাব কোন চুলোয়। কিন্তু এদিকে যে ভারি মুশকিলেই পড়লাম।
জুড়োন : মুশকিলটা সে কী হল?
সতীশ আরে সে কী বলব মুশকিলের কথা। তোর কী, একলা মানুষ, খাচ্ছিস দাচ্ছিস ফুর্তি করে ঘুরে বেড়াচ্ছিস। দু-চার পয়সা বেশি দিয়ে হয়তো হোটেলেই খেয়ে নিলি কিন্তু আমার যে সেটি হবার উপায় নেই। শালা এই চালডালের কী উপায় করি রে বোলতো!
জুড়োন : কেন রে। সে লাইনে দিচ্ছে না।
সতীশ : আরে দুত্তোর নিকুচি করল তোর লাইনের। লাইনে তো বরাবরই দিচ্ছে, কিন্তু সে আবার শুধু হাতে ফিরে ভি আসতে হচ্ছে। কাল সারাটা দিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফুলকি আর ওর মা তো শুধু হাতে ফিরে এসেছে। রাত্তিরে এসে শেষে মিস্ত্রির কাছ থেকে প’ দেড়েক চাল কর্জ লিয়ে এসে তো পিত্তি রক্ষে করি। এখন সকালবেলাই তো আবার পেটে আগুন লেগে গেছে। শালা খিধে পেটে লিয়ে কি কাজে যেতে মন লাগে। যেমন হয়েছে শালা কোম্পানি, তিনমাস হল রোজই চাল ডাল দিচ্ছে। শালা কী করতে ইচ্ছে করে বোল তো!
জুড়োন : তুই বুঝি কোম্পানির ভরসা করে আছিস। তা হলেই সে হয়েছে।
সতীশ : কেন বোলতো। এ তুই বলছিস কি। কোম্পানির ভরসা করব না, দোকানের ভরসা করব না, সে গাঁটের পয়সার ভি ভরসা করব না, তো কাকে ভরসা করি বোল!… শালা কারবারে ঘেন্না ধরিয়ে দিলে।
হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে
হেই ফুলকি আরে নিকুচি কোরলো তোর ঘুমের। বলি তোদের ঘুমের জন্যে কি কারখানার গেট খোলা থাকবে নাকি? সেই কবে থেকে ডাকছি। বলছি কি আছে দে দুটো খেয়ে বেরিয়ে পড়ি। যেয়ে ঠেলতে হবে তো আবার ঘানি সারা দিনমান।
ফুঁসে ওঠে ওর বউ ক্ষিরি
ক্ষিরি : ঠেলতে হবে তা মেয়েমানুষ কী করবে শুনি? নিজে হাতে করে আনলে তো কাল দেড় প’ চাল কর্জ করে। তার ভেতরে এক প’ চালের ভাত তো নিজেই খেলে। এখন সকালবেলাই তোমার পিন্ডি জোগাই কোথেকে বলতো। খামকা চেঁচাচ্ছ ভোরবেলা।
সতীশ : ও, খামকা চেঁচাচ্ছি দেখলি তুই! তোর ক্ষিরি আজকাল বড়ো ট্যাকট্যাকানি কথা হয়েছে। তোর সে মুখের সাজা কিন্তু আমি একদিন আচ্ছা করে দিয়ে দেব।
ক্ষিরি : (উত্তেজিত হয়ে)। কী বাকি রেখেচ। পরনে নেই কাপড়, পেটে নেই ভাত, বড়ো সুখেই রেখেচ। আবার লম্বা চওড়া কথা। লজ্জা করে না। পুরুষমানুষ তোমাকেই এই পেরথম দেখলাম। দেখে এসোগে, কেলোর বাবা কেলোর মাকে কী হালে রেখেছে। কী আমার পুরুষমানুষ রে!
সতীশ : দেখ, মুখ সামলে কথা বলিস ক্ষিরি, এই বলে দিলাম। নইলে… (লাথি মারল।)
ক্ষিরি : (আর্তনাদ)। ওরে বাপরে গেলাম গো, মেরে ফেললে গো… (ফুলকিও কেঁদে ওঠে।)
সতীশ : তোর মুখের সাজা আমি আজ ভালো করে দিয়ে যাব। হারামজাদি।
মা-মেয়ের সমবেত চিৎকার শোনা যেতে থাকে।
যা, মরগে যা।
ছিটের হাফ শার্ট চাপিয়ে কাঁধের ওপর গামছা ফেলে সতীশের বেগে প্রস্থান।
চতুর্থ দৃশ্য
নীল আলোর ফোকাসটা এবার আরও একটু উজ্জ্বল মনে হয়। সট করে ফোকাসটা দৃশ্যান্তরের ওপরে গিয়ে পড়ে।
মধ্যবিত্ত পরিবার। একটুখানি পরিচ্ছন্ন সুস্থ পরিবেশ। অন্তপুরের দৃশ্য। কেরানি হরেকৃষ্ণবাবু স্ত্রী মনোরমার সঙ্গে কথা কইছেন।
হরেকৃষ্ণ : চা নেই, চিনি নেই, চাল নেই, খালি আছে চুলোটা। তাও আবার কয়লার অভাব। কী করি বলতো!
মনোরমা : দেখ বাপু, আজ আবার একটু কষ্ট কর। ভোঁদার কাছে শুনলুম আজ নাকি দু সের করে দেবে।
হরেকৃষ্ণ : আহা দেবে তো বুঝলাম, কিন্তু যাই কখন বলতো। এদিকে বেলা দশটার মধ্যে অফিস, আর তোমার সেই লাইনে বেলা বারোটার এধারে তো কিছু পাবার আশা নেই। আর তাও যে পাব তারও কোনো স্থিরতা নেই। দোকানি হয়তো শেষকালে হাত উলটে বলবে-ফুরিয়ে গেছে।…মহা মুশকিলেই পড়া গেল দেখছি।
মনোরমা : কেন, অফিস থেকে যে চাল ডাল দেবার কথা ছিল।
হরেকৃষ্ণ থাক, আর অফিসের কথা তুলো না বাপু। একেবারে ঘেন্না ধরিয়ে দিলে।
মনোরমা : কেন, এই না শুনলুম তোমার মুখ থেকে সেদিন যে অফিস থেকে বাবুদের সব দেওয়া থোওয়ার ব্যবস্থা হবে, তার কী হল!
হরেকৃষ্ণ : (বিরক্ত হয়ে)। সে সব কেলেঙ্কারির কথা আর বোলো না গিন্নি। বাবুদের নামে শস্তা দরে চাল ডাল এনে কর্তারা আবার সেগুলো চড়া দামে বাজারে ছাড়ছেন। ব্যবসা, খালি ব্যবসা। এদিকে লোকে জানছে যে আমরা খুব শস্তা দরে চাল ডাল পাচ্ছি। আসলে কিন্তু তার সুবিধে ভোগ করছে ম্যানেজার আর তার মোসাহেবরা। যে রক্ষক সেই হল গিয়ে তোমার ভক্ষক। কাকে কী বলবে বল? হয়েছে যত সব চোর ছেঁচড়ের আড্ডা।
মনোরমা : দ্যাখ যদি সেদিনকার মতো সিভিক গার্ডকে বলে কয়ে কিছু চিনি জোগাড় করতে পারো।
হরেকৃষ্ণ : (চোখ বড়ো বড়ো করে)। কিন্তু চাল, চালের কী হবে!… দেখি, দাও টাকাটা, ঘুরে আসি। মিছে ভেবেই কি কিছু বার করতে পারবো। (গমনোদ্যত)
মনোরমা : (পেছন থেকে)। ওকি, ঠাকুর নমস্কার করে বেরুলে না!
হরেকৃষ্ণ : (একটু থেমে ঘুরে দাঁড়িয়ে)। সুবিধে হবে বলে মনে করছ, আচ্ছা!
দেবতার উদ্দেশে প্রণাম জানিয়ে হরেকৃষ্ণবাবুর প্রস্থান
ড্রপ
পঞ্চম দৃশ্য
দিবালোকে সব কিছু সমুজ্জ্বল। সারবন্দি একটা কিউ স্টেজের ওপর দিয়ে এঁকে বেঁকে দোকানের সামনে গিয়ে মিশেছে। হট্টগোল চলছে লাইনে। নানা সমস্যা নিয়ে নানান জনের গবেষণা। মুখর পরিবেশ।
হরেকৃষ্ণ : উড়িষ্যা থেকে নাকি লক্ষ লক্ষ মন চাল এসে পড়েছে। এ চাল উঠল কোথায়!
সামনের একজন লোক তার সামনের একজন ওড়িয়াকে দেখিয়ে দিয়ে বলেষ
১ম পুরুষ : এই যে মশাই, একে জিজ্ঞেস করুন। কিরে বল না। তোদের দেশেরই তো চাল।
ওডিয়া : কড় কউচি।
১ম পুরুষ : কথাও বুঝিস না এখনও। আরে তোর দেশের থেকে যে চাল আসবার কথা ছিল তার কী হল বুড়োবাবু তাই জিজ্ঞেস করছেন। চাল এসেছে না স্রেফ তাল মারলি।
হরেকৃষ্ণ : না তাও তার খবর কোত্থেকে রাখবে বলুন!
ওড়িয়া : সে মো বলি পারিব না।
১ম পুরুষ : বলি পারিব না তো থাক দাঁড়িয়ে রোদ্দুরের মধ্যে। হুঁ, বেশ তো থাকতিস বাবা দেশঘরে। কেন খামোকা মরতে এলি।
ওড়িয়া : (হেসে)। চাউড় তো পোয়া যাইছে না বাবু।
হরেকৃষ্ণ : সেই কথাই তো বলছি। এত চাল গেল কোথায়!
সহসা দোকানের দরজা খোলে। মোটা নাদুস-নুদুস তেল কুচকুচে দোকানি। ফতুয়ার নীচে ওর ভুঁড়িটা স্বপ্রকাশ। দোকানের সামনে গঙ্গাজল ছিটোচ্ছে। ক্যাশবাক্সের ওপর জ্বলছে ধুনুচি। সিদ্ধিদাতা গণেশকে একটা পেন্নাম জানিয়ে দাঁড়িপাল্লায় আঙুল ঠেকিয়ে মাথায় ছোঁয়ায়। তারপর দোকানি তার গদিতে চেপে বসে। দরজার পাল্লায় লটকানো বিজ্ঞাপন খুচরা নাই। সঙ্গে সঙ্গে লাইনে সাড়া পড়ে যায়। সিভিক গার্ড ঘুরে যায় একবার লাইনের সামনে দিয়ে।
সিভিক গার্ড : এই সব টিকিট আছে তো ? নইলে কিন্তু চাল মিলবে না বলে দিচ্ছি।
হরেকৃষ্ণ : ক সের করে দেবে মশাই ?
সিভিক গার্ড : যখন দেবে তখন দেখতেই পাবেন, খুচরো পয়সা সঙ্গে রেখেছেন তো!
১ম পুরুষ : আমার কাছে কিন্তু টাকা।
সিভিক গার্ড : ভাঙিয়ে নিয়ে আসুন মশাই। ও টাকা ফাকার চেঞ্জ দেওয়া চলবে না।
১ম পুরুষ : চলবে না আপনার কোন আইনে লেখা আছে মশাই সকলের কাছেই যে খুচরো থাকবে এমন কি কোনো কথা ছিল!
সিভিক গার্ড : না থাকে তো নেবেন না চাল। ও সব আইনের কথা বলবেন আদালতে গিয়ে-এখানে নয়।
হঠাৎ সিভিক গার্ড বোঁ করে ছুটে গিয়ে একটা লোককে লাইন থেকে হিঁচড়ে টেনে বার করল।
সিভিক গার্ড : ই য়েঃ–:–: বাইরে থেকে এসেই ভেতরে ঢুকে পড়ছ নবাবপুত্তর।
২য় পুরুষ : আমি তো আগে থেকেই এখানে দাঁড়িয়ে আছি মশাই জিজ্ঞেস করুন না এই পাশের লোককে, কী মশাই, ছিলাম না আমি এইখানে দাঁড়িয়ে, বলুন তো ?
৩য় পুরুষ : হ্যাঁ, হ্যাঁ, ও এইখানেই দাঁড়িয়েছিল ছেড়ে দিন ওকে।
২য় পুরুষ : সেই ভোর পাঁচটা থেকে আমি বলে ঠিক এই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। আর বলে কিনা ছিলাম না, আচ্ছা তো জুলুম দেখি, কী করি এখন!
সিভিক গার্ড কী করি এখন! কেন লাইন ছেড়ে বাইরে যেতে বলেছিল কে? কেন ছেড়েছিলেন লাইন ?
২য় পুরুষ : কী মুশকিল তারও কৈফিয়ত দিতে হবে নাকি ?
সিভিক গার্ড : তা হবে না! কোথাকার লোক কোত্থেকে এসে ভিড়ে পড়ল জানতে হবে না, কেন, আগে থেকে সেরে আসতে কী হইছিল-এই খবরদার!
সিভিক গার্ড হঠাৎ আবার অন্যদিকে ছুটে বেরিয়ে গেল। গিয়েই ঝট করে দুঃস্থ চেহারার একটা লোকের গালের ওপর চপেটাঘাত করে বসেছে
সিভিক গার্ড : চালাকি পেয়েছ। লুটের মাল, না! বার বার ঢুচ্ছ, বেরুচ্ছ, বেরুচ্ছ, ঢুকছ। মামার বাড়ির আবদার আর কী। কোথায় চাল জমা করেছ দেখাবে চল। তোমায় আমি পুলিশে দেব, দাঁড়াও।
৪র্থ পুরুষ : (কাঁচুমাচু মুখ করে)। এ কী বলছেন আপনি! লাইন ছেড়ে গেছি! আমি! কী আশ্চর্য! সিভিক গার্ড চুপ চুপ! আবার ন্যাকা ন্যাকা কথা। কিছু দেখতে পাইনে মনে করেছ, না!
তৃতীয় পুরুষ : কেন বেচারিকে খামখা মারধোর করছেন মশাই। লাইন ছেড়ে ও তো কোথাও যায়নি। এই আমারই সামনে তো ঘণ্টাখানেক ধরে লোকটাকে ঠিক একই জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখতে পাচ্ছি। ছি, ছি, এসব কী অত্যাচার।
সিভিক গার্ড : নিজের চোখকে আপনি মশাই আমায় অবিশ্বাস করতে বলেন।
৩য় পুরুষ : হ্যাঁ, তাই বলি। নজরটাও কি আপনার একচোখে? চোখতো আমাদেরও আছে নাকি। যে ঢুকেছে আপনি তাকে ধরতে না পেরে একজন নির্দোষ লোককে খামখা মারধোর করলেন।
মুসলমান : ওর কী দোষ আছে মশাই যে আপনি মেরে বসলেন?
৩য় পুরুষ : ওঃ, সিভিক গার্ড হয়েছেন তো একেবারে মাথা কিনে নিয়েছেন।
সিভিক গার্ড : এয়োপ! মুখ সামলে কথা বলো বলছি।
৩য় পুরুষ : কী আপনি মুখ সামলাতে এসেছেন মশাই? চাল নিলে একজন আর আপনি অন্য একজনকে ধরে পিটে দিলেন! কেন, এ কোন দিশি শাসন মশাই?
৪র্থ পুরুষ : আমি বাবা কিছুই জানিনে। সেই সকাল থেকে বলে দাঁড়িয়ে আছি দুটো চালের জন্যে।
৩য় পুরুষ : লোকে পয়সা দিয়ে চাল নেবে, তার আবার ফুটুনি দেখ না! কেন আপনি মিথ্যি মিথ্যি ওকে বার করে দিলেন বলুন তো? সেই পাঁচ ছ ক্রোশ দূর থেকে এসেছে বেচারি দুটো চালের জন্যে, উনি দিলেন তাকে বের করে।
সিভিক গার্ড : দোষী কি নির্দোষী সে কৈফিয়ত তো আমি আপনার কাছে দেব না। আপনার যদি দরদ থাকে তো দেবেন না আপনার চালটা ওকে।
৪র্থ পুরুষ : (সিভিক গার্ডকে)। দাও না বাবা আমায় লাইনে ঢুকতে। সত্যি বলছি আমি একবারও চাল নেইনি। বিশ্বাস কর বাবা। তিনটি প্রাণী দুদিন অনাহারে আছি বাবা, দয়া কর।
সিভিক গার্ড : ওঃ গা আমার একেবারে জল করে দিলে রে। যা যা, ন্যাকামি করতে হবে না। যা নিইছিস তাই খাগে, যা, ভাগ।
৪র্থ পুরুষ : (আহত হয়ে ক্ষোভে)। আমি চাল নেইনি।
সিভিক গার্ড : এই ওপ!
৪র্থ পুরুষ : (ধড়টা ওর কাঁপছে)। আমি নেইনি চাল। দেখুন মশাই আপনারা সব, আমি চাল নেইনি, তবু আমায় চোর বলছে, আমি চোর নই।
হরেকৃষ্ণ : আরে বাবা লাইনে ঢুকতে দিচ্ছে না তো যা না গিয়ে আবার পেছনে দাঁড়াগে, চাল পাওয়া নিয়ে তো কথা।
৩য় পুরুষ : ওঃ খুব যে দরদ দেখি। যান না আপনি গিয়ে পাঁচশো লোকের পেছনে দাঁড়ান গে।
সিভিক গার্ড : এই, গোলমাল করবেন না বলে দিচ্ছি। চাল নিতে হয় তো চুপচাপ লাইনে থাকুন। পরের জন্যে দরবার করতে হবে না আপনাকে।
৪র্থ পুরুষ : কেন, উনি তো ঠিকই বলছেন।
সিভিক গার্ড : থাক, তোকে আর দালালি করতে হবে না। যা ভাগ ভাগ।
৪র্থ পুরুষ : (অপমানিত হয়ে)। আমি কুকুর নই।
সিভিক গার্ড : মানুষ নাকি!
৪র্থ পুরুষ : চাল দেবে না দিও না, কিন্তু তাই বলে যা তা বোলো না বলছি।
সিভিক গার্ড : মেজাজ নাকি!
৪র্থ পুরুষ : আলবাৎ, জানোয়ার কাঁহাকা
সিভিক গার্ড : লোকটিকে ঘুসি মারতে উদ্যত হয়। সঙ্গে সঙ্গে লোকটিও ওকে জাপটে ধরে। লাইন ভেঙে তুমুল হট্টগোলের সৃষ্টি হয়, মার শালা, জুতিয়ে মুখ ছিঁড়ে ফেল, পুলিশ, পুলিশ প্রভৃতি নানা রকম ধ্বনি শোনা যায়। এগিয়ে আসে জনৈক যুবক হন্তদন্ত হয়ে।
যুবক : আগুন! আগুন!
(হঠাৎ গোলমালটা থেমে যায়)
১ম পুরুষ : কোথায় আগুন ?
সিভিক গার্ড : আগুন! আগুন কিসের!
হরেকৃষ্ণ : আগুন আবার লাগল কোথায় বাবা এর মধ্যে!
যুবক : (হাতজোড় করে) আগুন! আগুন জ্বলছে আমাদের পেটে।
হরেকৃষ্ণ : তবু ভালো। আমি ভাবলাম বলি…।
সিভিক গার্ড : ওঃ খুব যে বক্তিমে দিচ্ছেন। সামলান না তাল একবার দেখি।
সিভিক গার্ডের দোকানের দিকে প্রস্থান। ওদিকে চলমান কিউ সরে সরে যাচ্ছে। যে যার মতো চাল নিয়ে বেরিয়ে পড়ছে। লুঙ্গিপরা জনৈক মুসলমান ভাই চাল নিয়ে বেরিয়ে গেল।
মুসলমান ভাই : (দোকানিকে)। আজ চাল ঠিক আছে তো মশাই? কেউ ফাঁক যাবে না তো? দেখবেন।
দোকানি : সে খোঁজে তোমার দরকার কী কত্তা। তুমি তো পেয়েছ, যাও, ভালোয় ভালোয় কেটে পড়।… বাব্বা! লুঙ্গি, টিকি, পৈতে, টুপি সব একাকার হয়ে গেছে। আর কি উপায় আছে। ব্যবসার সুখ এই গেল। ওরে ও পঞ্চা, নে বস্তা কেটে চাল ঢাল চটপট।
ওড়িয়া : (কোঁচড়ে চাল বেঁধে সহাস্য মুখে)। মুশকিলের কথা তো দাদা সেই হইল। যে হিন্দু অছি সেও চাল খাইব, আর যে মুসলমান অছি সেও চাল খাইব। সাহেব লোকও খাউচি, গুঁড়া করি পাউরুটি বনায়েরে খাউচি। সব্ব চাউড় খাউচি। এবে সব্ব এক হৈ গিলা। চাউড়ের কথা বড় মস্ত কথা আছে রে দাদা। তো তুমার বাণিজ্য আর চলিব কেমতি।
দোকানি : যা বাবা যা, কেটে পড়, কেটে পড়। (সিভিক গার্ডের দিকে চেয়ে) হাতি যখন নোদে পড়ে চামচিকে তায় লাথি মারে; তা আমারও হয়েছে সেই দশা।
ওড়িয়া লাইন থেকে একটু দূরে বসে কোঁচড়ে চাল বাঁধছে, এর মধ্যে হঠাৎ ‘কিউ’ থেকে চাল নিয়ে বেরিয়ে এলেন হরেকৃষ্ণ। ওড়িয়াকে লক্ষ করে
হরেকৃষ্ণ : এই যে, বড্ড খাঁটি কথা বলেছ হে। বড্ড খাঁটি কথা হেঃ হেঃ।
হঠাৎ পেছন থেকে প্রথম পুরুষ চাল নিয়ে এসে দাঁড়ায়
১ম পুরুষ : না, আমরা অনেকেই হয়তো হালুম ওর কথায় বুঝলেন, কিন্তু ওর ওই সোজা কথাটা আমরা আজও অনেকেই বুঝি না।
হরেকৃষ্ণ : ঠিক, অতি ঠিক (হঠাৎ ৪র্থ পুরুষকে দেখে) এই যে, তবে পেয়েছেন বাবা চাল ?
৪র্থ পুরুষ : (চালের পুঁটুলি দেখিয়ে)। হ্যাঁ বাবা, পেইছি।
হরেকৃষ্ণ : তখন পেছনে দাঁড়াতে বলেছিলাম বলে কিছু মনে করো না যেন ভাই, কোনো কিছু মনে করে আমি তোমায় ওকথা বলিনি।
৪র্থ পুরুষ : না, না, আমি কিছু মনে করিনি।
হরেকৃষ্ণ : সমস্যা সব্বার। এই তো দ্যাখো না সামান্য দু সের চালের জন্য কি নাজেহালটাই না হতে হচ্ছে। আচ্ছা বল, একথা কি ভেবেছি কোনোদিন, স্বপ্নেও। তা আজ আর কারো গর্বের কিছু নেই রে দাদা। তাই বলছি, কিছু মনে করে আমি তোমায় ও কথা…
৪র্থ পুরুষ : (আন্তরিকতায় হরেকৃষ্ণর হাত ধরে)। না না, কেন আপনি বলছেন ও কথা বারবার। বলছি তো, আমি কিছু মনে করিনি।
৩য় পুরুষ : আর মনে করাকরিই বা কেন। যথেষ্ট তো হয়েছে। এখন বাঁচতে হবে। বাঁচতে হলে মিলিমিশে থাকতে হবে ব্যাস্।
হরেকৃষ্ণ : (বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে)। এই বুঝটাই এখন দরকার।
৩য় পুরুষ : তা ছাড়া উপায় নেই, কোনো উপায় নেই।
ঘাড় নাড়তে নাড়তে হরেকৃষ্ণ, তৃতীয় ও চতুর্থ পুরুষ এবং ওড়িয়ার প্রস্থান।
ওদিকে চলমান কিউ সরে সরে চলেছে। একজনের পর আর একজন চাল নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। লাইনটা ক্রমশ নিষ্প্রভ হয়ে আসছে।
ড্রপ
নাট্যকার পরিচিতিঃ
বিজন ভট্টাচার্য : (১৯০৬-১৯৭৮) নাট্যকার, অভিনেতা। ফরিদপুর জেলার খানখানাপুরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। নবনাট্য আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক বিজন ভট্টাচার্য গণজীবনের সংগ্রাম ও দুঃখ-দুর্দশা, শোষণ-বঞ্চনা, প্রগতিশীল চিন্তা ও সমাজবোধ নিয়ে নাটক রচনা করেন এবং এক্ষেত্রে তিনি স্বতন্ত্র বৈশিষ্টা ও বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন। তবে তাঁর শেষজীবনে রচিত নাটকে মার্কসীয় দর্শন, হিন্দু ধর্ম ও দর্শন সংমিশ্রিত হয়েছে। তিনিই প্রথম বাংলা রঙ্গমঞ্চকে পুরাণ ও ইতিহাসের রোম্যান্টিক প্রভাব থেকে মুক্ত করেন। তাঁর প্রথম নাটক আগুন (১৯৪৩) নাট্যভারতীতে অভিনীত হয়েছে। পরে তিনি রচনা করেন জবানবন্দী (১৯৪৩); এটি কৃষকজীবনের আলেখ্য। তাঁর প্রতিভার সার্থকতম নিদর্শন হলো নবান্ন (১৯৪৪) নাটক; বন্যা, দুর্ভিক্ষ ও মহামারির পটভূমিকায় রচিত এই নাটকে দুঃস্থ-নিপীড়িত কৃষকজীবন প্রতিফলিত হয়েছে। ১৯৪৮-৫০ সময়ে বিজন ভট্টাচার্য বোম্বাই চলচ্চিত্রে অভিনয় ও ফিল্মস্ক্রিপ্ট লেখার কাজও করেন। ১৯৭৮ সালের ১৯ জানুয়ারি কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়।