ভাব সম্মিলন কবিতার প্রশ্নোত্তর দ্বিতীয় সেমিস্টার একাদশ শ্রেণি বাংলা | Bhab Sommilon Kobitar Question Answer 2nd Semester Class 11 Bengali wbchse
1. একাদশ শ্রেণির বাংলা মডেল প্রশ্ন পত্র দ্বিতীয় সেমিস্টার উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ Click Here
2. একাদশ শ্রেণির বাংলা সমস্ত অধ্যায়ের প্রশ্নোত্তর Click Here
3. একাদশ শ্রেণির সমস্ত বিষয়ের প্রশ্নপত্র প্রশ্ন Click Here
রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর : ভাব সম্মিলন কবিতা একাদশ শ্রেণি বাংলা দ্বিতীয় সেমিস্টার | Bhab Sommilon Essay Type Question Answer Class 11 Bengali Second Semester wbchse
অনধিক ১৫০ শব্দের মধ্যে উত্তর দাও : প্রতিটি প্রশ্নের মান- ৫
প্রশ্ন ১। ভাব সম্মিলন বলতে কী বোঝো ? এই প্রসঙ্গে আলোচ্য কবিতাটির নামকরণের সার্থকতা বিচার করো। ২+৩
উত্তরঃ ‘ভাব সম্মিলন’ কথার সাধারণ অর্থ হল ভাবের জগতে মিলন। তবে বৈষ্ণব সাহিত্যে এই পদযুগলের বিশেষ অর্থ রয়েছে। কৃষ্ণের মথুরা গমনের পর বিরহীনি রাধা কল্পিত ‘ভাব বৃন্দাবনে’ কৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হয়। রাধাকৃষ্ণের প্রেমবৈচিত্র্যের এই পর্যায়েকে বলা হয় ভাব সম্মিলন বা ভাবোল্লাস।
আলোচ্য পদটির শুরুতেই রাধা তার আনন্দের কথা প্রকাশ করেছে। কারণ, দীর্ঘকাল পর মাধব তার গৃহে আসছেন। এতদিন ধরে চাঁদ তাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। তবে, প্রিয় কৃষ্ণের মুখ দেখে রাধা ততোধিক সুখ পেয়েছে। রাধার কথা শুনে মনে হতে পারে কৃষ্ণ বৃন্দাবনে ফিরে এসেছেন, কিন্তু বাস্তবে কৃষ্ণ তখনও মথুরায় ছিলেন। অর্থাৎ তাদের এই মিলন একান্তই ভাবের জগতে।
কৃষ্ণকে ফিরে পেয়ে রাধা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে যে, তার আঁচল ভরে বিপুল ধনসম্পদ দেওয়া হলেও সে তার প্রিয়কে কখনোই দূর দেশে পাঠাবে না, কারণ কৃষ্ণই তার জীবনের একমাত্র অবলম্বন। কৃষ্ণের এই প্রত্যাবর্তন ঘটেছে রাধার ভাবলোকে, বাস্তবে নয়।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা স্পষ্ট যে, ভাবের জগতে রাধাকৃষ্ণের মিলনই এ পদের মূল উপজীব্য। সুতরাং আলোচ্য পদের নামকরণ বিষয়ানুগ হয়েছে, একথা বলাই যায়।
সর্বোপরি, এই পথটি ভাব সম্মিলন পর্যায়ের একটি উৎকৃষ্ট পদ। সেই হিসেবেও পদটি সার্থকনামা বলা যেতে পারে।
প্রশ্ন ২। ভাব সম্মিলন কাকে বলে ? পাঠ্য ভাবসম্মিলন কবিতায় যেভাবে রাধার আনন্দ ফুটে উঠেছে আলোচনা করো।
উত্তরঃ ভাবসম্মিলন : ‘মাথুর’ পর্যায়ের সাজানো কুঞ্জবন, ব্রজপুর আর শ্রীরাধাকে পিছনে ফেলে কৃষ্ণ চলে গিয়েছেন মথুরায়। একলা রাধার ‘ফাটি যাওত ছাতিয়া’। শ্রীরাধার এই বেদনাদীর্ণ অবস্থার অবসানে এল ভাব সম্মিলন। রাধা-কৃষ্ণের মানস-মিলন। বৈয়ব তাত্ত্বিকরা এই মিলনকে বলেন নিত্যমিলন এবং সেই মিলনের আনন্দই ভাবসম্মিলনের পদের প্রধান উপজীব্য।
রাধার আনন্দ : মিথিলার কবি বিদ্যাপতির লেখা ‘ভাব সম্মিলন’ কবিতায় রাধার আনন্দ যেভাবে ফুটে উঠেছে তা হল ভাবসম্মিলনের পদে রাধার মনে ভাবোল্লাসের যে আনন্দময় উচ্ছ্বাস, তা বিদ্যাপতির পঠিত পদটিতেও লক্ষ করা যায়। রাধা বলেছেন—
“কি কহব রে সখি আনন্দ ওর। চিরদিনে মাধব মন্দিরে মোর।”
বিরহের দিনগুলিতে চাঁদের আলোয় প্রিয়তমের মুখ খুঁজে যত কষ্ট পেয়েছিলেন, এখন প্রিয়তমের মুখদর্শন করে শ্রীরাধিকা ততটাই সুখ লাভ করেছেন। রাধা বলেছেন আঁচল ভরে যদি কেউ তাঁকে মহারত্নসামগ্রী দেয়, তাহলেও নিজের প্রিয়কে তিনি আর দূরদেশে পাঠাবেন না। এভাবেই উল্লিখিত পদে বিদ্যাপতির রাধা নিত্যমিলনের স্থায়ী সুর যোজনা করেছেন। তাঁর কাছে কৃয় তখন শীতের ওড়না, গ্রীষ্মের বাতাস, বর্ষার ছত্র, দরিয়ার নৌকা। আরামে-বিরামে কৃষ্ণই একমাত্র অবলম্বন, রাধা যেন কৃষ্ণরই বিকল্প সত্তা।
প্রশ্ন ৩। “আঁচর ভরিয়া যদি মহানিধি পাই।”— আঁচর’ এবং ‘মহানিধি’ শব্দগুলির অর্থ কী ? কোন প্রসঙ্গে এবং কেন বক্তা এ কথা বলেছে ? ২+৩
উত্তরঃ ‘মৈথিলি কোকিল’ বিদ্যাপতির লেখা ‘ভাব সম্মিলন’ কবিতা থেকে উদ্ধৃত পংক্তিটি নেওয়া হয়েছে। ‘আঁচর’ শব্দের অর্থ হল আঁচল এবং ‘মহানিধি’ শব্দের অর্থ মহাশ্বৈর্য বা বিপুল ধনসম্পদ।
কংসকে বধ করার জন্য কৃষ্ণ মথুরা চলে যায় এবং রাধার জীবনে অন্ধকার নেমে আসে। কৃষ্ণের সঙ্গে মিলনের জন্য রাধা ব্যাকুল হয়ে ওঠে। কিন্তু মিলন তো দূরে থাক, কৃষ্ণের মুখ দর্শন করারও উপায় ছিল না। এইভাবে দীর্ঘ বিরহ যন্ত্রণা ভোগ করার পর রাধা এক অভিনব পন্থায় কৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হয়। নিজের মানস বৃন্দাবনে সে কৃষ্ণকে নিত্যসঙ্গী হিসেবে লাভ করে। ভাবের জগতে কৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হয়ে রাধা এই পণ করে যে, সে যদি আঁচল ভরে মহাশ্বৈর্য পায়, তবুও তার প্রিয়কে দূর দেশে পাঠাবে না।
রাধা ছিল প্রকৃত অর্থেই ‘কৃষ্ণ প্রেমে পাগলিনী’। সে তার সমস্ত সত্তা কৃষ্ণে সমর্পণ করে বসে আছে। কৃষ্ণ তার বেঁচে থাকার অবলম্বন। রাধার জীবনে কৃষ্ণ হল শীতের ওড়না, গ্রীষ্মের বাতাস, বর্ষার ছাতা এবং নদী পারাপারের নৌকা। আর এইজন্যই রাধা তার প্রিয় সখাকে দূরদেশে পাঠাবার ঝুঁকি নিতে চায় না।
প্রশ্ন ৪। “পাপ সুধাকর যত দুখ দেল।”— ‘পাপ সুধাকর’ কথাটির আক্ষরিক অর্থ কী ? সে কীভাবে বক্তাকে দুঃখ দিয়েছিল ? ২+৩
উত্তরঃ ‘পাপ সুধাকর’ কথাটির আক্ষরিক অর্থ হল পাপী বা নিষ্ঠুর চাঁদ। কবিকল্পনায় চাঁদ সৌন্দর্যের প্রতীক, শুচিতার প্রতীক। চাঁদকে নিয়ে আজ পর্যন্ত কত যে কবিতা রচিত হয়েছে তার হিসেব নেই। কিন্তু ভাবোল্লাস পর্যায়ে বিদ্যাপতির রাধা সেই চাঁদকে নিষ্ঠুর বলে অভিহিত করেছে।
চাঁদের সঙ্গে শ্রীরাধার বৈরিতা হওয়ার কথা নয়। বস্তুত, রাধাকৃষ্ণের বহু শুভক্ষণের সাক্ষী থেকেছে চাঁদ। কিন্তু কৃষ্ণের মথুরাগমনের পর চাঁদকে রাধার নিষ্ঠুর বলেই মনে হয়েছে। কৃষ্ণের বিরহে যখন রাধার ভুবনময় অন্ধকার, তখন চন্দ্রালোকিত শুভ্র জ্যোৎস্না রাধার বিরহ বেদনা বহুগুণ বাড়িয়ে তুলত। যেহেতু কৃষ্ণের সঙ্গে মিলনের কোনো উপায় ছিল না, তাই ‘চাঁদের হাসি’ রাধার কাছে অট্টহাস্য বলে মনে হতো।
আবার, রাধা যে কৃষ্ণকে ভুলে থাকবে তারও উপায় ছিল না। কারণ আকাশের চাঁদকে দেখে রাধার আরেক কৃষ্ণচন্দ্রের কথা মনে পড়ে যেত। কিন্তু কৃষ্ণ তখন মথুরায়, তাই মিলনের কোনো উপায় ছিল না। এইভাবে প্রবাসী ‘পিয়া’র প্রতি মিলনের আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলে চাঁদ রাধাকে দুঃখ দিত। এইজন্য কৃষ্ণের সঙ্গে ভাবোল্লাসে মত্ত রাধা চাঁদকে ‘পাপ সুধাকর’ বা নিষ্ঠুর চাঁদ বলেছে।
প্রশ্ন ৫। ভাব সম্মিলন’ কবিতা অবলম্বনে রাধার চরিত্র সম্পর্কে আলোচনা করো ?
উত্তরঃ মিথিলার কবি বিদ্যাপতির লেখা একটি অন্যতম কবিতা বা পদ হল ‘ভাব সম্মিলন’। এই কবিতা কেন্দ্রীয় চরিত্র রাধা। আমি এখন নীচে রাধা চরিত্র সম্পর্কে নিজের ভাষায় আলোচনা করছি—
রাধা চরিত্র : রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাপতির সম্পর্কে বলেছিলেন- “বিদ্যাপতি জগতের মধ্যে প্রেমকে সার বলিয়া জানিয়াছেন…”। পাঠ্য ‘ভাব সম্মিলন’কবিতায় বিদ্যাপতির রাধার মধ্যে প্রেমের উচ্ছ্বাস যেমন আছে, সেরকমই রয়েছে ভাব-গভীরতা। প্রিয়তমের বিচ্ছেদে যে রাধা একসময় বলেছিলেন- “পিয়া বিনে পাঁজর ঝাঁঝর ভেলা”, ভাবসম্মিলনে সেই রাধারই ‘জীবন-যৌবন সফল’ হয়ে যায় ‘পিয়া-মুখ-চন্দা’ দর্শন করে। প্রিয়তমের মুখ-দর্শনে যে অমৃত সুখ রাধা লাভকরেছেন সেখানে কোনো আসঙ্গ লিপ্সা নেই, আছে ভাব-গভীরতা।
“পাপ সুধাকর যত দুখ দেল। পিয়া-মুখ-দরশনে তত সুখ ভেল।।”
রাধা মহামূল্যবান রত্নের বিনিময়ে তাঁর প্রিয় কৃষ্ণকে দূরদেশে পাঠাতে চায় না এবং সঙ্গে বিচ্ছেদ চান না। কবিতায় পুনর্মিলনের উল্লাস সেখানে যেমন আছে, তেমনি রয়েছে হৃদয়-অনুভূতির নিবিড়তা। বিদ্যাপতির এই রাধা পরিণত এবং গভীর।
প্রশ্ন ৬। “আঁচর ভরিয়া যদি মহানিধি পাই।”– কোন্ প্রসঙ্গে শ্রীমতী রাধিকা এই উক্তি করেছেন ? শ্রীরাধিকার কৃষ্ণপ্রেমের নিবিড়তা এখানে কতখানি প্রকাশ পেয়েছে লেখো। ২+৩=৫
উত্তরঃ মৈথিল কোকিল কবি বিদ্যাপতির ‘ভাব সম্মিলন’ কবিতায় শ্রীমতী রাধিকা তাঁর মানসমন্দিরের কল্পরাজ্যে প্রিয়তম মাধবকে পেয়ে আনন্দে হয়েছেন। সীমা-পরিসীমাহীন সুখের অধিকারী হয়েছেন। এতটাই সুখ পেয়েছেন যে, কেউ যদি তাঁকে আঁচল ভরে অগাধ ধনরত্ন দান করে তাঁর প্রিয়তম মাধবকে চান, তবুও তিনি মাধবকে কাছছাড়া করবেন না। সে কথাই তিনি প্রশ্নোক্ত উক্তিটির মাধ্যমে বলেছেন।
প্রেমের নিবিড়তা : কৃষ্ণকে হারিয়ে রাধার যে মনোবেদনা, সেই মনোবেদনার মধ্যে কৃষ্ণকে রাধা আরও নিবিড় করে অনুভব করেছেন। তাঁর প্রথম মিলনের সলজ্জ আত্মপ্রকাশ নয়, অভিসারের দুঃসাহস নয়, মান-অভিমানের লীলা নয়, বিরহের সান্ত্বনাহীন বেদনা নয়, ভাব সম্মিলনেই যে প্রেমের পরিপূর্ণতা এখানে তারই প্রকাশ ঘটেছে। অর্থাৎ বিদ্যাপতির রাধাকে কৃষ্ণবিরহের সমস্ত ব্যথা সয়ে প্রেমের মূল্য দিতে হয়েছে। বিরহের পটভূমিকাতে তাই রাধার ভাব সম্মিলনের পদগুলি এত বেদনা মাধুরী মিশ্রিত করুণ ও কোমল। শ্রীরাধা চিরবিরহের অগমপারে নির্বাসিতা। তবু তিনি বাসনালোকে মিলনের উল্লাসকে তিল তিল করে জমিয়ে রেখেছেন। কৃষ্ণের প্রতি রাধার প্রেমের নিবিড়তা অকল্পনীয়।
প্রশ্ন ৭। গীতিকবিতার সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে ‘ভাব সম্মিলন’ কবিতাটিকে সার্থক গীতিকবিতা বলা যায় কি না-তা সংক্ষেপে লেখো। ৫
উত্তরঃ সংজ্ঞা : গীতিকবিতা হল সেই কবিতা যাতে কবির ব্যক্তিগত সুতীব্র অনুভূতি ও ভাবাবেগ প্রকাশ পায় এবং যা কল্পনা সৌন্দর্য ও সংগীতের মিলনে রমণীয় রসমূর্তি লাভ করে। বঙ্কিমচন্দ্র গীতিকবিতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, “বক্তার ভাবোচ্ছ্বাসের পরিস্ফুটন মাত্র যাহার উদ্দেশ্য, সেই কাব্যই গীতিকাব্য”।
বৈশিষ্ট্য : গীতিকার কয়েকটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হল- গীতিকবিতা হবে সাবলীল গতিসম্পন্ন, সংগীত-মুখরতা এবং নিটোল স্বল্পাকৃতির অবয়বসম্পন্ন। এতে থাকবে গভীর অনুভূতি ও আবেগব্যাকুলতা। এই সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্যের নিরিখে বিদ্যাপতির ‘ভাব সম্মিলন’ কবিতাটি বিচার্য।
সার্থকতা বিচার : দীর্ঘ বিরহের পর শ্রীমতী রাধিকা তাঁর হৃদয়-বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে মানসমিলনের সুখানুভূতিতে আত্মহারা হয়ে পড়েছেন। তিনি সখীকে তাঁর সেই মিলনের সুখানুভূতিকে আবেগপ্লুতভাবে অকপটে বলেছেন- বহুদিন পর প্রিয়তমের সঙ্গে মিলনে আজ তাঁর সর্বশরীর আনন্দে পুলকিত হচ্ছে। পাপী চাঁদের আলো তাঁকে যত দুঃখ দিয়েছে-আজ তিনি প্রিয়তমের সঙ্গে মিলনে তত সুখ অনুভব করেছেন। কোনো কিছুর বিনিময়ে তিনি প্রিয়তম কৃষ্ণকে সঙ্গছাড়া করে দূর দেশে পাঠাবেন না। কবি বিদ্যাপতি সাবলীল গতিময়তায় এক নিটোল স্বল্পাকৃত অবয়বে শ্রীমতী রাধার মনের কৃষ্ণকেন্দ্রিক অনুভূতিকে সুন্দরভাবে প্রকাশ করেছেন, যা হয়ে উঠেছে সার্থক গীতিকবিতা।
স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাপতির পদকে গীতিকবিতার আখ্যায় ভূষিত করে বলেছিলেন, “যাহাকে আমরা গীতিকাব্য বলিয়া থাকি, অর্থাৎ যাহা একটুখানির মধ্যে একটিমাত্র ভাবের বিকাশ….।” এই বিচারেও বিদ্যাপতির ‘ভাব সম্মিলন’ পদটি সার্থক কবিতার পর্যায়ভুক্ত। এখানেও প্রিয়তম কৃষ্ণের সঙ্গসুখজনিত একটিমাত্র ভাবের প্রকাশ নিটোলভাবে সংক্ষেপে তুলে ধরেছেন।
প্রশ্ন ৮। শ্রীমতী রাধিকার জীবনে কৃষ্ণের অপরিহার্যতা বোঝাতে কবি কী কী উপমা ব্যবহার করেছেন ? উপমাগুলি ব্যবহারের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো। ২+৩=৫
উত্তরঃ উপমা প্রয়োগ : কবি বিদ্যাপতি তাঁর ‘ভাব সম্মিলন’ কবিতায় শ্রীমতী রাধিকার জীবনে কৃষ্ণের অপরিহার্যতা বোঝাতে চারটি যথার্থ উপমা ব্যবহার করেছেন। শীতকালে চাদর যেমন একান্ত প্রয়োজনীয় উপকরণ, গ্রীষ্মকালে প্রয়োজন বাতাস, ছাতা ছাড়া যেমন চলা যায় না, একইভাবে নৌকা ছাড়া নদী পার হওয়াও অসম্ভব। কৃষ্ণের সঙ্গে রাধিকা এই চারটি প্রয়োজনীয় বিষয়ের মতোই অচ্ছেদ্য সম্পর্কে সম্পর্কিত।
উপমা ব্যবহারের তাৎপর্য : রাধার নয়নপদ্মের পাপড়ি প্লাবিত করে যে অশ্রু নিশিদিন ঝরেছে, কোনো এক মধুর মিলনের কল্পনায় সেই অশ্রুকে নয়নপদ্মে বেধে তার উপর আনন্দের আলোকসম্পাত করেছেন কবি। চারটি পরিচিত উপমার ব্যবহার করে বিদ্যাপতি ‘প্রিয়তম’ বিষয়টিকে সুন্দরভাবে প্রতিফলিত করে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। শীতের চাদর, বর্ষাকালের ছাতা, গ্রীষ্মের বাতাস, দরিয়ার নৌকা একান্তভাবেই প্রয়োজনীয় বিষয়, তেমনি কৃষ্ণ শ্রীমতী রাধার কাছে শীতের চাদর, গ্রীষ্মের বাতাস, বর্ষার ছাতা এবং দরিয়ার নৌকা। একমাত্র কৃষ্ণের আশ্রয়ে তিনি একান্তভাবে নিশ্চিন্ত। উপমা অলংকার ব্যবহার করে রাধা তাঁর প্রিয়তমকে যথার্থভাবে সর্বত্র বিকশিত করে দিয়েছেন। রাধার প্রেম পত্র- পুষ্প-পল্লবে ছড়িয়ে পড়েছে।
প্রশ্ন ৯। “চিরদিনে মাধব মন্দিরে মোর।।”– কার, কোন্ মন্দিরে মাধব কীভাবে উপস্থিত হয়েছেন ? মাধবের উপস্থিতিতে বক্তার কী প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়, তা সংক্ষেপে লেখো। ২+৩=৫
উত্তরঃ কৃষ্ণের আগমন: অভিনব জয়দেব কবি বিদ্যাপতির লেখা ‘ভাব সম্মিলন’ কবিতায় শ্রীমতী রাধিকার দেহমন্দিরে কল্পনায় মাধব শ্রীকৃষ্ণ এসে উপস্থিত হয়েছেন।
আত্মতৃপ্তির প্রকাশ বৃন্দাবনে শ্রীমতী রাধিকাকে রেখে মাধব শ্রীকৃয় মথুরায় চলে গেলে শ্রীরাধা কৃষ্ণবিরহে একান্ত কাতর হয়ে পড়েন। ‘হা-কৃষ্ণ, হা-কৃষ্ণ’ করে হতাশার অতল তলে নিমজ্জিত হন। কৃষ্ণ বিনে সমগ্র জগৎ তমসাবৃত হয়ে ওঠে তাঁর কাছে। শুভ্র চন্দ্রকিরণেও তিনি অসীম দুঃখ- যন্ত্রণা অনুভব করেন। চন্দ্রালোকের মাধুর্যতা মানুষকে মুগ্ধ করে, মহা উৎফুল্লতায় মানুষ নানা সুখস্বপ্ন দেখে; কিন্তু শ্রীমতী রাধিকার কাছে চন্দ্রকিরণের মাধুর্য বিষাদের করুণ সুর বয়ে আনে। এই বিষাদ ও বিরহের আবেশে কল্পনার মাধ্যমে শ্রীরাধা তাঁর দেহমন্দিরে মানস কল্পনায় মাধবের সঙ্গে মিলিত হয়ে সীমাহীন আনন্দের অধিকারী হয়েছেন। শ্রীরাধা তার সখীকে সেই আত্মতৃপ্তিজনিত আনন্দের অনুভূতি অকপটে জানিয়েছেন। সখীকে তিনি বলেছেন, তাঁর প্রিয়তম মাধব তথা শ্রীকৃষ্ণ চিরদিনের জন্য তাঁর দেহমন্দিরে অবস্থান করেছেন। এ তাঁর জীবনে এক চরম প্রাপ্তি। গভীর দুঃখ বা বিরহের দহনেও শ্রীমতী রাধিকার দেহচেতনা স্তিমিত হয়নি, মিলনের প্রত্যাশায় তা আরও উদ্গ্রীব হয়েছিল। কল্পনায় সেই মিলন পরিপূর্ণতায় তিনি আনন্দসাগরে অবগাহন করেছেন।
প্রশ্ন ১০। ” ….তত সুখ ভেল।”-‘তত সুখ’ বলতে কার, কোন্ সুখের কথা বলা হয়েছে? ‘তত সুখ’-এর অনুভূতি সংক্ষেপে নিজের ভাষায় লেখো। ২+৩=৫
উত্তরঃ রাধিকার আত্মতৃপ্তি : চৈতন্য পূর্ববর্তী বৈয়ব পদকর্তা বিদ্যাপতির লেখা ‘ভাব সম্মিলন’ কবিতায় শ্রীমতী রাধিকা তাঁর দেহমন্দিরে মানস কল্পনায় প্রিয়তম মাধবের সঙ্গে মিলিত হয়ে অসীম সুখের অধিকারী হয়েছেন। দীর্ঘ গ্রীষ্মের পর বর্ষার বারিধারায় যেমন চারপাশ রোমাঞ্চিত ও আনন্দিত হয়ে ওঠে, দীর্ঘ বিরহের পর প্রিয় মিলনে রাধিকা ততটাই আনন্দিত হয়েছেন।
অসীম সুখের অধিকারী : একদা শ্রীমতী রাধিকা তাঁর প্রিয়তম মাধবকে হারিয়ে তীব্র দুঃখ-যন্ত্রণার অগ্নিতাপে দগ্ধ হয়েছেন। কৃষ্ণ ছাড়া সমস্ত জগৎসংসার তাঁর কাছে অন্ধকারময় রূপে দেখা দেয়। তিনি মনোলোকে কৃষুধ্যানে নিমগ্ন হন। চাঁদের আলো সৌন্দর্যের উপকরণ, চাঁদের আলো মানুষের মনোলোকে সুখের ঢেউ তোলে। কিন্তু প্রাণধন কৃষ্ণ শ্রীমতী রাধিকার কাছে না-থাকায় সৌন্দর্যের চাঁদের আলো তাঁর কাছে বিষাদের সুর বয়ে আনে। চাঁদকে তিনি ‘পাপী’ বলে তিরস্কার করেন। তাঁর মনে হয় চাঁদ শুভ্র কিরণের দ্বারা তাঁর মনের দুঃখ-যন্ত্রণাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু আজ বিরহের তীব্রতায় ভাবের ঘোরে কিংবা কল্পনায় মানস বৃন্দাবনে কৃষ্ণের সঙ্গসুখ অনুভব করে তিনি ঠিক ততোটাই সুখের অধিকারী হয়েছেন। কবি বিদ্যাপতি শ্রীমতী রাধিকার মনের এই আনন্দ অনুভূতিকেই ভাষা, সুর ও ছন্দমাধুর্যে আমাদের কাছে তুলে ধরেছেন।