দশম শ্রেণির ইতিহাস প্রথম অধ্যায় 4 নম্বরের বড় প্রশ্ন উত্তর | Class 10 History 1st Chapter 4 Marks Question Answer wbbse
1. দশম শ্রেণির ইতিহাস প্রথম অধ্যায়ের প্রশ্নোত্তর Click Here
2. দশম শ্রেণির ইতিহাস সমস্ত অধ্যায়ের প্রশ্নোত্তর Click Here
বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্নোত্তর : দশম শ্রেণি ইতিহাস প্রথম অধ্যায় ইতিহাসের ধারণা | Analytical Question Answer Class 10 (Madhyamik) History Chapter-1 Itihaser Dharona wbbse
• বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্নোত্তর : (সাত বা আটটি বাক্যে উত্তর দাও) প্রতিটি প্রশ্নের মান-4
১. আধুনিক ভারতের ইতিহাসচর্চার উপাদান হিসেবে বঙ্গদর্শন পত্রিকার গুরুত্ব আলোচনা করো।
ভূমিকাঃ আধুনিক ভারতের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে সমসাময়িকপত্র ও সংবাদপত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এ প্রসঙ্গে বঙ্গদর্শন পত্রিকাটির কথা বলা যায়, যা আধুনিক ভারতের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে অনেক তথ্য সমৃদ্ধ। 1872 খ্রিস্টাব্দের 12ই এপ্রিল বঙ্গদর্শন পত্রিকাটি সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। বঙ্গদর্শন পত্রিকা থেকে সমকালীন বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়।
(ক) সমকালীন তথ্যঃ বঙ্গদর্শন পত্রিকা থেকে সমকালীন সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা, ধর্ম, সংস্কার প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। এই পত্রিকা থেকে ব্রিটিশ সরকারের শাসন ও শোষণের পরিচয় পাওয়া যায়।
(খ) বাঙালির স্বদেশ চেতনাঃ এই বঙ্গদর্শন পত্রিকাটি বাঙালি জাতির মধ্যে স্বদেশ চেতনার বিকাশ ঘটায়। এই পত্রিকায় বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা বন্দেমাতরম্ সঙ্গীতটি প্রথম প্রকাশিত হয় যা পরবর্তীকালে বাঙালি তথা ভারতীয় বিপ্লবী ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূলমন্ত্রে পরিণত হয়েছিল।
(গ) সমাজতান্ত্রিক ভাবধারা প্রসারঃ এই পত্রিকায় সাম্য সহ বিভিন্ন প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এর ফলে বাঙালি সমাজে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার প্রসার ঘটে।
(ঘ) বাঙালি সমাজের মেলবন্ধনঃ বঙ্গদর্শন পত্রিকাটি সমকালীন বাঙালি জাতির উচ্চশিক্ষিত সম্প্রদায়ের চিন্তাধারা তুলে ধরত, যা অসংখ্য সাধারণ পাঠক ও শ্রোতার সঙ্গে উচ্চশিক্ষিত ও সাধারণ বাঙালির ভাবধারার মেলবন্ধন ঘটাত।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে বঙ্গদর্শন পত্রিকাটি ছিল একটি অতি জনপ্রিয় পত্রিকা। এটি বাঙালি জাতির মনে নতুন উদ্দীপনা উৎসাহ ও সমাজতান্ত্রিক ভাবধারা সঞ্চার করেছিল। যা নতুন সমাজ গঠনের পক্ষে সহায়ক হয়েছিল।
২. নতুন সামাজিক ইতিহাসের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করো।
ভূমিকাঃ প্রচলিত ইতিহাসচর্চার একটি বিকল্প ও সংশোধনবাদী ধারা হিসেবে আধুনিক ইতিহাসচর্চার একটি বিশেষ দিক হল ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে নতুন সামাজিক ইতিহাসচর্চা।
প্রেক্ষাপটঃ নতুন সামাজিক ইতিহাসচর্চার উদ্ভবের প্রেক্ষাপটে দেখা যায়—
(ক) উন্নয়নের প্রচেষ্টা : প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে উদার সমাজব্যবস্থার প্রবর্তন, জীবনযাত্রাসহ জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নের প্রচেষ্টা মানবসমাজে অগ্রগতির সূচনা করায় সমাজের নীচুতলার মানুষ গুরুত্ব লাভ করে।
(খ) আন্দোলন ও মতাদর্শের বিকাশ : ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে জাতিবিদ্বেষ, যুদ্ধবিরোধী মানসিকতা, নাগরিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের ফলে ঘটনার নতুন ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ শুরু হয়।
(গ) অবহেলিত বিষয়ে গুরুত্ব দান : ঐতিহাসিক লরেন্স ডব্লু লেভাইন তাঁর ‘Black Culture’-এর উপর গবেষণালব্ধ বইয়ের প্রথম বাক্যেই ঘোষণা করেন যে, এটাই হল সেই সময় যখন ঐতিহাসিকদের নিজস্ব চেতনা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন এবং একইভাবে দরকার গবেষণার মাধ্যমে অবজ্ঞাপ্রাপ্ত ও অবহেলিত বিষয়গুলির প্রতি গুরুত্ব দান করা।
(ঘ) ঐতিহাসিকদের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইংল্যান্ডের কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ও মার্কসবাদী মতাদর্শে বিশ্বাসী ইউরোপের ঐতিহাসিকগণ সমাজের নীচুতলা থেকে ইতিহাস রচনায় সচেষ্ট হন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক হলেন ক্রিস্টোফার হিল, এরিক জে হবসবম, প্যাট্রিক জয়েস, এডওয়ার্ড থম্পসন প্রমুখ।
উপসংহারঃ উপরোক্ত আলোচনা থেকে দেখা যায় যে, বিভিন্ন ঘটনার ফলশ্রুতি হিসেবে গড়ে ওঠা নতুন সামাজিক ইতিহাসের মূল বিষয় হল সমাজের সামগ্রিক ইতিহাস।
৩. নতুন সামাজিক ইতিহাস কী তা বিশ্লেষণ করো।
ভূমিকাঃ প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালের বিভিন্ন ঘটনা ও মতাদর্শের ফলশ্রুতি হিসেবে ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে গড়ে ওঠা নতুন সামাজিক ইতিহাসের মূল বিষয় হল সমাজের সামগ্রিক ইতিহাস।
সামাজিক ইতিহাস-এর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য হল—
(ক) সামগ্রিক সামাজিক ইতিহাস : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে সমাজের নীচুতলার মানুষ ও বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণির মানুষের ইতিহাস গুরুত্ব লাভ করে। কিন্তু পরবর্তীকালে বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে এই ইতিহাসের পরিধি বিস্তৃত হয় ও তা নতুন সামাজিক ইতিহাসরূপে পরিচিত হয়।
(খ) ঘটনা-বঞ্চনার তথ্যনিষ্ঠ অনুসন্ধান : নতুন ধরনের ও সামাজিক ইতিহাসের বিষয়গত দিক হল শ্রমিক-কৃষক ইতিহাস, লিঙ্গগত ইতিহাস, কৃষ্ণাঙ্গ ইতিহাস, অভিপ্রয়াণের ইতিহাস, যুবক ও শিশু-সহ পরিবারের ইতিহাস, গোষ্ঠী ইতিহাস, হিংসার ইতিহাস প্রভৃতি।
(গ) সংশোধনবাদ : নতুন সামাজিক ইতিহাস হল প্রচলিত রাজনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক ও সাংবিধানিক ইতিহাসের বিপরীতে এক সংশোধনবাদী ইতিহাস।
(ঘ) প্রাতিষ্ঠানিক : নতুন সামাজিক ইতিহাসচর্চার জন্য ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘দ্য সোশ্যাল সায়েন্স হিস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন’, যার মুখপত্র হল ‘সোশ্যাল সায়েন্স হিস্ট্রি’।
উপসংহারঃ নতুন সামাজিক ইতিহাস সমালোচনামুক্ত নয়। অনেকক্ষেত্রেই এই ইতিহাসে প্রচলিত ইতিহাসকে খণ্ডন করা হয় এবং নতুন তথ্য ও সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়।
৪. সামগ্রিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে খেলার ইতিহাস গুরুত্বপূর্ণ কেন ?
ভুমিকাঃ আধুনিক ইতিহাসচর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল খেলাধুলা। সুদূর প্রাচীন কাল থেকে খেলাধুলা শরীরচর্চা ও বিনোদনের মাধ্যম রূপে প্রচলিত থাকলেও বিশ শতকে খেলাধুলার ইতিহাসচর্চা বিশেষ গুরুত্ব লাভ করেছে।
খেলাধুলার গুরুত্ব—
(ক) জাতির আত্মপরিচয় : কোনো দেশের খেলাধুলা সেই দেশের জনগণের আত্মপরিচয় দান করে। এর মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ইত্যাদি ফুটে ওঠে।
(খ) জাতীয়তাবোধ বৃদ্ধি : খেলাধুলাকে কেন্দ্র করে গণ-আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এর মাধ্যমে জাতীয়তাবোধ, দেশপ্রেম ইত্যাদির প্রভাবিত হয়। 1911 খ্রিস্টাব্দে মোহনবাগান ইস্ট ইয়র্কশায়ার ক্লাবকে 2-1 গোলে হারিয়ে আই এফ এ শিল্ড জয় করে। এর মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবোধ বৃদ্ধি পায়।
(গ) পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নতি : দুটি দেশ বা একাধিক দেশের মধ্যে খেলাধুলার সূত্রে যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়, পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নতি ঘটে। ফলে আন্তর্জাতিকতাবাদের প্রসার ঘটে, পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির বাতাবরণ তৈরি হয়। এর মাধ্যমে সংকীর্ণ ও বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাবের অবসান ঘটে।
(ঘ) একতাবোধ বৃদ্ধি : আন্তর্জাতিক খেলাধুলাকে কেন্দ্র করে প্রতিটি দেশ নিজ নিজ দেশের খেলোয়াড়দের জয়ের জন্য গলা ফাটায়, বিজয়লাভের আনন্দ উপভোগ করে, এতে ঐক্যবোধ গড়ে ওঠে ও ভ্রাতৃত্ববোধ সুদৃঢ় হয়।
(ঙ) নারী অগ্রগতি : খেলাধুলায় নারীদের অংশগ্রহণ থেকে সে দেশের নারী অগ্রগতি ও নারী স্বাধীনতার কথা জানা যায়।
(চ) ভারতে খেলাধূলার ইতিহাসচর্চা : ভারতে খেলার ইতিহাস নিয়ে চর্চা শুরু হয় 1980-এর দশকে। বাংলা তথা ভারতের খেলাধুলার ইতিহাসচর্চায় যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন বোরিয়া মজুমদার, কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌতম ভট্টাচার্য, উৎপল শুভ্র, রূপক সাহা প্রমুখ।
উপসংহার : খেলাধুলার ইতিহাসচর্চা থেকে বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন সময়ের ও বিভিন্ন রকমের খেলার নাম, বিখ্যাত খেলোয়াড়দের কৃতিত্ব, বিভিন্ন খেলার কৌশল ইত্যাদির কথা জানা যায়। বিভিন্ন কারণে তাই খেলাধুলা আধুনিক ইতিহাসচর্চায় গুরুত্ব লাভ করেছে।
৫. স্থানীয় ইতিহাসচর্চার বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করো।
অথবা, স্থানীয় ইতিহাসচর্চা সম্পর্কে টীকা লেখো।
ভূমিকাঃ আধুনিক ইতিহাসচর্চার বিশেষ দিক হল স্থানীয় ইতিহাস। স্থানীয় ইতিহাস বলতে বোঝায় ভৌগোলিকভাবে স্থানীয় প্রেক্ষিতে আঞ্চলিক সম্প্রদায় বা ব্যক্তি বা বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ইতিহাস।
বিভিন্ন দিক : স্থানীয় ইতিহাসচর্চার বিভিন্ন দিককে এভাবে চিহ্নিত করা যায়—
(ক) স্থানীয় ইতিহাসের সূত্রপাত : উনিশ শতকের ইংল্যান্ডে প্রত্যন্ত এলাকাগুলোর বা শহরের ইতিহাস রচনার মাধ্যমে স্থানীয় ইতিহাস লেখা শুরু হয়। পরবর্তীকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াতেও এই ধরনের ইতিহাস রচনা শুরু হয়।
(খ) স্থানীয় বিষয় : এই ধরনের ইতিহাসচর্চায় দেশ বা ব্যাপক এলাকার পরিবর্তে ক্ষুদ্র এলাকাকে চিহ্নিত করে সেই স্থানের ইতিহাস অন্বেষণ করা হয়। এভাবে স্থানীয় ইতিহাস সমূহের সমন্বয়ে দেশের ইতিহাস গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়।
(গ) মৌখিক পরম্পরা : স্থানীয় জনশ্রুতি, মিথ বা অতিকথা, উপকথা, মৌখিক পরম্পরাকে ভিত্তি করে রচিত স্থানীয় ইতিহাস অনেকক্ষেত্রেই অলিখিত থাকে এবং এজন্যই মৌখিক পরম্পরার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
(ঘ) সমাজের ক্ষুদ্র ইতিহাস : স্থানীয় ইতিহাস রচনাকালে স্থানীয় সমাজের ক্ষুদ্র সম্প্রদায় বা ব্যক্তি বা পরিবারের ইতিহাসকে তুলে ধরে এলাকার গুরুত্ব চিহ্নিত করা হয়। তাই এই ইতিহাস হল বৃহত্তর সমাজ-ইতিহাসের ক্ষুদ্র সংস্করণ।
৬. আধুনিক ভারতের ইতিহাসচর্চার উপাদানরূপে সরকারি নথিপত্রকে কীভাবে ব্যবহার করা হয় তা বিশ্লেষণ করো।
অথবা, ইতিহাসের উপাদান হিসেবে সরকারি নথিপত্রের সীমাবদ্ধতা লেখো।
ভূমিকাঃ আধুনিক ভারতের ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল সরকারি নথিপত্র। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বড়লাট ও ভারত-সচিবের দলিলপত্র, বড়লাটের নিম্নপদস্থ রাজকর্মচারীদের রিপোর্ট বা প্রতিবেদন ও চিঠিপত্র, পুলিশ ও গোয়েন্দা রিপোর্ট প্রভৃতি।
ব্যবহার পদ্ধতি : সরকারি নথিপত্রগুলি থেকে ভূমিরাজস্ব, বিদ্রোহ, সরকারের (আর্থিক, রাজনৈতিক প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক) নীতির কথা এবং ভারতের রাজনৈতিক, আন্দোলনের কথা জানা গেলেও এইসব তথ্য সবসময় সত্যি নাও হতে পারে। তাই এক্ষেত্রে কয়েকটি সতর্কতা নেওয়া প্রয়োজন
(ক) নিরপেক্ষ ব্যাখ্যা : ব্রিটিশ আমলে সরকারি নথিপত্রগুলির অধিকাংশই সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখা হওয়ায় উপনিবেশ-বিরোধী, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও কার্যকলাপ সম্পর্কে সেগুলিতে নেতিবাচক বর্ণনাই পাওয়া যায়। তাই এইসব নথিপত্রের নিরপেক্ষ ব্যাখ্যা প্রয়োজন।
(খ) বেসরকারি তথ্যের সঙ্গে যাচাই : বেসরকারি নথি বা সাহিত্য বা আন্দোলনকারীদের জীবনস্মৃতি বা মুখের কথার মাধ্যমে সরকারি নথিপত্রগুলির বর্ণনা যাচাই করা প্রয়োজন।
(গ) সংবাদপত্রের সঙ্গে যাচাই : সংবাদপত্রের প্রতিবেদন বা রচনায় সমসাময়িক ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়। তাই এগুলি থেকে সরকারি নথির তথ্য যাচাই করা উচিত।
(ঘ) নৈর্ব্যক্তিক মানসিকতা দ্বারা যাচাই : সরকারি নথিপত্র থেকে নিরপেক্ষ ইতিহাস গড়ে তুলতে হলে নথিপত্র ব্যবহারকারীকে নিরপেক্ষ ও নৈর্ব্যক্তিক হতে হবে।
৭. ‘জীবনের ঝরাপাতা’ নামক আত্মজীবনী আধুনিক ভারতের ইতিহাসের উপাদানরূপে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বিশ্লেষণ করো।
ভূমিকাঃ সরলাদেবী চৌধুরানি তাঁর (১৮৭২-১৯৪৫ খ্রি.) আত্মজীবনী ‘জীবনের ঝরাপাতা’ থেকে ব্যক্তিজীবনের কাহিনির পাশাপাশি জাতীয় জীবনের কথাও জানা যায়। তাই আত্মজীবনীটি ভারতের আধুনিক ইতিহাসের এক মূল্যবান সূত্র।
• উপাদানরূপে গুরুত্ব : ইতিহাসের উপাদানরূপে যে-সমস্ত কারণে এই আত্মজীবনীটি গুরুত্বপূর্ণ তা হল—
(ক) ঠাকুর পরিবারের ইতিহাস : উনিশ শতকের বাংলার শীর্ষস্থানীয় মহিলা সাহিত্যিক স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যা এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাগনি সরলাদেবী তাঁর রচনার মাধ্যমে ঠাকুর পরিবারের ঐতিহ্যের নানান কথা প্রকাশ করেছেন।
(খ) রাজনৈতিক ইতিহাস : এই বই থেকে উনিশ শতকের শেষদিকের চরমপন্থী জাতীয়তাবাদের সঙ্গে জড়িত দুই তাত্ত্বিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও স্বামী বিবেকানন্দের কথা যেমন জানা যায়, আবার তেমনই, বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভূমিকা এবং সরলাদেবীর স্বদেশি ভাবধারা প্রচারের কথাও রয়েছে এই আত্মজীবনীতে।
(গ) সামাজিক ইতিহাস : এই বইয়ে অভিজাত পরিবারের কায়দাকানুন, নারীশিক্ষা, বাঙালি সংস্কৃতি ও সাহেবি সংস্কৃতি আলোচিত হয়েছে।
উপসংহারঃ তবে ‘জীবনের ঝরাপাতা’র কয়েকটি সীমাবদ্ধতা ছিল এবং একারণেই তা পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য নয়। তাই এই গ্রন্থ থেকে প্রাপ্ত তথ্যকে সমসাময়িক অন্যান্য নথিপত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যের দ্বারা যাচাই করা প্রয়োজন।
৮. ইতিহাসের তথ্য সংগ্রহে ইনটারনেট ব্যবহারের সুবিধা-অসুবিধা কী ?
উত্তরঃ ভূমিকা : ইতিহাসচর্চার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহের জন্য সাধারণ মহাফেজখানা, গ্রন্থাগার বা বিভাগীয় দপ্তর প্রভৃতি স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানগুলির পাশাপাশি আজকাল ইনটারনেট (www) থেকেও ইতিহাসের তথ্য সংগ্রহ করা যায়।
• ইনটারনেট ব্যবহারের সুবিধাগুলি হল—
(ক) তথ্যের সহজলভ্যতা : দেশবিদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গবেষণা কেন্দ্র, গ্রন্থাগার ও মহাফেজখানা, মিউজিয়াম প্রভৃতির সংগৃহীত নথিপত্র ও দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ ইনটারনেট-এ আপলোড-এর ফলে সহজেই তথ্য পাওয়া যায়।
(খ) সময় ও খরচ হ্রাস : ইতিপূর্বে তথ্য সংগ্রহ করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বা বিদেশে যেতে হত। কিন্তু এখন ঘরে বসে ইনটারনেটের মাধ্যমে তা খুব অল্প সময়ে ও অল্প খরচে পাওয়ার ফলে সময়ের অপচয় কমে ও গবেষণা খরচ হ্রাস পায়।
• ইনটারনেট ব্যবহারের অসুবিধা—
(ক) সত্যাসত্যের অনিশ্চয়তা : চাক্ষুষ নথিপত্র ঘেঁটে বা আকর গ্রন্থ পাঠ করে ইতিহাসের তথ্য সংগ্রহের সত্যতা সম্পর্কে যতটা নিশ্চিত হওয়া যায় ইনটারনেট থেকে প্রাপ্ত তথ্যে তা সম্ভব নয়।
(খ) তথ্য সূত্রের অভাব : ইনটারনেট থেকে পাওয়া তথ্য সংগ্রহের সময় তথ্যসূত্র তেমন না থাকার ফলে তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতাও থাকে না। আবার অনেক সময় ইনটারনেট-এ তথ্য সরবরাহে বিঘ্ন ঘটে; ফলে গবেষণার কাজ বাধাপ্রাপ্ত হয়।
উপসংহারঃ কোনো একটি বিষয়ে অল্প সময়ে ইনটারনেট-এ চটজলদি প্রচুর পরিমাণ কাঙ্ক্ষিত তথ্য পাওয়া গেলেও পরে আকর গ্রন্থ বা নথিপত্র থেকে তথ্যগুলি মিলিয়ে নেওয়া উচিত। এর ফলে ইতিহাস বিকৃতি ঘটে না।
৯. খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো।
ভূমিকাঃ আধুনিক ইতিহাসচর্চার বৈচিত্র্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাসচর্চা।
বৈশিষ্ট্য : খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাসচতচর্চার বৈশিষ্ট্যগুলি হল—
(ক) পৃথক খাদ্যাভ্যাসের কারণ : মানুষের রুচি ও সামর্থ্য, আবহাওয়া ও জলবায়ু, ধর্মীয় রীতি ও বিধিনিষেধ কীভাবে মানুষের পৃথক পৃথক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলে তা চিহ্নিত করা।
(খ) খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনে ঔপনিবেশিক প্রভাব : এশিয়া-আফ্রিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠার ফলে শাসক ও শাসিত উভয়েরই খাদ্যাভ্যাসে কীভাবে পরিবর্তন এসেছিল তা চিহ্নিত করা।
(গ) খাদ্যগ্রহণ ও বর্জনের কারণ : স্বাধীন মানুষেরা কেন ও কীভাবে খাদ্য গ্রহণ-বর্জন করে তা তুলে ধরা এই ইতিহাসের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। আবার ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনস্থ শাসিত ও শাসকদের খাদ্যগ্রহণ ও বর্জনকে তুলে ধরা এই ইতিহাসের আলোচ্য বিষয়।
(ঘ) খাদ্যাভ্যাস ও জাতীয়তাবাদ : উপনিবেশের জনগণ দেশজ খাদ্যাভ্যাস সংস্কৃতিকে ব্যবহার করে বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে কীভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলে তা ব্যাখ্যা করাও হল এই ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্য।
উপসংহারঃ খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাসচর্চার মাধ্যমে স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী খাবার সংক্রান্ত ইতিহাসের পাশাপাশি হাজার হাজার বছরের খাবার প্রক্রিয়াকরণ ও হারিয়ে যাওয়া খাবারের রন্ধন প্রণালীও তুলে ধরা হয়েছে। খাদ্যাভ্যাস সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে কীভাবে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে রয়েছে তাও উপলব্ধি করা সম্ভব হয়েছে।
১০. শিল্পচর্চার ইতিহাসের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করো।
উত্তরঃ ভূমিকা : শিল্পচর্চার ইতিহাসের অন্তর্গত বিষয়গুলি হল সংগীত, নৃত্য, নাটক ও চলচ্চিত্র।
শিল্পচর্চার বিভিন্ন দিক : ইউরোপে রেনেসাঁসের সময়কাল থেকেই চলচ্চিত্র ছাড়া অন্যান্য শিল্পচর্চার ইতিহাসের সূচনা হয়েছিল। এর বিভিন্ন দিকগুলি হল—
(ক) আকার বা ধরণ চিহ্নিতকরণ : শিল্পচর্চার অন্তর্গত বিষয়গুলির উদ্ভব, ধরণ ও রীতির বিবর্তনকে চিহ্নিত করে এই বিষয়গুলির ইতিহাস নির্মাণ করাই এর প্রধান উদ্দেশ্য।
(খ) নান্দনিকতা : সংগীত, নৃত্য, নাটক ও চলচ্চিত্র-এর সঙ্গে যুক্ত নান্দনিকতার বিষয়টি কীভাবে শ্রোতা ও দর্শকদের চিত্ত বিনোদনের পাশাপাশি সামাজিক ও মানসিক সংহতি গড়ে তুলেছিল তা চিহ্নিত করাই এই ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য।
(গ) প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব : শিল্পচর্চাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সংগীতকেন্দ্র, নৃত্যশালা, নাট্যকেন্দ্র বা রঙ্গমঞ্চ, সিনেমা হল এবং এইসব প্রতিষ্ঠান ও কেন্দ্রগুলির পৃষ্ঠপোষকদের চিহ্নিত করে তাঁদের অবদানের মূল্যায়ন করাও এই ইতিহাসের এক বিশিষ্ট দিক।
(ঘ) রাজনৈতিক গুরুত্ব : সংগীত, নৃত্য, নাটক ও চলচ্চিত্রের মাধ্যমে একটি দেশের সাংস্কৃতিক সত্তা প্রকাশিত হয়। এই সত্তা কীভাবে একটি দেশের রাজনৈতিক সংহতি বা স্বাধীনতা সংগ্রামকে উজ্জীবিত করে তোলে তা চিহ্নিত করাও শিল্পচর্চার ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য।
উপসংহারঃ শিল্পচর্চার সঙ্গে যুক্ত শিল্পী ও সংগঠনের অভিজ্ঞতা ও শিল্পচর্চা সম্পর্কিত পরীক্ষানিরীক্ষার মূল্যায়ন করার মাধ্যমে কলাকুশলীদের ইতিহাসও গড়ে ওঠে।
১১. পোশাক-পরিচ্ছদের ইতিহাসচর্চার মূল বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।
উত্তরঃ ভূমিকা : আধুনিক ইতিহাসচর্চার বৈচিত্র্যের একটি দিক হল পোশাক পরিচ্ছদের ইতিহাস, যা কিনা সভ্যতার বিকাশ ও বিবর্তনের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত।
বৈশিষ্ট্য : পোশাক-পরিচ্ছদের ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্যগুলি হল—
(ক) উদ্ভব ও বিবর্তন : পোশাক-পরিচ্ছদের উদ্ভব ও তার বিবর্তনকে চিহ্নিত করে মানবসভ্যতার বিকাশে তার গুরুত্বকে তুলে ধরা এবং পোশাক কীভাবে কর্তৃত্ব ও আভিজাত্যের মাপকাঠি হয়ে উঠেছিল তা ব্যাখ্যা করা এই ইতিহাসের অন্যতম উদ্দেশ্য।
(খ) পোশাকের ভিন্নতা : এই ইতিহাসচর্চায় শিল্পবিপ্লবের পূর্বের এবং শিল্পবিপ্লব ও শিল্পবিপ্লবের উত্তর পর্বের পোশাকের ধরণ ও বিন্যাসকে চিহ্নিত করা হয়। পোশাক পরিচ্ছদের ইতিহাস সমাজের অভিজাত ও সাধারণ মানুষের পোশাকের ভিন্নতার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে।
(গ) স্বাস্থ্যবিধি : আঠারো ও উনিশ শতকে ইউরোপে বিশেষত ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে নারীদের পোশাকের আঁটোসাটো ধরণ ও বাহুল্যতা ক্রমশই নারীদের শারীরিক অসুস্থতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই স্বাস্থ্যসম্মত পোশাকের উদ্ভব ও তার বিবর্তনকে চিহ্নিত করাও এই ইতিহাসের বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
(ঘ) রাজনৈতিক তাৎপর্য : আধুনিক বিশ্বে ঔপনিবেশিক শাসনপর্বে পাশ্চাত্য পোশাক কীভাবে উপনিবেশগুলিতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে তার কারণ চিহ্নিত করার পাশাপাশি দেশজ পোশাক সংস্কৃতি কীভাবে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে সংহতি দান করে তাও খুঁজে দেখে এই ইতিহাস।
উপসংহারঃ এভাবে দেখা যায়, পোশাকের ইতিহাসের সঙ্গে সমাজ-সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক ইতিহাসও যুক্ত থাকায় পোশাকের ইতিহাসচর্চার ইতিহাস সামগ্রিক ইতিহাসে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
১২. যানবাহন যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করো।
উত্তরঃ ভূমিকা : ১৯৬০ থেকে ১৯৭০-এর দশকে আধুনিক ইতিহাসচর্চার বৈচিত্র্যের অন্যতম দিক হিসেবে যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাসচর্চার সূচনা হয়।
বৈশিষ্ট্য : যানবাহন-যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাসের বৈশিষ্ট্যগুলি হল—
(ক) পরিধি : যানবাহন মূলত তিন ধরনের যথা— জল, স্থল ও আকাশপথের যানবাহন। অন্যদিকে, যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হল টেলিগ্রাফ, টেলিফোন, চিঠিপত্র, রেডিয়ো, টিভি, ফ্যাক্স, মোবাইল ফোন প্রভৃতি।
(খ) উদ্ভব ও উন্নতি : এই ইতিহাসচর্চায় চাকা আবিষ্কার থেকে শুরু করে যানবাহনের উদ্ভব ও তার বিবর্তন এবং যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার বিভিন্ন ধরণকে চিহ্নিত করা হয়। এর পাশাপাশি প্রাচীন যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার সঙ্গে সমসাময়িক যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার পার্থক্য ও অগ্রগতি চিহ্নিত করাও এই ইতিহাসচর্চার অন্যতম উদ্দেশ্য।
(গ) প্রযুক্তিগত উন্নতি : যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের মূলে থাকে যে প্রযুক্তিগত উন্নতি, সেই অগ্রগতিকে খুঁজে বের করাও এই ইতিহাসচর্চার বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
(ঘ) প্রভাব : বাণিজ্য, যাতায়াত, সাম্রাজ্যবাদের প্রসার, নগরায়ণ ও পরিবেশ প্রভৃতি ক্ষেত্রে পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভাবকে চিহ্নিত করে এই ইতিহাস বৈশিষ্ট্য।
উপসংহারঃ যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা আমাদের জীবনকে সহজ করে তুলেছে; যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাস একটি রাষ্ট্রে সংহতি ও জাতীয়তাবাদ যেমন সৃষ্টি করে, তেমনি তা আন্তর্জাতিকতাবাদের বিকাশেও সাহায্য করে।
১৩. দৃশ্য শিল্পের ইতিহাস ও তার বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করো।
উত্তরঃ ভূমিকা : আধুনিক ইতিহাসচর্চার বৈচিত্র্যের একটি দিক হল দৃশ্যশিল্পের ইতিহাস। এর প্রধান দুটি বিষয় হল ছবি আঁকা ও ফোটোগ্রাফি।
• দৃশ্য শিল্পের ইতিহাস—
মানুষ যখন তার মনের ভাব প্রকাশের জন্য রং ও তুলির মাধ্যমে কোনো দৃশ্য নির্মাণ করে, তখন তা ছবি আঁকা নামে পরিচিত। অন্যদিকে ক্যামেরার মাধ্যমে যখন কোনো বাস্তব জিনিসের ছবি তোলা হয় এবং তখন তা ফোটোগ্রাফি নামে পরিচিত। খ্রিস্টপূর্ব ৮০০০ অব্দ থেকেই গুহাচিত্র অঙ্কনের মাধ্যমে ছবি আঁকার সূচনা হয় এবং ফোটোগ্রাফির সূচনা হয় ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে।
বৈশিষ্ট্য : দৃশ্যশিল্পের ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্য আলোচনা করলে দেখা যায় যে—
(ক) দৃশ্য শিল্পের উদ্ভব ও বিবর্তন : ছবি আঁকা ও ফোটোগ্রাফির উদ্ভব এবং তার যুগ নির্ধারণ ও শ্রেণিবিভক্তিকরণের মাধ্যমে দৃশ্য-শিল্পের ইতিহাস গড়ে ওঠে। এর মাধ্যমে মানুষ ও প্রকৃতি বা পরিবেশের সম্পর্ককে চিহ্নিত করা যায়।
(খ) দৃশ্য শিল্পের সংস্কৃতিতে প্রভাব : দৃশ্যশিল্প মানবসভ্যতা ও সংস্কৃতিতে কীভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল তা চিহ্নিত করা এই ইতিহাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
(গ) দৃশ্য শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা : দৃশ্যশিল্পের ইতিহাসে শিল্পী এবং ফোটোগ্রাফার বা আলোকচিত্রীদের অভিজ্ঞতা এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকদের ইতিহাস খুঁজে বের করাও ওই ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্য।
(ঘ) দৃশ্য শিল্পের শিল্প-প্রতিষ্ঠান : দৃশ্য শিল্পের উন্নতির জন্য বিজ্ঞানসম্মত প্রশিক্ষণের লক্ষ্য নিয়ে যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান ও রীতি গড়ে উঠেছে তার ইতিহাস আলোচনাও এই ইতিহাসচর্চার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
১৪. স্থাপত্য ইতিহাস বলতে কী বোঝায় ?
অথবা, স্থাপত্য কর্মের ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলি কী কী ?
উত্তরঃ ভূমিকা : প্রাচীন স্থাপত্যগুলি হল ইতিহাসের সাক্ষী, তাই স্থাপত্যের ইতিহাস হল অনেকটাই জীবন্ত ইতিহাস।
(ক) স্থাপত্য ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য : ইউরোপে রেনেসাঁসের সময় থেকেই স্থাপত্য ও স্থাপত্য নির্মাণকার্যে যুক্ত কারিগরদের সম্পর্কে স্থাপত্যের ইতিহাস লেখার কাজ শুরু হয়। এর বৈশিষ্ট্যগুলি হল—
(খ) স্থাপত্য প্রতিষ্ঠাকাল : স্থাপত্যের ইতিহাসে মূলত ধর্মীয়, প্রশাসনিক বা নান্দনিকতার উদ্দেশ্যে নির্মিত স্থাপত্যগুলির প্রতিষ্ঠাকাল ও প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যগুলি চিহ্নিত করা হয়।
(গ) স্থাপত্য ইতিহাস নির্মাণ : স্থাপত্যগুলির মাধ্যমে অতীত ও বর্তমান যুক্ত থাকে বলে স্থাপত্যগুলির প্রতিষ্ঠাকাল থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত সময়ের ইতিহাস রচনায় এগুলির ভূমিকা তুলে ধরা হয়।
(ঘ) স্থাপত্য রীতি : প্রতিটি পৃথক স্থাপত্য রীতির বৈশিষ্ট্য, বিবর্তন ও তার ধারাবাহিকতা তুলে ধরা এই ইতিহাসের বিশেষ লক্ষণ। এ প্রসঙ্গে ইউরোপের স্থাপত্যে ডোরীয় রীতি, গথিক রীতি, রোমান ও ভিক্টোরীয় রীতির কথা বলা যায়।
(ঙ) স্থাপত্য জাতীয় গর্ব : বিভিন্ন দেশের সেরা স্থাপত্যগুলি কীভাবে সেই দেশের মর্যাদা বৃদ্ধি করে বা জাতীয় আন্দোলনে উৎসাহের সঞ্চার করে তা তুলে ধরাও এই ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য।
উপসংহারঃ স্থাপত্যের ইতিহাসচর্চার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতির ইতিহাসও জড়িয়ে থাকায় স্থাপত্য ইতিহাস সামগ্রিক ইতিহাসের একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
১৫. শহরের ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্যগুলি কীভাবে বিশ্লেষণ করবে ?
উত্তরঃ ভূমিকা : ১৯২০-র দশক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শহর-ইতিহাসচর্চা শুরু হয় এবং ১৯৬০-র দশক থেকে এই ইতিহাসচর্চায় জোয়ার দেখা দেয়। শহর ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্যগুলি হল—
(ক) শহরের উদ্ভব ও অবক্ষয় : কেন ও কীভাবে শহরের উদ্ভব ঘটে এবং শহরের প্রসার ও তার অবক্ষয়কে চিহ্নিত করাই হল শহরের ইতিহাসচর্চার প্রধানতম দিক। তাই এই ধরনের ইতিহাসচর্চায় গড়ে ওঠা শহর বা অবক্ষয়প্রাপ্ত শহর বা মহানগরকে গবেষণার জন্য বেছে নেওয়া হয়।
(খ) শহর-সংস্কৃতি : শহরের বাসিন্দা ও তাদের বিন্যাস, শহরে অভিপ্রয়াণের ইতিহাস এবং তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকলাপকে চিহ্নিত করে শহরের বিবর্তনকে চিহ্নিত করা শহর ইতিহাসচর্চার বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
(গ) শহরের ভূগোল : শহর-ইতিহাসচর্চায় শহরের ভৌগোলিক অবস্থান এবং সামরিক ও বাণিজ্যিক গুরুত্বকে চিহ্নিত করা হয়। এগুলি শহরের ইতিহাস ও নাগরিক জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত।
(ঘ) শহরের স্থাপত্য : শহরে নাগরিকদের বাসস্থান, প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র নির্মাণ, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ, খেলা ও অবসর বিনোদনের জন্য স্টেডিয়াম ও পার্ক নির্মাণকে কেন্দ্র করে স্থাপত্য নির্মাণ করা হয়। তাই শহরের ইতিহাসের সঙ্গে স্থাপত্য-ইতিহাসও জড়িয়ে পড়ে।
উপসংহারঃ শহরের ইতিহাস শুধুমাত্র শহরের উদ্ভব ও অবক্ষয়কে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয় না, বরং তার সঙ্গে সামাজিক, আর্থ-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকে।
১৬. পরিবেশের ইতিহাসচর্চার গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তরঃ পরিবেশের অর্থাৎ প্রকৃতি জগতের সঙ্গে মানবসমাজের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ইতিহাসই হল পরিবেশের ইতিহাস। ইতিহাসের বিভিন্ন দিকগুলি হল—
(ক) পৃথিবী সৃষ্টির কাল থেকে মানুষের আবির্ভাব এবং পশুশিকারি জীবন থেকে আধুনিক মানবসভ্যতার উদ্ভবের পিছনে পরিবেশের ভূমিকা ও অবদানকে চিহ্নিত করাই এই ইতিহাসের মূল বৈশিষ্ট্য।
(খ) ১৯৭০-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পরিবেশ সংক্রান্ত আলোচনা থেকেই পরিবেশের ইতিহাসচর্চা শুরু হয়েছে; এই ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত গবেষকরা হলেন— র্যাচেল কারসন, ডেভিড আরনল্ড, রামচন্দ্র গুহ, মাধব গ্যাডগিল, রিচার্ড গ্রোভ, স্যামুয়েল পি. হাইজ, আলফ্রেড ডব্লিউ ক্রুস।
(গ) পরিবেশ আন্দোলন : পরিবেশ ইতিহাসচর্চার একটি দিক হল পরিবেশ সংক্রান্ত আন্দোলন ও পরিবেশ সংরক্ষণ। পাশ্চাত্য দেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গড়ে ওঠা এইসব আন্দোলনের মধ্যে ভারতের ‘তেহেরি গাড়োয়াল’, ‘চিপ্কো আন্দোলন’, নর্মদা আন্দোলনের কথা বলা যায়।
পরিবেশের ইতিহাসচর্চার গুরুত্বগুলি হল—
(ক) মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে পরিবেশের ভূমিকা চিহ্নিত করে পরিবেশ সচেতনতা ও পরিবেশ রক্ষার ব্যবস্থা করা।
(খ) পরিবেশ সংকট ও তার প্রকৃতি, পরিবেশ বিপর্যয় ও তার ভয়াবহতা, বাস্তুতন্ত্র ও বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণ, অরণ্য ও অরণ্যপ্রাণী সংরক্ষণ সম্পর্কে সম্যক ধারণা ও তার প্রয়োগের ব্যবস্থা করা।
(গ) পরিবেশের ইতিহাসের সঙ্গে অন্যান্য ইতিহাসের যোগসূত্র নির্ধারণ করা।
১৭. বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্যগুলি বিশ্লেষণ করো।
উত্তরঃ ভূমিকা : বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের বিকাশ, প্রযুক্তির উদ্ভব ও তার অগ্রগতি এবং চিকিৎসাবিদ্যার অগ্রগতিই বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাসচর্চা নামে পরিচিত।
বৈশিষ্ট্য : বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্যগুলি হল—
(ক) জ্ঞানচর্চার ইতিহাস : প্রকৃতি ও মানব শারীরতত্ত্ব সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ, গবেষণা ও তার ব্যাখ্যার ফলেই তত্ত্বগত ও ব্যাবহারিক জ্ঞানের উন্মেষ ঘটেছে বলে এই ইতিহাস হল বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিদ্যা সম্পর্কিত জ্ঞানচর্চার ইতিহাস।
(খ) অগ্রগতি উপস্থাপন : এই ধরনের ইতিহাসচর্চায় ইউরোপের রেনেসাঁস পর্বের পরবর্তীকাল থেকে বিংশ শতক পর্যন্ত সময়ের বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, শারীরজ্ঞান ও চিকিৎসাবিদ্যার অগ্রগতি পরিমাপ করা হয়।
(গ) মানবসভ্যতায় প্রভাব : বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিদ্যা কীভাবে মানবসমাজ ও সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করেছে এবং দেশের অর্থনৈতিক, সামরিক ও চিকিৎসা ক্ষেত্রকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে তা আলোচনা করাই এই ইতিহাসের উদ্দেশ্য।
(ঘ) মানবসভ্যতা থেকে যন্ত্রসভ্যতা : মানুষ তার বুদ্ধি ও শ্রমকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রশস্ত্র, যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির উন্নতি ঘটায়। প্রযুক্তির অগ্রগতিকে চিহ্নিত করে মানবসভ্যতার যন্ত্রসভ্যতায় উত্তরণকে ব্যাখ্যা করা এই ইতিহাসের বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
উপসংহারঃ বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাসচর্চা আধুনিক ইতিহাসচর্চার এক বিশেষ অঙ্গরূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে। এমনকি সাধারণ ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রেও বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ব্যবহার বাধ্যতামূলক।
১৮. বিপিনচন্দ্র পালের আত্মচরিত ‘সত্তর বৎসর’ কীভাবে ভারতের আধুনিক ইতিহাসের উপাদান হয়ে উঠেছে তা বিশ্লেষণ করো।
অথবা, আধুনিক ভারতের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে বিপিনচন্দ্র পালের ‘সত্তর বৎসর’ নামক আত্মজীবনী গ্রন্থের গুরুত্ব কী ?
উত্তরঃ ভূমিকা : ভারতের জাতীয়তাবাদী ও চরমপন্থী নেতা বিপিনচন্দ্র পালের আত্মজীবনী ‘সত্তর বৎসর’-এ ১৮৫৮-১৮৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালের পরিস্থিতি বর্ণিত হয়েছে। ফলে এটি আধুনিক ভারতের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ গৌণ উপাদান।
উপাদানের বিভিন্ন দিক : ‘সত্তর বৎসর’ থেকে ইতিহাসের যে দিকগুলো জানা যায় তা হল—
(ক) গ্রাম ও শহরের কথা : এই গ্রন্থ থেকে বিপিনচন্দ্র পালের বংশ ও পারিবারিক ইতিহাস, বাখরগঞ্জ, ফেঁচুগঞ্জ, শ্রীহট্ট, হবিগঞ্জ-এর মতো গ্রামের পাশাপাশি তৎকালীন কলকাতা শহরের ইতিহাসও জানা যায়।
(খ) সংস্কৃতি : ‘সত্তর বৎসর’ থেকে গ্রামীণ সংস্কৃতি অর্থাৎ দোল-দুর্গোৎসব, যাত্রাগান ও পুরাণপাঠ, বিবাহ প্রথা-র পাশাপাশি কলকাতার তৎকালীন সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস ও বিধিনিষেধ, মদ্যপান ও মদ্যপান নিবারণী সমিতির কথাও জানা যায়।
(গ) ব্রাহ্মসমাজের রাজনৈতিক আদর্শ : তিনি দেখিয়েছেন ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালিরা নতুন সামাজিক আদর্শের সন্ধান পেয়েছিল। তৎকালীন ব্রাহ্মসমাজও এই শিক্ষিত বাঙালিদের মধ্যে স্বাধীনতার আদর্শের সঞ্চার করেছিল।
(ঘ) ভারতসভা ও হিন্দুমেলা : ‘সত্তর বৎসর’ থেকে আনন্দমোহন বসু ও সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর নেতৃত্বে ছাত্রসভা বা স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন’ ও ‘ভারতসভা’ গঠনের কথা এবং নবগোপাল মিত্র ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘হিন্দুমেলা’ নামক জাতীয়তাবাদী প্রতিষ্ঠানের কথাও জানা যায়।
উপসংহারঃ বিপিনচন্দ্র পালই প্রথম ব্যক্তিত্ব যিনি তাঁর আত্মজীবনীতে ‘দেশকথা’কে তুলে ধরেছেন। তবে তাঁর এই দেশকথাতে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে।
১৯. আধুনিক ভারতের ইতিহাসের উপাদানরূপে ‘জীবনস্মৃতি’র গুরুত্ব বিশ্লেষণ করো।
অথবা, ইতিহাসের উপাদান হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জীবনস্মৃতি’ গুরুত্বপূর্ণ কেন ?
উত্তরঃ ভূমিকা : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত ‘জীবনস্মৃতি’ নামক আত্মজীবনীটি একটু ভিন্ন ধরনের, কারণ এই গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ তাঁর আত্মগঠনের প্রক্রিয়া বর্ণনা করেছেন। তাই আধুনিক ভারতের ব্যক্তি-ইতিহাস রচনার উপাদানরূপে এই গ্রন্থটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
জীবনস্মৃতির গুরুত্ব’ : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত ‘জীবনস্মৃতি’র গুরুত্বগুলি হল—
(ক) বাল্যকথা : এই গ্রন্থ থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটোবেলার ‘শিক্ষারম্ভ’, ওরিয়েন্টাল সেমিনারির শিক্ষাব্যবস্থা এবং নর্মাল স্কুল ও সেখানকার শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে জানা যায়।
(খ) ধর্মীয় পরিবেশ : রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একজন ব্রাহ্ম নেতা; রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হন। তাঁর এই রচনার মাধ্যমে গায়ত্রীমন্ত্র ও ‘ব্রহ্মসংগীত’-এর কথা এবং ব্রাহ্মধর্মের আত্মসমালোচনাও জানা যায়।
(গ) ঠাকুরবাড়ির পরিমণ্ডল : ‘জীবনস্মৃতি’ থেকে ঠাকুর পরিবারের পারিবারিক ঐতিহ্য, সাহিত্য, কাব্য-নাটক ও চিত্রকলার চর্চার কথা যেমন জানা যায়, তেমনই, এর পাশাপাশি জাতীয়তাবাদের বিকাশে ঠাকুরবাড়ির অবদানও পরিলক্ষিত হয়।
(ঘ) স্বাদেশিকতা : রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই স্মৃতিকথায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে এবং রাজনারায়ণ বসুর সভাপতিত্বে পরিচালিত একটি স্বাদেশিকতা সভার কথা বলেছেন। এর পাশাপাশি ঠাকুরবাড়ির সাহায্যে নবগোপাল মিত্রের ‘হিন্দুমেলা’র প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বলেও তিনি অভিমত প্রকাশ করেন।
উপসংহারঃ জীবনস্মৃতি ছিল উনিশ শতকের শেষ তিরিশ বছরের বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতির এক অনবদ্য ভাষ্য।
২০. ইন্দিরা গান্ধিকে লেখা জওহরলাল নেহরুর চিঠি (Letters from a Father to His Daughter) থেকে কীভাবে আধুনিক ভারতের ইতিহাসের উপাদান পাওয়া যায় ?
উত্তরঃ ভূমিকা : আধুনিক ভারতের ইতিহাসের অন্যতম উপাদান হল চিঠিপত্র এবং এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ইন্দিরা গান্ধিকে লেখা জওহরলাল নেহরুর চিঠি (Letters From a Father to His Daughter)।
ইতিহাসের উপাদান : প্রবাদপ্রতিম জাতীয় নেতা জওহরলাল নেহরুর লেখা চিঠিগুলি থেকে আধুনিক ভারতের ইতিহাসের যে সমস্ত উপাদান পাওয়া যায় সেগুলি হল—
(ক) চিঠিপত্র সেন্সর : গ্রন্থটির ভূমিকা থেকে জওহরলাল নেহরুর স্বাধীনতা সংগ্রাম ও কারাবরণের কথা ছাড়াও জানা যায়, সেসময় কারাগারে জেলবন্দির ঘন ঘন চিঠি লেখা যেত না।
(খ) অর্থনৈতিক দুর্দশা : জওহরলাল নেহরুর চিঠিপত্র থেকে ভারতের অর্থনৈতিক বৈষম্য, ধনী ঘরে উদ্বৃত্ত খাদ্য ও গরিবদের মধ্যে খাদ্যসংকটের কথা জানা যায়। তিনি অর্থনৈতিক বৈষম্যের দূরীকরণে ‘খদ্দর’ কিনে পরার কথা প্রচার করেন এবং এভাবে গরিব তাঁতিদের অর্থনৈতিক দিক দিয়ে উন্নত করার কথা বলেন।
(গ) দেশীয় রাজ্যগুলির পরিস্থিতি : জওহরলাল নেহরুর চিঠিপত্র থেকে ভারতীয় প্রজাদের অর্থে দেশীয় রাজাদের বিলাসব্যসন ও শৌখিন গাড়ি চড়ার কথা যেমন জানা যায়, তেমনি এই সমস্ত প্রজাদের অন্নকষ্ট, শিক্ষার অভাব ও চিকিৎসার অভাবের কথাও জানা যায়।
উপসংহার : জওহরলাল নেহরুর অন্যবদ্য চিঠিপত্রগুলির সাহিত্যিক মূল্য অপরিসীম। এ ছাড়া ঔপনিবেশিক শাসনে ভারত ও ভারতবাসীর বেদনাদায়ক পরিস্থিতি চিঠিপত্রের মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে।
২১. আধুনিককালে নারী ইতিহাসচর্চা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
অথবা, নারী ইতিহাসের ওপর একটি টীকা লেখ।
ভূমিকা : সভ্যতা-সংস্কৃতির বিকাশে নারীর ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হলেও পুরুষশাসিত সমাজে নারীরা হয়েছে অবহেলিত। যুগে যুগে নারীর ভূমিকা কী ছিল তার চর্চা বর্তমান কালে শুরু হয়েছে। নারীর গুরুত্বকে তুলে ধরার ইতিহাসচর্চাই হল নারী ইতিহাসচর্চা। 1970-এর দশকে একদল ঐতিহাসিক উপলব্ধি করেন নারীদের যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি। তাদের মর্যাদা ও অবস্থানের পর্যালোচনা প্রয়োজন। আমেরিকা ও ব্রিটেনে নারীবাদী চর্চার সূত্রপাত ঘটে। বর্তমানে ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নারী ইতিহাস চর্চা বিশেষ গুরুত্বলাভ করেছে।
আধুনিককালে নারী ইতিহাসচর্চার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল—
(i) পুরুষকেন্দ্রিক ইতিহাস সংশোধন : সভ্যতার ইতিহাসে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিলেও নারী তার প্রাপ্য ও যোগ্য সম্মান পায়নি। অবহেলিত, উপেক্ষিত নারীর সম্মান পুনরুদ্ধার করার এবং পুরুষকেন্দ্রিক ইতিহাস সংশোধন করাই নারী ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্য।
(ii) অধিকার ও সমতা প্রতিষ্ঠা : নারী ইতিহাসচর্চার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল নারীর অধিকার আদায় করা ও নারী-পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করা।
(iii) নারী নির্যাতনের অবসান : যুগে যুগে দেশে দেশে নারীরা হয়েছে নির্যাতনের, অত্যাচারের ও সামাজিক কুপ্রথার শিকার। নারী ইতিহাসচর্চার মাধ্যমে নারী নির্যাতনের অবসান ঘটানো এর বৈশিষ্ট্য।
(iv) সামাজিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ : কোনো সমাজের প্রকৃত অবস্থা বোঝা যায় সেই সমাজের নারীর অবস্থা থেকে। কোনো দেশে নারীরা কতটা সামাজিক, আর্থিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার ভোগ করে সে দেশের নারী ইতিহাসচর্চা থেকেই তা জানা যায়।
নারী সমাজের ইতিহাসের গুরুত্ব : নারী ইতিহাস বিভিন্ন দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। যেমন—
(i) এ যে বিষয়গুলি উপেক্ষিত ছিল এখন তা গুরুত্ব সহকারে চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে। পারিবারিক ক্ষেত্রে হিংসাত্মক কার্যকলাপ, শিশুর উপর নিপীড়ন, বধূহত্যা, নারী নির্যাতন ও অন্যান্য অত্যাচার প্রভৃতির কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।
(ii) লিঙ্গবৈষম্য, পারিবারিক সম্পর্ক ও সামাজিক ব্যবস্থার কথা তুলে ধরে নারী ইতিহাস।
(iii) নারীর ক্ষমতায়ন ও দক্ষতার উপর আলোকপাত করে এবং
(iv) বিভিন্ন যুগে নারীর মানসিক, সামাজিক ও নৈতিক অবস্থার কথা তুলে ধরে।
এই ভাবেই নারীদের ক্ষমতায়ন ও দক্ষতার পরিচয় নারী ইতিহাস চর্চায় স্থান লাভ করেছে।
দশম শ্রেণীর সমস্ত বিষয়ের সমস্ত অধ্যায়ের সমস্ত প্রশ্ন উত্তর দেন
এত তাড়াতাড়ি দিতে পারবো না রে ভাই। রেডি করবো তারপর তো দেবো।