আফ্রিকা কবিতার আলোচনা, বিষয় সংক্ষেপ, বিষয়বস্তু, সারাংশ মাধ্যমিক বাংলা | Africa Poem Summary Class 10 wbbse
1. দশম শ্রেণি সমস্ত বিষয়ের ইউনিট টেস্ট প্রশ্নপত্র | Class 10 All Subject Unit Test Question Paper CLICK HERE
2. দশম শ্রেণি বাংলা পাঠ্যবই সমাধান | Class 10 Bengali Textbook Solution CLICK HERE
3. মাধ্যমিক বাংলা পাঠ্যসূচী ২০২৪-২৫ | Madhyamik Bengali Syllabus 2024-25 CLICK HERE
4. মাধ্যমিক পরীক্ষার রুটিন ২০২৫ | Madhyamik Exam Routine 2025 CLICK HERE
5. মাধ্যমিক বিগত বছরের সমস্ত বিষয়ের প্রশ্নপত্র | Madhyamik Previous Years Question Paper CLICK HERE
6. মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি অনলাইন MCQ মক্ টেস্ট | Madhyamik Preparation MCQ Mock Test CLICK HERE
আফ্রিকা —রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
উদ্ভ্রান্ত সেই আদিম যুগে
স্রষ্টা যখন নিজের প্রতি অসন্তোষে
নতুন সৃষ্টিকে বার-বার করছিলেন বিধ্বস্ত,
তাঁর সেই অধৈর্যে ঘন-ঘন মাথা-নাড়ার দিনে
রুদ্র সমুদ্রের বাহু
প্রাচী ধরিত্রীর বুকের থেকে
ছিনিয়ে নিয়ে গেল তোমাকে, আফ্রিকা,
বাঁধলে তোমাকে বনস্পতির নিবিড় পাহারায়
কৃপণ আলোর অন্তঃপুরে।
সেখানে নিভৃত অবকাশে তুমি
সংগ্রহ করছিলে দুর্গমের রহস্য,চিনছিলে জলস্থল আকাশের দুর্বোধ সংকেত,
প্রকৃতির সৃষ্টি-অতীত জাদু
মন্ত্র জাগাচ্ছিল তোমার চেতনাতীত মনে।
বিদ্রূপ করছিলে ভীষণকে
বিরূপের ছদ্মবেশে,
শঙ্কাকে চাচ্ছিলে হার মানাতে
আপনাকে উগ্র ক’রে বিভীষিকার প্রচণ্ড মহিমায়
তাণ্ডবের দুন্দুভি নিনাদে॥
হায় ছায়াবৃতা,
কালো ঘোমটার নিচে
অপরিচিত ছিল তোমার মানবরূপ
উপেক্ষার আবিল দৃষ্টিতে।
এল ওরা লোহার হাতকড়ি নিয়ে
নখ যাদের তীক্ষ্ণ তোমার নেকড়ের চেয়ে,
এল মানুষ-ধরার দল,
গর্বে যারা অন্ধ তোমার সূর্যহারা অরণ্যের চেয়ে।
সভ্যের বর্বর লোভ
নগ্ন করল আপন নির্লজ্জ অমানুষতা।
তোমার ভাষাহীন ক্রন্দনে বাষ্পাকুল অরণ্যপথে
পঙ্কিল হোলো ধূলি তোমার রক্তে অশ্রুতে মিশে;
দস্যু-পায়ের কাঁটা-মারা জুতোর তলায়
বীভৎস কাদার পিণ্ড
চিরচিহ্ন দিয়ে গেল তোমার অপমানিত ইতিহাসে॥
সমুদ্রপারে সেই মুহূর্তেই তাদের পাড়ায় পাড়ায়
মন্দিরে বাজছিল পূজার ঘণ্টা
সকালে সন্ধ্যায়, দয়াময় দেবতার নামে;
শিশুরা খেলছিল মায়ের কোলে;
কবির সংগীতে বেজে উঠছিল
সুন্দরের আরাধনা॥
আজ যখন পশ্চিম দিগন্তে
প্রদোষকাল ঝঞ্ঝাবাতাসে রুদ্ধশ্বাস,
যখন গুপ্তগহ্বর থেকে পশুরা বেরিয়ে এল,
অশুভ ধ্বনিতে ঘোষণা করল দিনের অন্তিমকাল,
এসো যুগান্তরের কবি
আসন্ন সন্ধ্যার শেষ রশ্মিপাতে
দাঁড়াও ঐ মান-হারা মানবীর দ্বারে,
বলো, ক্ষমা করো,—
হিংস্র প্রলাপের মধ্যে
সেই হোক তোমার সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী॥
লেখক পরিচিতি :
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১): জন্ম
কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে।
অল্পবয়স থেকেই ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত ভারতী ও বালক পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। দীর্ঘ জীবনে অজস্র কবিতা, গান, ছোটোগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ লিখেছেন, ছবি এঁকেছেন। এশিয়ার মধ্যে তিনিই প্রথম নোবেল পুরস্কার পান ১৯৯৩ সালে ‘Song Offerings’ এর জন্যে। দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র ভারত আর বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত তার রচনা। কবির প্রথম জীবনে লেখা কাব্যগ্রন্থগুলি হলো- ‘সন্ধ্যাসগীত’, ‘প্রভাতসঙ্গীত’, ‘ছবি ও গান’, ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’ এবং ‘কড়ি ও কোমল। ১৮৮৮ থেকে ১৮৯৬ – মাত্র আট বছরে কবি প্রতিভার যে অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটেছে তারই চিহ্ন সুমুদ্রিত এই পর্বের চারখানি। কাব্যগ্রন্থে ‘মানসী’, ‘সোনারতরী’, ‘চিত্রা’ ও ‘চৈতালি ‘তে। এই পর্বের কাব্যগুলিতে কবির আত্মোপলব্ধিই শুধু নয়, তাঁর কাব্যে নির্মাণ কৌশলেরও যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। আবেগ, গভীর আত্মপ্রত্যয় জীবন জিজ্ঞাসা, কল্পনার পক্ষ বিস্তার, শিল্পরূপ নির্মাণে দক্ষতা, ভাষা ও ছন্দের ওপর আধিপত্য প্রভৃতি কবির যাবতীয় গুণাবলির প্রকাশ ঘটেছে এই পর্বের কবিতাবলিতে। এরপর কবি রচনা করেন কণিকা, কথা ও কাহিনী, কল্পনা, ক্ষণিকা ও নৈবেদ্য গীতাগুলি পর্বের প্রধান তিনখানি কাব্যগ্রন্থ গীতালি, গীতিমাল্য ও গীতালি, ১৯১৬তে বলাকা, ১৯২৫ এ পুরবী এবং ১৯২৯-এ মহুয়া রচনা করেন কবি রবীন্দ্রনাথ। ‘পুনশ্চ’ থেকে রবীন্দ্রকাব্যের শেষ পর্বের শুরু। এ পর্বের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হলো শেষ সপ্তক’, ‘প্রান্তিক’, ‘নবজাতক’, ‘সামাই’, ‘রোগশয্যায়’, ‘আরোগ্য ইত্যাদি।
উৎস :
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সঞ্চয়িতা’ কাব্য সংকলন থেকে গৃহীত হয়েছে। তবে এটি স্বতন্ত্রভাবে ‘পত্রপুট’ কাব্যগ্রন্থের ষোলো সংখ্যক কবিতায় স্থান পেয়েছে।
অল্প কথায়:
• আদিম আফ্রিকার প্রাকৃতিক রহস্যময়তায় ঢাকা সৌন্দর্যের বর্ণনা। আদিম রূপের রহস্যের ভয়ংকরতার কারণে একদিকে তার টিকে থাকা আর অন্য দিকে তার উপেক্ষিত হওয়া ক্রীতদাসের জোগানেই যার শুধু ভূমিকা ছিল তার সম্পদশালী রূপ অন্ধকারাচ্ছন্নতা থেকে প্রকাশ্যে আসায় সাম্রাজ্যলোভীদের আগ্রাসনের শুরু।
• সভ্য দুনিয়ার মানুষের শোষণ লাঞ্ছনার শিকার আফ্রিকার বেদনায় কবির ব্যথিত হওয়া ইউরোপীয়দের বর্বরোচিত অত্যাচারের বিরুদ্ধে মানবতা প্রতিষ্ঠার বাণী উচ্চারণ।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আফ্রিকা’ কবিতার সহজ সরল আলোচনা—
সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, মানবতার পূজারী, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অসংখ্য কবিতারাজির মধ্যে একটি অনবদ্য স্মরণীয় কবিতা ‘আফ্রিকা’।১৯৩৫ সালে ইতালির ফ্যাসিস্ট নেতা মুসোলিনির ইথিওপিয়ায় অনুপ্রবেশকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তীব্র ভাষায় ধিক্কার জানান। সেই হিংসার পরিবেশে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য কবি অমিয় চক্রবর্তী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কবিতা লিখতে অনুরোধ জানান। ফলস্বরূপ, ১৯৩৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘আফ্রিকা’ কবিতাটি রচনা করেন।কবিতাটি ১৩৪৩ বঙ্গাব্দে ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও পরবর্তীকালে ‘পত্রপুট’ কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণে ও ‘সঞ্চয়িতা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কবিসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে একটি ভৌগোলিক ঘটনাকে শিল্পসম্মত কাব্যিক রূপ দান করেছেন। আফ্রিকা কবিতাটি তাঁর প্রতিবাদী সত্তার প্রতীক। তিনি উপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদকে তীব্র ধিক্কার জানিয়েছেন এই কবিতার মাধ্যমে।
আফ্রিকা অন্যান্য মহাদেশ থেকে চারিত্রিক ও ভৌগোলিকভাবে স্বতন্ত্র। কবির মতে সৃষ্টির আদিতে সৃষ্টিকর্তা নিজের প্রতি অসন্তোষে অধৈর্য হয়ে পূর্বাঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন করে, স্বতন্ত্র রূপ দিয়ে সৃষ্টি করেন আফ্রিকা মহাদেশকে। শুরু হয় আফ্রিকার একক সংগ্রাম।অন্ধকার অরন্যের আড়ালে ধীরে ধীরে নানান প্রতিকূলতাকে জয় করে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছিল আফ্রিকা।বিশ্ব জগতের চোখের আড়ালে প্রকৃতি যেন তাকে সাজিয়ে নিয়েছিল নিজের মনের মত করে। বন্যপ্রাণী সংকুল অরণ্য, নিবিড় বনস্পতি, দুর্গম রহস্যময়তা ও আদিমতা আফ্রিকাকে স্বতন্ত্র রূপ দান করেছিল। আর এই আদিম রূপের কারণে সভ্য সমাজের কাছে সে ছিল উপেক্ষার পাত্র। কবির মতে-“কালো ঘোমটার নীচে/ অপরিচিত ছিল তোমার মানবরূপ/ উপেক্ষার আবিল দৃষ্টিতে।”কিন্তু তারপর অপাপবিদ্ধ আফ্রিকার ভূমি অপবিত্র হলো বহিরাগতদের কলুষ-স্পর্শে। তথাকথিত সভ্যরূপী পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদী শাসকেরা লুণ্ঠন চালায় নির্মম ভাবে।ক্রমে ক্রমে আফ্রিকা হয়ে ওঠে পশ্চিম সভ্য দেশ গুলির জন্য ক্রীতদাস জোগানোর ক্ষেত্র।আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ সরল মানুষ গুলিকে লোহার হাতকড়ি পরিয়ে মানুষ ধরা এই শ্বেতাঙ্গ বর্বরেরা পরিণত করে ক্রীতদাসে।তাদের বর্বরতা ও লোভ আফ্রিকার সূর্য হারা অরণ্যের চেয়েও কালো ও ভয়ংকর।এইসব অত্যাচারিত মানুষদের রক্ত ও অশ্রুতে কর্দমাক্ত হয় আফ্রিকার বনপথের ধুলো। সাম্রাজ্যবাদী দস্যুদের কাঁটা মারা জুতোর তলায় আফ্রিকার অপমানিত ইতিহাসে যেন চির চিহ্ন দিয়ে যায়।এমন কি সে দেশের আদিম প্রকৃতির কোলে লুকিয়ে থাকা সম্পদ ও তাদের নজর এড়ায় না। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের উপনিবেশে পরিণত হয় আফ্রিকা।
মানবতা পূজারী কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানবতার এই অপমান সহ্য করেননি। দিনবদলের সন্ধিক্ষণে তাই পৃথিবীর সমস্ত শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের হয়ে অপমানিত, লাঞ্ছিত আফ্রিকার কাছে তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। কবি সাহিত্যিকরা সত্য ও সুন্দরের প্রতিষ্ঠাতা। তাই শোষণ ও লাঞ্ছনার শিকার আফ্রিকার মর্মবাণী যেন সংবেদনশীল কবি হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছিলেন। কবির বিশ্বাস,আফ্রিকার সহিষ্ণুতা ও ক্ষমতাশীলতাই বিশ্বময় সভ্যতার পূণ্যবার্তা প্রচার করবে।সুতরাং আফ্রিকা কবিতাটি শুধু একটি মহাদেশ বা জাতির পরিচয় বহন করে না বরং বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদের হাতে নির্যাতিত ও নিগৃহীত মানবাত্মার প্রতীক হয়ে উঠেছে।