জয় গোস্বামীর নুন কবিতা, সারাংশ, MCQ, SAQ ও বড় প্রশ্ন উত্তর | Noon Kobitar Question Answer [WBCHSE]

WhatsApp Channel Join Now
Telegram Group Join Now

  কবিতা— নুন
—জয় গোস্বামী

আমরা তো অল্পে খুশি,
কী হবে দুঃখ করে?
আমাদের দিন চলে যায়
সাধারণ ভাতকাপড়ে।

চলে যায় দিন আমাদের
অসুখে ধারদেনাতে
রাত্তিরে দুভায়ে মিলে
টান দিই গঞ্জিকাতে।

সবদিন হয়না বাজার,
হলে হয় মাত্রাছাড়া –
বাড়িতে ফেরার পথে
কিনে আনি গোলাপচারা।

কিন্তু পুঁতব কোথায়?
ফুল কি হবেই তাতে?
সে অনেক পরের কথা
টান দিই গঞ্জিকাতে।

আমরা তো অল্পে খুশি,
কী হবে দু : খ করে?
আমাদের দিন চলে যায়
সাধারণ ভাতকাপড়ে।

মাঝে মাঝে চলেও না দিন
বাড়ি ফিরি দুপুররাতে ;
খেতে বসে রাগ চড়ে যায়
নুন নেই ঠান্ডা ভাতে।

রাগ চড়ে মাথায় আমার
আমি তার মাথায় চড়ি,
বাপব্যাটা দুভায়ে মিলে
সারা পাড়া মাথায় করি।

করি তো কার তাতে কী?
আমরা তো সামান্য লোক।
আমাদের ভাতের পাতে
লবণের ব্যবস্থা হোক।

কবি পরিচিতিঃ নুন কবিতাটি লিখেছেন আধুনিক সময়ের একজন উল্লেখযোগ্য কবি জয় গোস্বামী(১৯৫৪-)। কবির বিখ্যাত কবিতা সংকলনগুলি হল ‘প্রত্নজীব’, ‘ঘুমিয়েছ ঝাউপাতা?”, ‘পাগলী তোমার সঙ্গে’ ইত্যাদি। ‘যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল’ কাব্য- উপন্যাসটি কবির একটি উল্লেখযোগ্য রচনা।

উৎসঃ কবিতাটি কবির ‘ভুতুমভগবান’ কবিতা সংকলন থেকে নেওয়া হয়েছে।

কবিতাটির গদ্যরূপঃ কবিতাটি উত্তম পুরুষের জবানিতে লিখিত। অর্থাৎ, বক্তা আমি / আমরা দিয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করেছে। এখানে বক্তাকে ‘কবি’ না বলে ‘কথক’ বলাই ভালো। এবার দেখে নেওয়া যাক ‘নুন’ কবিতার কথকের বক্তব্যটা কী ?

কবিতার শুরুতেই কথক নিজেদের মানসিকতা স্পষ্ট করে দিয়ে বলেছে যে তারা অল্পেই খুশি। এজন্য তাদের দুঃখ নেই। সাধারণ অন্ন-বস্ত্রে তাদের দিন কেটে যায়। তাদের দিন চলে যায়। অসুখ হলে একটু অসুবিধা হয়; ধারদেনা করে বহুকষ্টে সংসার চলে। অভাবের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে নেশা করার ঝোঁক। রাতের বেলা দু’ভাইয়ে মিলে গঞ্জিকাতে টান দেয়। বলে রাখা ভালো, এখানে দুই ভাই মানে যে কথকের সহোদর, এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। হতে পারে সে কথকের নিজের ভাই, অথবা, কথকের মতোই আরেকজন অভাবী মানুষ

সবদিন তাদের রোজগার হয় না, তাই সবদিন বাজারও হয় না। তবে, যেদিন একটু বেশি রোজগার হয়, সেদিন মাত্রাছাড়া বাজার করা হয়। প্রয়োজনীয়- অপ্রয়োজনীয় কিছুই বাদ যায় না সেদিন। নিজেদের থাকার মতো ভালো জায়গা নেই তার উপর বাজার থেকে কিনে নিয়ে আসে গোলাপের চারা।

গোলাপের চারা তো এল, কিন্তু কোথায় সেটা পোঁতা হবে? কারণ, গোলাপ তো ফুলের রানী, গরিবের ঝুপড়ি বস্তিতে তাকে রাখবে কোথায়? আর যদি একটু ভালোমতো জায়গা দেখে চারাটা পোঁতাই হয়, তাকে তো নিয়মিত পরিচর্যা করতে হবে। সুতরাং প্রশ্ন একটা থেকেই যায়- “ফুল কি হবেই তাতে”? সেটা অবশ্য পরের কথা। এখন এতসব না ভেবে টান দেয় গঞ্জিকাতে। আসলে এই নেশা হল তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।

এই জীবনেই তারা সন্তুষ্ট। কথকের মতে, “আমরা তো এতেই খুশি”। এর বেশি তাদের চাওয়ার নেই। ‘হেসে, খেলে, কষ্ট করে’ কোনোমতে তাদের দিন কেটে যায়। কিন্তু কারো সবদিন সমান যায় না। ‘দিন- আনি-দিন-খাই’-এর সংসারে কোনোদিন উপার্জন না হলে সংসারের চাকাটা হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। কথক হতাশার সুরে বলে- “মাঝে মাঝে চলেও না দিন”। কাজ নেই, হাতে টাকাও নেই। পেটভর্তি খিদে নিয়ে দুপুররাতে বাড়ি ফিরে আসে। রাতে ভাত খেতে বসে যখন দেখে যে ঠান্ডা ভাতে নুনটুকুও নেই, তখন সে আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না। ক্ষুধার জ্বালা আর নিত্য-অভাব মাথা বিগড়ে দেয় তার, রাগে ফেটে পড়ে সে।

আসলে ‘নুন’ তো শুধু লবণ নয়, নুন হল বেঁচে থাকার ন্যূনতম রসদ। সেটুকুও যখন জুটছে না, তখন রাগ হওয়াই স্বাভাবিক পেটে খিদে আছে, তাই রাগের মাত্রা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। সেই কথাটিই কবিতায় সুন্দরভাবে বলা হয়েছে- “রাগ চড়ে মাথায় আমার, আমি তার মাথায় চড়ি”- অর্থাৎ, উত্তরোত্তর রাগ বাড়তেই থাকে। এরপর ঘরের কথা আর ঘরে থাকে না, সারা পাড়া জানাজানি হয়ে যায়। “বাপব্যাটা দু-ভাই মিলে” চেঁচিয়ে সারা পাড়া মাথায় করে। এখন প্রশ্ন হতে পারে, বাপ আর ব্যাটা দু’ভাই হয় কী করে? এটা আসলে রাগের বহিঃপ্রকাশ। রাগলে মানুষের বাহ্যিক জ্ঞান লোপ পায়, সেইজন্য ‘বাপব্যাটা দু-ভাই’ বলা হয়েছে।

ঘরের অভাবের কথা বাইরের লোক শুনল, তাদের কিন্তু এতে কোনো আক্ষেপ নেই। দুপুররাতে সারা পাড়া মাথায় করেছে, এটা ভেবে যদি কেউ বিরক্ত হয়, তাতেও কিছু যায় আসে না। কথকের সাফ জবাব- “করি তো কার তাতে কী?” তারা তো নিতান্তই সামান্য লোক, তাই তাদের চাহিদাটাও সামান্য। কবিতার শেষে কথক কোনোরকম রাখঢাক না করে দাবি জানিয়েছে- “আমাদের শুকনো ভাতে লবণের ব্যবস্থা হোক।” এই দাবি সমাজের উঁচুতলার মানুষের কাছে।

• MCQ প্রশ্ন ও উত্তর—

১. নুন কবিতাটি কার লেখা ?
(ক) সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
(খ) শক্তি চট্টোপাধ্যায়
(গ) জয় গোস্বামী
(ঘ) অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত

উত্তরঃ (গ) জয় গোস্বামী

২. জয় গোস্বামী কত সালে জন্মগ্রহণ করেন ?
(ক) ১৯৫০ (খ) ১৯৪৫ (গ) ১৯৫৪ (ঘ) ১৯৫৮

উত্তরঃ (গ) ১৯৫৪

৩. জয় গোস্বামীর শিক্ষাগত যোগ্যতা কত দূর ?
(ক) দশম (খ) নবম (গ) দ্বাদশ (ঘ) একাদশ

উত্তরঃ (ঘ) একাদশ

৪. কোন কাব্যগ্রন্থের জন্য জয় গোস্বামী আনন্দ পুরষ্কার পান ?
(ক) ঘুমিয়েছো ঝাউপাতা
(খ) নীল দিগন্ত
(গ) ক্রিসমাস ও শীতের সনেটগুচ্ছ
(ঘ) ভূতুমভগবান

উত্তরঃ (ক) ঘুমিয়েছো ঝাউপাতা

৫. কোন কাব্যগ্রন্থের জন্য কবি সাহিত্য একাদেমি পুরষ্কার পান ?
(ক) ঘুমিয়েছো ঝাউপাতা
(খ) নীল দিগন্ত
(গ) পাগলি তোমার সঙ্গে
(ঘ) ভূতুমভগবান

উত্তরঃ (গ) পাগলি তোমার সঙ্গে

৬. জয় গোস্বামীর একটি উপন্যসের নাম কি ?
(ক) পিতা (খ) মাতা (গ) সন্তান (ঘ) পুত্র

উত্তরঃ (ক) পিতা

৭. নুন কবিতাটি কোন কাব্যগ্রন্থ থেকে গৃহীত হয়েছে ?
(ক) ভাত (খ) ঘুমিয়েছো ঝাউপাতা
(গ) মানুষ (ঘ) ভূতুমভগবান

উত্তরঃ (ঘ) ভূতুমভগবান

৮. ভূতুমভগবান কাব্যগ্রন্থটি কত সালে প্রকাশিত হয় ?
(ক) ১৯৮৮ খ্রীঃ (খ) ১৯৯০ খ্রীঃ
(গ) ১৯৮০ খ্রীঃ (ঘ) ১৯৭৫ খ্রীঃ

উত্তরঃ (খ) ১৯৯০ খ্রীঃ

৯. নুন কবিতাটি প্রথম কোন জেলার ছোট পত্রিকাতে প্রকাশিত হয় ?
(ক) মুর্শিদাবাদ (খ) নদীয়া (গ) ২৪ পরগনা
(ঘ) কোচবিহার

উত্তরঃ (খ) নদীয়া

১০. ভূতুমভগবান কাব্যগ্রন্থটি কবি কাকে উৎসর্গ করেছিলেন ?
(ক) সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (খ) অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত
(গ) ডা. জয়ন্ত সেন (ঘ) অশোক রাহা

উত্তরঃ (গ) ডা. জয়ন্ত সেন

১১. বেঁচে থাকবার জন্য প্রাথমিক ভাবে মানুষের কি প্রয়োজন ?
(ক) অন্ন বস্ত্র বাসস্থান (খ) খাদ্য পোশাক
(গ) জল অন্ন (ঘ) বাসস্থান

উত্তরঃ (ক) অন্ন বস্ত্র বাসস্থান

১২ . কবিতা কথকের চাহিদা কেমন ?
(ক) বেশি (খ) মাঝারি (গ) যৎসামান্য (ঘ) সীমাহীন

উত্তরঃ (গ) যৎসামান্য

১৩. কবিতার কথক বাঁচবার জন্য কোন দুটি বিষয়ের উপর জোর দিয়েছেন ?
(ক) অন্ন-বস্ত্র (খ) জল-বাসস্থান (গ) অন্ন-বাসস্থান (ঘ) বস্ত্র-জল

উত্তরঃ (ক) অন্ন-বস্ত্র

১৪. কীভাবে তাদের দিন চলে ?
(ক) মহা সুখে (খ) দুঃখে
(গ) অসুখ আর ধার দেনাতে
(ঘ) কান্নাকাটি করে

উত্তরঃ (গ) অসুখ আর ধার দেনাতে

১৫. ‘আমরা তো অল্পে খুশি’- আমরা বলতে কারা ?
(ক) সমাজের অবহেলিত সাধারণ মানুষ
(খ) কবির পরিবার
(গ) সমাজের সমস্ত শ্রেনির মানুষ
(ঘ) উচ্চ সমাজের মানুষ

উত্তরঃ (ক) সমাজের অবহেলিত সাধারণ মানুষ

১৬. আমাদের দিন চলে যায়……।
(ক) সাধারণ ভাত-কাপড়ে (খ) তামাশা করে
(গ) নেচে-গেয়ে (ঘ) ঘুরে বেড়িয়ে

উত্তরঃ (ক) সাধারণ ভাত-কাপড়ে

১৭. কিন্তু পুঁতব কোথায় ?- কি পুঁতব কথা বলা হয়েছে ?
(ক) জুঁই চারা (খ) গোলাপ চারা
(গ) লাউ গাছের চারা
(ঘ) তুলসীগাছের চারা

উত্তরঃ (খ) গোলাপ চারা

১৮. কবিতার কথক নিজেদেরকে কি করতে নিষেধ করেছেন ?
(ক) আনন্দ (খ) দুঃখ (গ) হাসতে (ঘ) খেলতে

উত্তরঃ (খ) দুঃখ

১৯. ‘আমরা তো অল্পে খুশি’- অল্পে খুশি থাকার কারণ কি ?
(ক) কারণ তাদের আকাঙ্ক্ষা খুবই সামান্য
(খ) তারা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি খরচ করে বলে
(গ) তারা গঞ্জিকা সেবন করে বলে
(ঘ) ধারদেনাতে তাদের দিন চলে যায় বলে

উত্তরঃ (ক) কারণ তাদের আকাঙ্ক্ষা খুবই সামান্য

২০. ‘চলে যায় দিন আমাদের’- আমাদের দিন কিভাবে চলে যায় ?
(ক) গঞ্জিকা সেবন করে
(খ) সাধারণ ভাত-কাপড়ে
(গ) আমরা দুই ভাই মিলে ঝগড়া করে
(ঘ) অসুখে ধার-দেনাতে

উত্তরঃ (ঘ) অসুখে ধার-দেনাতে

২১. রাতে দুই ভাই মিলে কি করে ?
(ক) আফিম খায় (খ) সিগারেট খায়
(গ) ঘুরে বেড়ায় (ঘ) গঞ্জিকা টানে

উত্তরঃ (ঘ) গঞ্জিকা টানে

২২. নুন কবিতায় সবদিন সাধারণ মানুষের কি না হওয়ার কথা বলা হয়েছে ?
(ক) বাজার (খ) ঝগড়া (গ) অশান্তি
(ঘ) খাবার

উত্তরঃ (ক) বাজার

২৩. বাড়ি ফেরার পথে কি কিনে আনা হয় ?
(ক) পাখির খাঁচা (খ) ফুলের টব
(গ) ফুলের তোড়া (ঘ) গোলাপ চারা

উত্তরঃ (ঘ) গোলাপ চারা

২৪. ‘সে অনেক পরের কথা’- কোন বিষয়টা অনেক পরে কথা ?

(ক) ধারের টাকা শোধ হবে কিনা
(খ) ঠান্ডা ভাতে নুন হবে কিনা
(গ) গোলাপ চারায় ফুল ফুটবে কিনা
(ঘ) রাত্রে গঞ্জিকা টাকা হবে কিনা

উত্তরঃ (গ) গোলাপ চারায় ফুল ফুটবে কিনা

২৫. মাঝে মাঝে চলেও না দিন,বাড়ি ফিরি…।
(ক) সকালবেলায় (খ) দুপুর রাতে
(গ) ভরদুপুরে (ঘ) ভোরবেলা

উত্তরঃ (খ) দুপুর রাতে

২৬. ‘খেতে বসে রাগ চলে যায়’-রাগ চড়ে যাওয়ার কারন কি ?
(ক) ঠান্ডা ভাতে লবণ নেই
(খ) ধারের টাকা শোধ হয়নি।
(গ) গোলাপচারা নষ্ট হয়ে গেছে।
(ঘ) বাড়িতে খাবার নেই।

উত্তরঃ (ক) ঠান্ডা ভাতে লবণ নেই

২৭. রাগ চড়ে মাথায় আমার, আমি তার…. চড়ি।
(ক) মাথায় (খ) কাঁধে (গ) কপালে (ঘ) সারা শরীরে

উত্তরঃ মাথায়

২৮. ‘আমরা তো সামান্য লোক, আমাদের শুকনো ভাতে…..ব্যবস্থা হোক।
(ক) মাছের (খ) মাংসের (গ) লবণের
(ঘ) ঘি -এর

উত্তরঃ (গ) লবণের

• SAQ প্রশ্ন ও উত্তর—

১.”আমরা তাে অল্পে খুশি; কী হবে দুঃখ করে ?”– দুঃখ করে কিছু হবে না বলে কবি কেন মনে করেছেন ?

উত্তরঃ কবি জয় গােস্বামী তাঁর ‘নুন’ কবিতায় দুঃখ করে কিছু হবে না বলে মনে করেছেন, কারণ বেশি সুখের কোনাে সম্ভাবনাই দরিদ্র নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনে নেই।

২.”আমাদের দিন চলে যায় সাধারণ ভাতকাপড়ে”– এর মধ্যে দিয়ে কী প্রকাশিত হয় ?

উত্তরঃ বক্তব্যটির মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হয় হতদরিদ্র নিম্নবিত্ত মানুষের প্রতিনিধি কথকের কোনাে রকমে দিন-যাপনের কথা।

৩.”রাত্তিরে দু-ভাই মিলে টান দিই গঞ্জিকাতে”– এই গঞ্জিকাতে টান দেওয়ার তাৎপর্য কী ?

উত্তরঃ গঞ্জিকাতে টান দেওয়ার তাৎপর্য হল জীবনের যন্ত্রণাকে, কঠোর বাস্তবকে ভুলে থাকার ব্যর্থ চেষ্টা।

৪.“সব দিন হয় না বাজার হলে, হয় মাত্রাছাড়া”– এই মাত্রাছাড়া’ কথাটির মাধ্যমে কবি কী বােঝাতে চেয়েছেন ?

উত্তরঃ জয় গােস্বামী তার ‘নুন’ কবিতায় এই ‘মাত্রাছাড়া কথাটির মাধ্যমে গরিব মানুষের বেহিসেবি এবং অসংযমী জীবনােচ্ছ্বাসকে বােঝাতে চেয়েছেন।

৫.’নুন’ কবিতায় কিনে আনা গােলাপচারাটি কীসের প্রতীক ?

উত্তরঃ জয় গােস্বামীর নুন কবিতায় কিনে আনা গােলাপচারাটি নিম্নমধ্যবিত্তের গােপনে লালিত সৌন্দর্যবিলাসের প্রতীক।

৬.”কিন্তু, পুতবাে কোথায় ?” – গোলাপচারা সম্পর্কে কথকের এই মন্তব্য স্পষ্ট করাে।

উত্তরঃ ‘কিন্তু, পুঁতবাে কোথায় ?’ গােলাপচারা সম্পর্কে এই মন্তব্যের কারণ হল- দরিদ্র কথকের কোনােভাবে শুধু মাথা গোঁজার স্থানটুকুই আছে।

৭.গােলাপচারায় ফুল হওয়াকে কবি সে অনেক পরের কথা বলার কারণ কী ?

উত্তরঃ কবি গােলাপচারায় ফুল হওয়াকে সে অনেক পরের কথা বলেছেন, কারণ কথক তথা নিম্নবিত্ত হতদরিদ্র মানুষদের তখন সেই ভবিষ্যৎ সুখের বিষয়ে ভাবার ধৈর্য ছিল না।

৮.”মাঝে মাঝে চলেও না দিন”– এই উক্তির মধ্য দিয়ে কবি কী বােঝাতে চেয়েছেন ?

উত্তরঃ “মাঝে মাঝে চলেও না দিন”- এই উক্তির মধ্য দিয়ে কবি নিম্নবিত্ত হতদরিদ্র মানুষের অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কথা বােঝাতে চেয়েছেন।

৯.কথকের দুপুররাতে বাড়ি ফেরা কী প্রমাণ করে ?

উত্তরঃ কথকের দুপুররাতে বাড়ি ফেরা প্রমাণ করে, কথককে জীবনধারণের জন্য উদয়াস্ত কঠোর পরিশ্রম করতে হয়।

১০.“আমরা তাে সামান্য লোক”- সামান্য শব্দটি এখানে কীসের প্রতীক ?

উত্তরঃ ‘নুন’ কবিতায় ‘সামান্য’ শব্দটি নিম্নবিত্ত হতদরিদ্র মানুষের সামান্য অধিকার রক্ষিত না হওয়ার ক্রোধ ও অভিমানের প্রতীক।

১১.’নুন’ কবিতায় কবি কাদের কথা তুলে ধরেছেন ?

উত্তরঃ জয় গােস্বামী তার ‘নুন’ কবিতায় দীনদরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের কথা তুলে ধরেছেন।

১২.অসুখ করলে তারা কীভাবে দিন কাটায় ?

উত্তরঃ জয় গােস্বামীর নুন কবিতায় দেখা যায়, অসুখ করলে তারা ধার-দেনা করে এবং যন্ত্রণা ভুলতে নেশা করে দিন কাটায়।

১৩.সবদিন বাজার হয় না কেন তাদের ?

উত্তরঃ জয় গােস্বামীর ‘নুন’ কবিতায় দেখা যায়, নিম্নবিত্ত হতদরিদ্র মানুষদের সবদিন বাজার হয় না, কারণ সবদিন ঠিকমতাে কাজ করে উপযুক্ত পারিশ্রমিক মেলে না বা কাজও মেলে না।

১৪.গােলাপচারা কিনে আনার অর্থ কী ?

উত্তরঃ গােলাপচারা কিনে আনার অর্থ হল দীনদরিদ্র গরিব মানুষেরও সৌন্দর্যবােধ ও বিলাসিতার শখ আছে, যা তারা সুযােগ পেলেই পূরণ করার চেষ্টা করে।

১৫.গােলাপচারা নিয়ে শেষে কী সমস্যার উদ্ভব হয় ?

উত্তরঃ জয় গােস্বামীর নুন কবিতায় দেখা যায়, গরিব মানুষের বসবাসের সামান্য সংস্থানে গােলাপচারা পোঁতবার জন্য উপযুক্ত স্থান পাওয়া যায় না।

১৬.গােলাপচারায় ফুল ফুটবে কি না তা নিয়ে সংশয়ের কারণ কী ?

উত্তরঃ গােলাপচারায় ফুল ফুটবে কি না তা নিয়ে সংশয়ের কারণ উপযুক্ত পরিচর্যা করে গােলাপচারা থেকে ফুল ফোটানাের জন্য প্রচুর অবসর সময় চাই, যা গরিব মানুষের নেই।

১৭.”সে অনেক পরের কথা”—এখানে কোন্ কথা বলা হয়েছে ?

উত্তরঃ আলােচ্য অংশে গােলাপচারায় ফুল ফোটবার কথা বলা হয়েছে।

১৮.’নুন’ কবিতায় ‘আমরা’ কারা ?

উত্তরঃ জয় গােস্বামীর নুন কবিতায় আমরা বলতে দীনদরিদ্র, গরিব-দুঃখী, যারা অল্পেই খুশি তাদের কথা বলা হয়েছে।

১৯.”খেতে বসে রাগ চড়ে যায়”– রাগ চড়ে যাওয়ার কারণ কী ?

উত্তরঃ জয় গােস্বামীর নুন কবিতায় দেখা যায়, যখন রাতদুপুরে বাড়ি ফিরে ঠান্ডা ভাতে একটু নুন পায় না নিম্নবিত্ত হতদরিদ্র মানুষেরা, তখন তাদের রাগ চড়ে যায়।

২০.মাঝে মাঝে এদের দিন চলে না কেন ?

উত্তরঃ জয় গােস্বামীর নুন’ কবিতায় দেখা যায়, মাঝে মাঝে নিম্নবিত্ত হতদরিদ্র মানুষদের অর্থের অভাবে দিন চলে না।

২১.মাথায় রাগ চড়লে বাপব্যাটা কী করে ?

উত্তরঃ জয় গােস্বামীর নুন কবিতায় দেখা যায়, মাথায় রাগ চড়লে বাপব্যাটা মিলে সারাপাড়া মাথায় করে চেঁচিয়ে অশান্তি করে ।

২২.“করি তাে কার তাতে কী”— একথা বলার কারণ কী ?

উত্তরঃ গরিব মানুষের অনিয়মিত অশান্তিময় অভাবী জীবন থেকে জন্ম নেওয়া অসংযম এবং অশালীন ঔদ্ধত্যের প্রকাশ ফুটে উঠেছে আলােচ্য উদ্ধৃতিটিতে।

২৩.এখানে শুকনাে ভাতের কথা বলা হয়েছে কেন ?

উত্তরঃ জয় গােস্বামীর ‘নুন’ কবিতায় শুকনাে ভাতের কথা বলা হয়েছে কারণ পব্যঞ্জনে সজ্জিত অন্ন গরিবের কাছে স্বপ্নের অতীত।

২৪.কবি এই কবিতায় গরিব মানুষের কেবল নুনের চাহিদাকেই তুলে ধরেছেন কেন ?

উত্তরঃ জয় গােস্বামী তার নুন কবিতায় গরিব মানুষের কেবল নুনের চাহিদাকেই তুলে ধরেছেন, কারণ ভাতের সঙ্গে শুধুমাত্র নুনের সংস্থান হলেই গরিবের সুখে দিন চলে যায়।

২৫.কবির কথায় তাদের মতাে মানুষের দিন কীভাবে চলে যায় ?

উত্তরঃ কবির কথায় তাদের মতাে মানুষের সাধারণ ভাতকাপড়ে, অসুখে আর ধার-দেনাতে অর্থাৎ কষ্টেসৃষ্টে দিন চলে যায়।

২৬.কবি বেশি কিছু না চাওয়ার কথা বলেছেন কেন ?

উত্তরঃ হেসেখেলে কষ্ট করে অল্পতেই খুশি থাকার জন্যই কবি বেশি কিছু না চাওয়ার কথা বলেছেন।

২৭.কথক কখন বাড়ি ফিরতেন ?

উত্তরঃ রাতে, কখনাে কখনাে দুপুররাতে কবি বাড়ি ফিরতেন।

২৮. খেতে বসে কথকের রাগের কারণ কী ছিল ?

উত্তরঃ খেতে বসে ঠান্ডা ভাতে নুন না জুটলে কথকের মাথায় রাগ চড়ে যেত।

২৯.ঠান্ডা ভাতে নুন না থাকাকে কীসের প্রকাশ বলে মনে করা যায় ?

উত্তরঃ ঠান্ডা ভাতে নুন না থাকাকে দারিদ্র্যের প্রকাশ বলে মনে করা যায়।

৩০.’নুন’ কবিতার শেষে কবি কীসের ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়েছেন ?

উত্তরঃ নুন কবিতার শেষে কবি তাঁর মতাে সাধারণ মানুষের জন্য অন্ততপক্ষে শুকনাে ভাতে একটু লবণের ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়েছেন।

৩১.’নুন’ কবিতায় বক্তা গােলাপচারা কিনে এনে কী ভাবেন ?

উত্তরঃ নুন কবিতায় বক্তা গােলাপচারা কিনে এনে ভাবেন যে, সেটি কোথায় পুঁতবেন বা তাতে আদৌ ফুল হবে কি না।

৩২.’নুন’ কবিতার শেষে কবি কী বাসনা জানিয়েছিলেন ?

উত্তরঃ ‘নুন’ কবিতার শেষে একজন সামান্য লােক হিসেবে কবি তাদের শুকনাে ভাতে যাতে একটু লবণের ব্যবস্থা হয় সেই বাসনা জানিয়েছিলেন।

৩৩.’নুন নেই ঠাণ্ডা ভাতে’ জীবনের কোন সত্যকে স্পষ্ট করে ?

উত্তরঃ নুন নেই ঠাণ্ডা ভাতে কথাটির দ্বারা নিম্নবিত্ত মানুষদের জীবনের দারিদ্র্য আর অসহায়তার কথা বলা হয়েছে।

৩৪.”ফুল কি হবেই তাতে ?”- বক্তার এই সংশয়ের কারণ কী ?

উত্তরঃ বক্তার এই সংশয়ের কারণ তাদের অসহায় দরিদ্র-জীবনে সঠিকভাবে গােলাপচারাকে পরিচর্যা করার সুযােগ বা সময় নেই।

৩৫.”আমি তার মাথায় চড়ি”— কবি কার মাথায় চড়েন এবং কেন ?

উত্তরঃ কবি রাগের মাথায় চড়েন কারণ রাতে বাড়ি ফিরে ঠান্ডা ভাতে নুনটুকুও না পেয়ে কবি সংযম হারান।

৩৬.”চলে যায় দিন আমাদের”- দিন কীভাবে চলে যায় ?

উত্তরঃ বক্তার দিন চলে যায় অসুখে এবং ধার-দেনাতে, আর রাত্তিরে গঞ্জিকা সেবনের মধ্য দিয়ে।

৩৭.”বাড়িতে ফেরার পথে কিনে আনি গােলাপাচারা”- বক্তা কেন গোলাপ চারা কিনে আনেন ?

উত্তরঃ নিম্নবিত্ত মানুষরা অনেক অভাবের মধ্যেও তাদের শখ পূরণের জন্য গােলাপচারা কিনে আনে।

৩৮.“বাপ-ব্যাটা দু’ভাই মিলে সারা পাড়া মাথায় করি”- কেন তাদের এমন ব্যবহার ?

উত্তরঃ গভীর রাতে বাড়ি ফিরে যখন ঠান্ডা ভাতে নুনটুকুও পাওয়া যায় না তখন রাগ অনিয়ন্ত্রিত হয়ে বাপ-ব্যাটা সারা পাড়া মাথায় করে।

• নুন কবিতার বড় প্রশ্ন ও উত্তর—

প্রশ্ন ১. আমাদের শুকনাে ভাতে লবণের ব্যবস্থা হােক।”— কে বলেছে ? এ দাবি কার কাছে ? কেন ? (একাদশ, ‘১৪) [১+১+৩]

অথবা,

আমাদের শুকনাে ভাতে লবণের ব্যবস্থা হোক।”— কারা, কাদের কাছে এই দাবি করেছে ? এই দাবি কতটা যুক্তিসংগত ? (একাদশ ‘১৭) [১+১+৩]

উত্তরঃ প্রখ্যাত কবি জয় গােস্বামীর ‘নুন’ কবিতার কথক শ্রমজীবী হতদরিদ্র মানুষটি। ‘আমাদের শুকনাে ভাতে লবণের ব্যবস্থা হােক’ এই দাবি সেই কর্তাব্যক্তিদের কাছে, সামান্য নুনটুকু জোগান দেওয়ার দায়দায়িত্ব যাঁদের।
ন্যায্য অধিকার দাবিঃ ধনতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সম্পদের অসম বণ্টনের ফলেই সমাজে ধনী ও গরিবের শ্রেণিবৈষম্য। শ্রমজীবী মানুষের শ্রমজাত সম্পদ ধনীর কুক্ষিগত হয়। শােষণ ও বঞ্চনার ফলে ধনী হয় আরও ধনী। গরিব নিঃস্ব থেকে আরও নিঃস্ব ও নিরন্ন হতে থাকে। তাদের আয়ের নিশ্চয়তা থাকে না। তাদের শ্রমের জোগানও থাকে না নিয়মিত। তাদের জীবন চলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, ধার-দেনা করে, সাধারণ ভাতকাপড়ে। মাঝে মাঝে আয়ের অঙ্ক শূন্যতে থাকায় বাজার করাও হয় না। সেদিন বাড়ি ফিরতে মাঝরাত গড়িয়ে যায়। উদরপূর্তির জন্য জোটে সকালের ঠান্ডা শুকনাে ভাত। সামান্য নুনটুকুরও সংস্থান না থাকায় আলানো (বাসি) ভাত মুখে বিস্বাদ ঠেকে। তখনই মাথায় রাগ চড়ে। তা নিয়ে বাপ-ব্যাটায় কিংবা ভাইয়ে-ভাইয়ে চ্যাঁচামেচি শুরু হয়। চ্যাঁচামেচিতে পাড়া মাথায় করে ওই অপ্রিয় অসহিষ্ণুতার জন্য পরে তারা নিজেরাও ব্যথিত হয়। তাই তাদের কাতর আবেদন— নিদেনপক্ষে তাদের শুকনাে ভাতে নুনটুকুর ব্যবস্থা হােক। তাদের আর্জি এই সভ্যসমাজে, হতদরিদ্র মানুষের বেঁচে থাকার জন্য এই প্রশাসনিক মানবিকতাটুকু তাদের ওপর বর্ষিত হােক। দয়া নয়, করুণা নয়, এ হল ন্যায্য অধিকারের বিনীত দাবি।

প্রশ্ন ২. ‘আমাদের দিন চলে যায় সাধারণ ভাত-কাপড়ে।’– ‘সাধারণ ভাতকাপড়’ বলতে কী বােঝানাে হয়েছে ? এই দিন চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে বা কী বােঝাতে চেয়েছেন ? (২+৩)

উত্তরঃ

সাধারণ ভাতকাপড়’ কথার তাৎপর্যঃ ‘সাধারণ ভাতকাপড়’-এর আক্ষরিক অর্থ মােটা চালের সাধারণ ভাতের সঙ্গে মাঠ-ঘাট থেকে কুড়িয়ে আনা শাক-পাতার একটু তরকারি। গরিবের আর্থিক সামর্থ্যে কেনার উপযােগী মােটা সুতাের সস্তা কাপড়। তা ছাড়া, সাধারণ ভাতকাপড় কথার দ্বারা কবি বােঝাতে চেয়েছেন নিম্ন আয়ের হতদরিদ্র মানুষের সাধারণ জীবনধারণ— নিতান্ত খেয়ে-পরে বেঁচে থাকা।
‘দিন চলে যায়’ কথার অর্থ এই দিন চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে বক্তা বােঝাতে চেয়েছেন তাদের সামান্য আয়ে ভালাে খাওয়া-পরার স্বপ্ন দেখা দিবাস্বপ্নতুল্য অবাস্তব। কাজেই সাধারণ ভাতকাপড়েই দিন চালাতে হয় তাদের। দৈনন্দিন জীবনযাপন ব্যাপারে তাদের এরকম বােধ ও ভাবনাচিন্তা। সম্পদে বৈভবে অভিজাত জীবনযাপনের স্বপ্ন তারা দেখে না। বিলাসিতা তাদের কাছে দুঃস্বপ্ন। সাধারণ বাঙালি জীবনের ভাবনাচিন্তা হল খেয়ে-পড়ে জীবনটা চলে গেলেই হল। যেজন্য ঈশ্বরী পাটনীর কামনা ছিল, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।’ এ প্রত্যাশা সাধারণ বাঙালির। তাদের আবহমানকালের মনস্কামনা। তাদের সংসারে দুঃখদারিদ্র্য থাকলেও তারা অকপটে ও অক্লেশে বলতে পারে আমাদের দিন চলে যায় সাধারণ ভাতকাপড়ে।

৩. ‘নুন’ কবিতায় সারকথা বর্ণনা করো।

সারকথাঃ ‘নুন’ কবিতার কথক অত্যন্ত ছা-পোষা, নিরীহ, সাধারণ স্তরের মানুষ। তাঁরা ‘সদানন্দের মেলা’র লোক নন, তাঁরা ‘সব পেয়েছির আসর’এর লোক নন। কথক বাঁধা মাইনের সরকারি চাকুরে নন, কথক ‘রোজ আনি রোজ খাই’ অথবা ‘কোনো কোনো দিন খেতে পাই না’ গোছের লোক। মানুষের যে ক-টি প্রধান চাহিদা তথা basic needs আছে, তাদের মধ্যে রয়েছে খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থান। কথক অল্প কিছুতেই খুশি হন, বেশি মাত্রার দুঃখ-টুঃখ করার লোক নন, ভাত-কাপড় জুটলেই তিনি খুশি। বড়ো কোনো ভাবনাকে, উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে মনে তিনি ঠাঁই দিতে পারেন না, সাধারণ প্রবৃত্তি চর্চাতেই তিনি সীমাবদ্ধ। প্রবৃত্তির চর্চাটাও ঠিকমতো সবসময় হয় না। একে অর্থনৈতিক অপ্রতুলতা, তার ওপরে রোগ-জ্বালা লেগেই থাকে, ফলে কথক ঋণজর্জর। ফলে একরাশ বিরক্তিতে কখনো কখনো ‘গঞ্জিকা’র মুখোশে কথকরা বাপ-ব্যাটা দুজন মিলে মুখ লুকোন। বোহেমিয়ান (ছন্নছাড়া) জীবন কোনো কোনোদিন সুস্থিত হতে চায়, বিশেষ করে যেদিন রোজগারপাতি একটু বেশি হয়। সেদিন বাড়ি ফেরার পথে রোমান্টিক হয়ে পড়া কথক গোলাপচারা কিনে আনেন। কিনে তো আনেন কিন্তু লাগাবেন কোথায় ? যে বাড়িতে ভালো করে মাথা গোঁজবার ব্যবস্থা নেই, পরিবারের সদস্যদেরই স্থান-সংকুলান হয় না, সেখানে গোলাপ চারা! সামান্য খুশিতে, হেসে-খেলে কথকের দিন অতিবাহিত হয়ে যায়। অধরাকে ধরতে চেয়ে, অপ্রাপনীয়কে পেতে চেয়ে লাভ কী ? কথক তো ‘সামান্য’ লোক, আর সামান্য লোকদের বেশি চাইতে নেই! কাজ সেরে রাত করে বাড়ি ফিরে ব্যঞ্জনহীন ঠান্ডা ভাতে নুন না পেলে মাথায় রাগ চড়ে যায়, রাগের চোটে চিৎকারে সারা পাড়ায় তুলকালাম বাধিয়ে দেন কথক। বেশ করেন, ঠিক করেন। তাঁদের মতো ‘সামান্য’ লোকের ব্যঞ্জনহীন শুকনো ভাতে আগে লবণের ব্যবস্থা হোক, তাহলেই তাঁরা চিৎকার থামিয়ে দেবেন।

৪. ‘নুন’ কবিতার নামকরণের সার্থকতা বিচার করো

উত্তরঃ নামকরণের গুরুত্বকে অস্বীকার করাটা কোনো কাজের কথা নয়। প্রবাদে বলে—“Morning shows the day” দিনটা কেমন যাবে তা সকালটা দেখেই বোঝা যায়। তেমনি কোনো লেখার ক্ষেত্রে নামকরণ দেখেই বোঝা যায়, অন্তত একটা পূর্বাভাস পাওয়া যায় লেখার মূলবিষয়টা কেমন হবে। তাই বেহিসেবির মতো আমরা ফস্ করে বলে দিতে পারিনা যে, ‘What’s in a name ?’ নামে কি যায় আসে ? আমাদের নামে অনেক কিছু যায় আসে। আমরা নামকরণ নামক সিঁড়িতে পা দিয়ে প্রথমে বিষয়বস্তু সম্পর্কে একটা আগাম পূর্বাভাস নিয়ে সাবধানী পদক্ষেপে বিষয়ের অভ্যন্তরে প্রবেশ করি, ধীরে ধীরে লেখার অন্তিমে পৌঁছই। এটা করি এজন্যই যে বিষয়টি পাঠ করার পর যেন মনে কোনো অসন্তোষ ধূমায়িত না হয়।
নামকরণ নানাভাবে হয়ে থাকে। কখনও চরিত্র মুখ্য নামকরণ, কখনও ঘটনামুখ্য নামকরণ, কখনও ব্যঞ্জনাধর্মী নামকরণ, কখনও রূপকধর্মী নামকরণ ইত্যাদি। আমরা আমাদের পাঠ্য ‘নুন’ কবিতাটি বিচার করে দেখতে চাই তার নামকরণে কোন্ পন্থা অবলম্বিত হয়েছে এবং সেই নামকরণ যথার্থ ও সংগত কিনা। মানুষের সহজ, সরল, সাধারণভাবে বেঁচে থাকার জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান—এই তিনটি জিনিসের খুব প্রয়োজন, এগুলি না হলে জীবন বাঁচে না। যারা সামান্য লোক, যারা মাটির কাছাকাছি বাস করেন তথা যাদের মাটিতে চরণ পড়ে, যারা below the poverty line-এ আছেন, যাদের উঁচু স্বপ্ন বা প্রাচুর্যপূর্ণ হওয়ার গল্প নেই, যারা প্রবৃত্তিচর্চাটুকুকে সম্বল করে বেঁচে আছেন— তারা ভাত-কাপড় পেলেই খুশি, কেননা এই ভাত-কাপড়ও সহজে জোগাড় হতে চায় না। রোজগারের অনেকটাই চলে যায় রোগ-জ্বালার কারণে, এ কারণে ধারদেনাতে ডুবে থাকতে হয়। রোজগার না হলে খাবার বন্ধ, রোজগার একটু ভালো হলে আনন্দের পারদটা একটু চড়ে। রোজগারে ভাটার টান হলে কথক বিরক্তিতে গঞ্জিকাতে টান দেন, রোজগার একটু ভালো হলে কথক বাড়ি ফেরার পথে গোলাপচারা কিনে আনেন, তবে এটুকু শখও কি গরিবের পক্ষে মানায়! গাছ তো এল, কিন্তু বাড়িতে জায়গা কই ? পোঁতা হবে কোথায় ? যাই হোক, হেসে খেলে আনন্দেতে কথকের দিন চলে যায়। তবে যেদিন কাজ সেরে দুপুর-রাতে বাড়ি ফিরে ব্যঞ্জনহীন ঠান্ডা ভাতে কথক নুন পান না—সেদিন কথকের মাথায় রাগ চড়ে যায়। তিনি চিৎকার-চেঁচামেচি করে পাড়া মাত করে দেন। বেশ করেন, যারা সবকিছু পায়, তাদের কোনোকিছু বলা মানায় না। কথক চিৎকার কোনোদিন করবেন না যদিগরিবের শুকনো ভাতে লবণের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। লবণ খুব দামী বস্তু নয় কিন্তু অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বস্তু। কোনো রান্নাই স্বাদু হতে পারে না লবণ না থাকলে। তবে যাদের নিয়মিত গরম ভাত জোটে, সেইসব উপরতলার মানুষের লবণ ছাড়াও চলতে পারে। কিন্তু যাদের কপালে জোটে ঠান্ডা ভাত তাদের নুন (লবণ) ছাড়াও চলতে পারে না। তাদের দাবি শুকনা ভাতে যেন নুনটুকুর ব্যবস্থা করা হয় ।

কবি জয় গোস্বামী ‘নুন’ কবিতায় মেহনতি মানুষদের করুণ জীবনচিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি প্রাত্যহিক জীবনে নুনের অপরিহার্যতা, তার সঙ্গে এই ন্যূনতম দ্রব্যটি জোগাড় করার অক্ষমতা, দৈন্যদশা এবং তাদের অভাবতাড়িত জীবনযন্ত্রণার ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন। কবিতাটির ভাবমূলে নুন বিশেষ তাৎপর্য বহন করেছে। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, কবিতার নামকরণ ‘নুন’ যথাযথ ও সার্থক হয়েছে।

প্রশ্ন ৫. কবি জয় গােস্বামী ‘নুন’ কবিতায় সমাজের শ্রমজীবী নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনযাত্রার যে ছবি এঁকেছেন, তা বর্ণনা করাে।

অথবা,

সমাজের দারিদ্র-লাঞ্জিত শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাত্রা কবি জয় গােস্বামীর ‘নুন’ কবিতা অবলম্বনে লেখো।

উত্তরঃ কবি জয় গােস্বামী ‘নুন’ কবিতায় সমাজের অতিসাধারণ শ্রমজীবী নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনযাত্রার ছবি এঁকেছেন। তারা শ্রমজীবী, ‘দিন আনে দিন খায়’ এমনি হতদরিদ্র বটে, কিন্তু তারা অল্পে খুশি। তারা জানে দুঃখ করে দুঃখকষ্টের সুরাহা হয় না। দুঃখ কার কাছেই বা করবে ? দুঃখ জানিয়ে দুঃখের সুরাহা হবে এমন দরদি সমাজ-সংসার এদেশে নেই। কাজেই সাধারণ ভাতকাপড়ে তাদের দিন চলে। তাদের দিন চলে অসুখ-বিসুখে ধারদেনা করে। কিন্তু দুঃখ-দারিদ্র্য, অসুখ-বিসুখ, দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনা সবকিছু ভুলে থাকার জন্য রাতে দু-ভাই মিলে গাঁজার কলকেতে টান দেয়। অভাবের সংসারে সবদিন বাজার করা হয় না। যেদিন হয় সেদিন বেহিসেবিপনা মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। কারণ গরিবের সংসারে অপ্রয়ােজনীয় গােলাপের চারা কিনে বাড়ি ফিরে গােলাপচারা পুঁতে বাগান বানাবে, তেমন জায়গাটুকু তাে নেই। কষ্ট ভােলার জন্য তারা যথারীতি গাঁজাতে টান দেয়। নেশা-ভাঙেই তাদের আনন্দ, তাতেই তারা খুশি। এভাবে হেঁসে-খেলে কষ্ট করে তাদের দিন চলে যায়। মাঝে মাঝে অভাব-অনটনে সংসার অচল হয়ে যায়। সেদিন মাঝরাতে তারা বাড়ি ফেরে। ভাত তখন ঠান্ডা, সামান্য নুনের জোগাড়টুকুও হয়নি। ফলে খেতে বসে মাথায় রাগ চড়ে। রাগ চড়ে গিয়ে এমন হয় যেন রাগের মাথায় সে চড়ে বসে। ফলে বাপ-ব্যাটায় কিংবা দু-ভাইয়ে মিলে মারামারি ও চেঁচামেচি করে সারাপাড়া মাথায় করে। অবশ্য তাদের রাগারাগি ও আত্মকলহে কাদের কী এসে যায় ? তারা খেটে-খাওয়া অতি নগণ্য মানুষ। তাদের চাওয়া বলতে ‘আমাদের শুকনাে ভাতে লবণের ব্যবস্থা হােক।’ সমাজের কাছে, রাষ্ট্ৰচালকদের কাছে এটুকুই তাদের আর্জি।

প্রশ্ন ৬. ‘আমরা তাে সামান্য লােক / আমাদের শুকনাে ভাতে লবণের ব্যবস্থা হােক।’— কবি জয় গােস্বামীর ‘নুন’ কবিতার বিষয়বস্তু আলােচনা প্রসঙ্গে উদ্ধৃতাংশের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করাে। [২+৩]

অথবা,

‘আমরা তাে সামান্য লােক’-কে, কোন্ প্রসঙ্গে এ কথা বলেছে ? ‘সামান্য লােক’ শব্দের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো। [একাদশ, ‘১৮] [২+৩]

উত্তরঃ জনৈক হতদরিদ্র শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের আত্মকথা। এই শ্রেণির মানুষ অল্পে খুশি। তারা জানে দুঃখ প্রকাশ করে দুঃখের সুরাহা হয় না। সাধারণ ভাত-কাপড়ে তাদের জীবন চলে। অসুখে ধার-দেনা করে তারা সামাল দেয়। অর্থাভাবে সবদিন বাজার করতে পারে না। কখনও বা বাজার করার মতাে অর্থের সংস্থান হলে বাজার করা মাত্রা ছাড়ায়। শৌখিনতার বিলাস কখনও বা ঘাড়ে চড়ে। সংসারের অভাব-অনটনের কথা ভুলে বেহিসেবি বশত গােলাপচারা কিনে ফেলে। মাঝে মাঝে সংসার অচল হয়ে পড়ে। তাদের বাড়ি ফিরতে দুপুররাত হয়। খেতে বসে ঠান্ডা ভাতে নুনটুকুও জুটে না। তখনই মাথায় রাগ চড়ে। বাপব্যাটা কিংবা দু-ভাইয়ে মিলে চঁচামেচি করে পাড়া মাথায় করে।
তাৎপর্য বিশ্লেষণঃ তারা দীনদুঃখী সামান্য শ্রমজীবী মানুষ। তাদের চাওয়া-পাওয়া সামান্য। প্রত্যাশাও যৎকিঞ্চিত। তাদের কামনা শুকনাে ভাতে সামান্য নুনের ব্যবস্থা হোক। সারাদিনের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পরে বাড়ি যখন ফেরে তখন ক্ষুধায় কাতর। খেতে বসে পাতে পরিবেশিত হয় সকালের রান্না করা ঠান্ডা ও শুকনাে ভাত। শুধুই ভাত। ব্যঞ্জনের ব্যবস্থাদি নেই। কারণ কেনাকাটার টাকাকড়ির সংস্থান নেই। একই কারণে সামান্য নুনটুকুও সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। নুনবিহীন সবকিছু বিস্বাদ। ঠান্ডা শুকনাে ভাত তাে খাওয়া সম্ভবই নয়। তাই দুঃখে-বেদনায় তাদের বিনীত আবেদন তাদের শুকনাে ভাতে লবণের ব্যবস্থা হােক। যাদের এটুকু ব্যবস্থা করার দায়দায়িত্ব, তাদের কাছে আবেদন গরিবের সপক্ষে এটুকু অন্তত করা হােক।

প্রশ্ন ৭. কবি জয় গােস্বামীর ‘নুন’ কবিতার আত্মকথক শ্রমজীবী হতদরিদ্র মানুষের স্বভাবচরিত্রের পরিচয় দাও এবং ওই প্রসঙ্গে কবির দরদি চিত্তের যে পরিচয় মেলে তা সংক্ষেপে লেখাে।

অথবা,

‘আমরা তাে অল্পে খুশি’– কবিতায় ফুটে ওঠা বক্তার জীবনচরিত্রের পরিচয় দাও। (নমুনা প্রশ্ন, ‘১৪] [৫]

অথবা,

‘আমরা তাে অল্পে খুশি’– ‘অল্পে খুশি’ মানুষদের জীবনযন্ত্রণার যে ছবি ‘নুন’ কবিতায় ফুটে উঠেছে তার পরিচয় দাও।

উত্তরঃ

স্বভাবচরিত্ৰঃ কবি জয় গােস্বামীর ‘নুন’ কবিতার আত্মকথক মানুষ হতদরিদ্র শ্রমজীবী। আত্মকথক নির্দিষ্ট কোনাে মানুষ নয়, গরিব শ্রমিক শ্রেণির প্রতিনিধি, অন্তত কবি সেভাবেই তাদের দারিদ্র্যপীড়িত জীবনের ছবি তুলে ধরেছেন। এরা বিত্তহীন, কিন্তু চিত্তহীন নয়। নেশাভাঙ করে এরা দারিদ্রপীড়িত জীবনের অশেষ দুঃখকষ্ট-যন্ত্রণাকে ভুলতে চায়। কখনও নেশার বসে বাপ-ব্যাটায় কিংবা ভাইয়ে-ভাইয়ে চ্যাঁচামেচি করে পাড়া মাথায় তােলে, কিন্তু ওই অসংযমী কাজটুকু ছাড়া অসামাজিক কাজে নিজেকে নষ্ট করে, চুরি, বাটপাড়ি করে নিজেকে অমানুষ করে তােলে না। চরম অভাব-অনটনকে ‘হেসে খেলে, কষ্ট করে, সয়ে নেয়। অসুখে-বিসুখে ধারদেনা করে সামাল দেয়। কিন্তু মাঝে মাঝে শৌখিনতার বিলাস ঘাড়ে চড়ে, তখন বেহিসেবি হয়ে গােলাপচারা কিনে বসে। মাঝে মাঝে রুজিরােজগার না হলে রাত করে বাড়ি ফেরে। সেদিন ঠান্ডা ভাতে নুনটুকুও জোটে না। তাদের দারিদ্র্যের এই রূঢ় বাস্তবচিত্র বড়ােই হৃদয়বিদারক। এদের কথাবার্তায় আচরণে উগ্রতা নেই। সহজ সরল এরা। অল্পে তুষ্ট চাওয়া-পাওয়া প্রত্যাশা অতি সামান্য। অদৃষ্টবাদী নয়। দুঃখদারিদ্রের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, কিন্তু হাঁকডাক করে দুঃখ প্রকাশে বিশ্বাসী নয়। কারণ তারা জানে তাতে দুঃখের সুরাহা হয় না। তাদের চাওয়া শুকনাে ভাতের সঙ্গে যেন একটু নুনের ব্যবস্থা হয়।

দরদি চিত্তের পরিচয়ঃ কবি জয় গােস্বামী এই গরিব দীনদুঃখী শ্রমজীবী মানুষের প্রতি গভীর দরদি। কবিতায় কোথাও তিনি প্রত্যক্ষভাবে হাজির হয়ে দরদ, সহানুভূতি বা সহমর্মিতার কথা উচ্চারণ করেননি। কিন্তু ওই শ্রেণির মানুষের জীবনের ছবি আঁকতে গিয়ে তাঁর দরদ ও সহানুভূতি প্রকাশিত হয়েছে প্রতিটি ক্ষেত্রে।

৮. “আমাদের শুকনো ভাতে লবণের ব্যবস্থা হোক।”—কার লেখা, কোন্ কবিতা থেকে নেওয়া হয়েছে ? এই প্রার্থনা কে করেছেন ? এই প্রার্থনা সঠিক কিনা বিচার করো। ১+১+৩=৫

উত্তরঃ জয় গোস্বামীর লেখা, ‘ভুতুম ভগবান’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘নুন’ কবিতার অংশ। এই প্রার্থনাটি করেছেন ‘নুন’ কবিতার কথক তথা কবি স্বয়ং। যারা অর্থনৈতিকভাবে নীচুতলার মানুষ, অর্থাৎ নিম্নবিত্ত মানুষ, তাদের বেঁচে থাকাটা খুব কষ্টকর, এরা কোনো রকমে দিনগত পাপক্ষয় করে চলে। তবে তারাও বেঁচে থাকতে চায়। এই বাঁচার জন্য তিনটি জিনিস খুব জরুরি, সেগুলি হল খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান। আর কিছু হোক না হোক ভাতকাপড় চাই। কারণ এই শ্রেণির মানুষগুলির উচ্চকোটির মানুষদের মতো চাহিদা নেই, উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই, বড়োমাপের স্বপ্ন নেই, প্রবৃত্তি চর্চাটুকু সম্পন্ন করতে পারলেই এরা খুশি

“আমরা তো অল্পে খুশি;
কী হবে দুঃখ করে ?
আমাদের দিন চলে যায়
সাধারণ ভাতকাপড়ে।” 

রোজগার হলেও অসুখে-বিসুখে অনেকটাই বেরিয়ে যায়, কখনও ঋণও করতে হয়। আবার যখন কোনো রোজগার হয় না, তখন বড়ো কষ্ট—“মাঝে মাঝে চলেও না দিন…।” কাজ সেরে অনেক রাত করে বাড়ি ফিরে যখন ব্যঞ্জনহীন ঠান্ডা ভাত নিয়ে এই ‘সামান্য’ লোকেরা খেতে বসে, তখন সে-ভাতে নুন না থাকলে মাথা গরম হয়ে যায়, তখন রাগে চিৎকার করে এই সামান্য লোকেরা পাড়া মাথায় করে, অশান্তির বাতাবরণ তৈরি হয়। এই চিৎকার নিয়ে শাসক বা উঁচুতলার কারোর কিছু বলার থাকতে পারে না, কারণ নুন ছাড়া, ব্যঞ্জন ছাড়া ঠান্ডা ভাত গেলা যায় না, অন্তত নুনটুকু লাগে। তাই সামান্য লোকেরা চিৎকার থামিয়ে দেবে যদি শুকনো ভাতে লবণ জোটে। তাই এই দাবি বা প্রার্থনা ন্যায় সংগত বলেই মনে হয়।

৯.’বাড়িতে ফেরার পথে কিনে আনি গোলাপচারা’— বক্তা কে ? বক্তা কেন গোলাপচারা কিনে আনেন ? অংশটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য কী ? ১+১+৩=৫

উত্তরঃ বক্তা হলেন একজন ‘সামান্য’ লোক তথা কথক তথা কবি স্বয়ং। রোজ একঘেয়ে জীবন থেকে মুক্তি পেতে সবাই চায়— অসামান্য লোক থেকে শুরু করে সামান্য লোক পর্যন্ত। বেসামাল, টালমাটাল সংসারে একটু সুন্দরের ছোঁয়া দিতে রোমান্টিক কথক গোলাপচারা কেনেন। সুখী হতে, খুশি হতে সবাই চায়। অবরুদ্ধ অর্থনৈতিক চাপে রোগজ্বালা সামলে সংসার ভালোভাবে চলতেই চায় না। রোজগার হলে যদি বা চলে, কোনো কারণে রোজগার না হলে সংসারে ‘চাক্কা বন্ধ’। আসলে সবার কপালে সুখ সহ্য হয় না, বিশেষত নিম্নবিত্তদের তো কোনোভাবেই হয় না। তবু, যেদিন একটু বেশি রোজগার হয়, সুখসন্ধানী মন সুখ কিনতে চায়—“বাড়িতে ফেরার পথে কিনে আনি গোলাপচারা।” কিন্তু কিনেও সুখ নেই—“কিন্তু পুঁতব কোথায়?” যে বাড়িতে সদস্যদেরই স্থান সংকুলান হয় না, মাথা গোঁজার যথাযথ স্থান নেই– সেখানে গোলাপচারা কোথায় পোঁতা হবে ? দুঃখ করে তাই ‘গোলাপচারা’ কেনা সামান্য লোক বলতেই পারে—“এ বিরাট পৃথিবীতে / আমার এ ছোট্ট প্রেম / বাসা পেল না।” তা ছাড়া ফুল একারণেই সুন্দর হয়ে ওঠে, যে দেখছে বা দেখতে চায়—তার দৃষ্টিটা সুন্দর। কিন্তু যেখানে অভাব আর অভাব, ‘নুন নেই ঠান্ডা ভাতে’—তার ফুল বিলাসিতা শোভা পায় না। তাই অভাবের সংসারে গোলাপচারা ফুল হয়ে ফুটতে পারে না, সংশয়টা থাকেই—‘ফুল কি হবেই তাতে ?’ তাই বিশৃঙ্খল সংসারে সুস্থিত গোলাপ ফুল ফুটতেই পারে না—একথা হলফ করে বলা যায়।

১০. “আমাদের দিন চলে যায় ‘সাধারণ ভাতকাপড়ে”—কোন্ কবিতার অংশ ? ‘সাধারণ ভাতকাপড়ে’ কথাটি কোন্ অর্থে প্রযুক্ত ? ‘দিন চলে যায়’ কথাটির মধ্য দিয়ে বক্তা কী বুঝিয়েছেন ? ১+১+৩=৫

উত্তরঃ আলোচ্য অংশটি কবি জয় গোস্বামীর ‘ভুতুম ভগবান’ কাব্যের ‘নুন’ কবিতার অংশ।
সাধারণ মানুষ কোনোমতে দিন গুজরান করে, দিনগত পাপক্ষয় করে চলে। তাদের রোজগারের কোনো নিয়মনির্দিষ্ট ব্যাপার নেই। তাই কোনোদিন ‘দিন চলে যায়’ আবার ‘মাঝে মাঝে চলেও না দিন’। ভাত এবং কাপড় পেলেই এই সামান্য মানুষরা খুশি। তাদের প্রাপ্তির ভাঁড়ার শূন্য, মাঝে মাঝে জৈবিক প্রবৃত্তিটা মেটে। তাই কোনো রকমে দিন কেটে যাওয়া ব্যাপারটিকেই উক্তিটিতে বোঝানো হয়েছে।

‘নুন’ কবিতায় যে মানুষদের কথা বলা হয়েছে তারা ধনী বা উচ্চমধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত নয়, নিম্নবিত্ত তথা গরিব। এই মানুষগুলি একটা নির্দিষ্ট ঘেরাটোপে বাস করে। তারা কোনো উচ্চাশা পোষণ করে না, অপ্রাপ্তনীয়কে ধরতে চায় না, তাই অপ্রাপ্তির দুঃখ বা বেদনা তাদের নেই। সাধারণ ভাতকাপড় পেলেই এরা খুশি—“আমরা তো অল্পে খুশি ; কী হবে, দুঃখ করে ?” এদের রোজগার হলে ভাতকাপড় জোটাতে এবং অসুখ সারাতে বেশিটাই খরচ হয়ে যায়, বরং কখনো-কখনো ঋণধার করতে হয়। আবার রোজগার না হলে দিন চলে না। আবার রোজগার বেশিহলে গোলাপচারা কিনে বিলাসী ও রোমান্টিক হতে চায়। অবশ্য এটুকু হতে চাওয়া অন্যায় নয়, বাড়াবাড়ি নয়। কিন্তু চারাটা পুঁতবে কোথায়, যে বাড়িতে নিজেদেরই স্থান সংকুলান হয় না ? তা ছাড়া ফুল কি ফুটবে ? কে জানে! তবে এজন্য বিরাট দুঃখ হয় না, হলেও গঞ্জিকাতে টান দিলেই দুঃখ দূর হয়ে যায়, তাই ‘যথা পূর্বক তথা পরং’ একঘেঁয়ে দিন অতিবাহিত হয় সামান্য পেয়ে, “হেসে খেলে, কষ্ট করে, আমাদের দিন চলে যায়…।”

১১. “রাগ চড়ে মাথায় আমার, আমি তার মাথায় চড়ি”—বক্তা কে ? ‘আমি তার মাথায় চড়ি, বলতে কী বোঝানো হয়েছে ? উদ্ধৃিতিটির প্রসঙ্গ কী ? ১+১+৩=৫

উত্তরঃ এখানে বক্তা হলেন ‘নুন’ কবিতায় উল্লিখিত একজন ‘সামান্য মানুষ’ তথা কথক তথা কবি নিজেই।

বক্তা বেঁচে থাকার জন্য প্রতিদিন জীবন সংগ্রামে লিপ্ত থাকেন, কারণ প্রতিদিনকার গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য বক্তাকে প্রতিদিন রোজগার করতে হয়, তিনি ‘Hand to mouth’ মানুষ। যেদিন রোজগারে টান পড়ে, সেদিন রাতদুপুরে বাড়ি ফিরে খিদের চোটে তরিতরকারিহীন শুকনো বিস্বাদ ঠান্ডা ভাতে নুন না পেয়ে বক্তা রেগে যান। তাঁর রাগের তীব্রতা (Intencity) কতখানি, তা বোঝাবার জন্য কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে। ‘নুন’ কবিতার বক্তা খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ, বলা ভালো ‘Hand to mouth’ অর্থাৎ রোজ আনি রোজ খাই টাইপ। কোনোদিন রোজগার হয়, কোনোদিন হয় না, কোনোদিন আবার বেশি রোজগার হয়। রোজগার হলেও সেটা সুখেরবার্তা নয়, ভাতকাপড়ের ব্যবস্থা করতে এবং রোগ-অসুখ সামলাতে সেটা খরচ তো হয়েই যায়, অনেকসময় ধারদেনা করতে হয়। রোজগার না হলে সংসারের সেদিনের কথা কহতব্য নয়। বক্তা নিজেই বলেছেন—“মাঝে মাঝে চলেও না দিন।” রোজগারপাতি বেশি হলে বক্তা কোনো কোনো দিন গোলাপচারা কিনে আনেন। কিন্তু আনাই সার, পোঁতার জায়গা নেই। তবে এর জন্য বক্তা হাহুতাশ করেন না, কারণ ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ সংসারে এটাই তো ভবিতব্য, ‘কী হবে দুঃখ করে ?’ ভাতকাপড় জুটলেই বক্তারা খুশি—“আমরা তো এতেই খুশি ; বলো আর অধিক কে চায় ?” কিন্তু যেদিন কাজ সেরে, রাতদুপুরে বাড়ি ফিরে খেতে বসেন বক্তা এবং দেখেন ব্যঞ্জনহীন ঠান্ডা ভাতে নুনটুকুও নেই—তখন বক্তা প্রচণ্ড রেগে যান। বক্তার রাগ কতটা বুনো হয়ে ওঠে, তা বোঝাতেই প্রাসঙ্গিকভাবে বলা হয়েছে—’রাগ চড়ে মাথায় আমার, আমি তার মাথায় চড়ি…।’

১২. ‘নুন’ কবিতায় সাধারণ মানুষের দুঃখদুর্দশার যে চিত্র ফুটে উঠেছে, তা বর্ণনা করো।

উত্তরঃ যারা দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করে, তারা সবাই এক, তাদের স্বতন্ত্র অস্ত্বিত্ব নেই বলেই মনে হয়। কারণ, তাদের সংসারে চিরকালীন অভাবের ছাপ, সংসারের মানুষগুলির বছরভর রোগভোগ করা ও তা সামলাতে নাভিশ্বাস ওঠা, ভাত-কাপড়ের অর্থাৎ ন্যূনতমভাবে বেঁচে থাকার রসদ জোগাড় করতে গিয়ে হিমশিম খাওয়া, বড়োসড়ো স্বপ্ন দেখতে না চাওয়া এবং ছোটোখাটো স্বপ্নপূরণ না হওয়া। এই সামান্য মানুষগুলি ‘ঝাঁকের কই’। বেশি কিছু চাওয়া বা পাওয়া তাদের ক্ষেত্রে অন্যায় ৷ মৌল চাহিদাগুলি মিটলেই, অর্থাৎ ভাতকাপড়ের ব্যবস্থা হলেই ঢের, আর কি চাই ? প্রবৃত্তির নিবৃত্তি হলে আর কিছু চাওয়ার নেই। আর ভাতকাপড়ের ব্যবস্থা না হলে দুঃখ ভোলার উপকরণ তো হাতের সামনে আছেই— গঞ্জিকাতে টান দাও।

তাই কবি তার ‘সামান্য মানুষ’ কথক অনায়াসে বলতে পারেন- “আমরা তো অল্পে খুশি ; কী হবে দুঃখ করে ? আমাদের দিন চলে যায় সাধারণ ভাতকাপড়ে।” এই মানুষগুলি মাঝে মধ্যে ব্যতিক্রমী হতে চায়। যেদিন রোজগার বেশি হয় সেদিন কথক একটু রোমান্টিক হয়ে উঠতে চান : “বাড়িতে ফেরার পথে কিনে আনি গোলাপচারা।” কিন্তু যে বাড়িতে মানুষ থাকার জায়গা নেই, সেখানে গোলাপচারা পোঁতা হবে কোথায় ? কথক মনে মনে যেন বলে ওঠেন—

“আমার এ ছোট্ট প্রেম বাসা পেল না।” তাছাড়া ফুল কি সে গাছে ফুটত ? ফুলের ফোটা শুরু সৌন্দর্যপ্রেমিকের দৃষ্টির সামনে! কিন্তু যে বাড়িতে ভাতে নুন জোটে না সেখানে সৌন্দর্যের দৃষ্টি ? তবে না পেতে পেতে সব সহ্য হয়ে গেছে, বোহেমিয়ান হয়ে ওঠ, গঞ্জিকাতে টান দাও, তাহলে আর দুঃখই থাকবে না, অতি সহজে বলা যাবে : “আমরা তো এতেই খুশি, বলো আর অধিক কে চায় ? হেসে খেলে, কষ্ট করে, আমাদের দিন চলে যায়।” তবে সবকিছুর একটা সীমা থাকে, সহ্যেরও একটা সীমা আছে, কাজ সেরে দুপুররাতে বাড়ি ফিরে ঠান্ডা ভাতে নুন না পেলে মাথায় খুন চেপে যায়, চিৎকার করেন কথক, “সারা পাড়া মাথায় করি।” কথক চিৎকার করবেন। যাদের ‘খেয়েও খাবার উপচে পড়ে’—তাদের কিছু বলার নেই। কথক চিৎকার তখনই থামাবেন যদি তাঁর এবং তাঁর মতো মানুষের ঠান্ডা শুকনো ভাতে লবণের ব্যবস্থা হয়।

প্রশ্ন ১৩. “আমি তার মাথায় চড়ি”- কে, কার মাথায় চড়ে ? পঙক্তিটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করাে। (একাদশ, ‘১৫) [১+১+৩]

উত্তরঃ ক্ষুধার্ত হতদরিদ্র শ্রমজীবী মানুষটি তার রাগের মাথায় চড়ে।

রাগ চড়ার কারণঃ ‘আমার মানুষটি একটি হতদরিদ্র শ্রমজীবী লােক। ‘দিন খাটে দিন খায় এমনি আর্থিক অবস্থা সংসারের। সংসারের এই দুঃখকষ্ট, অভাব-অনটন মুখ বুজে সয়ে নেয়। ফলাও করে বলে না। প্রতিবাদে সােচ্চার হয় না। কারণ বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে তার ধারণা এভাবে দুঃখকষ্টের কথা বলে দুঃখের প্রতিকার হয় না। তার বক্তব্য কী হবে দুঃখ করে ? আর সেজন্য যেটুকু উপায় করে তাতেই খুশি থাকে। সাধারণ ভাতকাপড়ে দিন চললে তাতেই সন্তুষ্ট। ধারদেনা করে অসুখ-বিসুখ সামাল দেয়। অবশ্য গঞ্জিকার কলকেতে টান দেয় রাত্রিতে। কখনাে-সখনাে বাড়ি ফেরে মাঝরাতে। তখন ব্যঞ্জনহীন ঠান্ডা ভাতে নুনের সংস্থান না থাকায় ভাত বিস্বাদ হয়। একদিকে ভয়াবহ দারিদ্র্যের কশাঘাত, তার ওপর ক্ষুধার্ত পেটে বিস্বাদ ভাত গলা দিয়ে না নামায় রাগ মাথায় চড়ে। রাগ চড়ার কারণ হল এই।
তাৎপর্য বিশ্লেষণঃ রাগ যখন সংযমের সীমা টপকে যায়, তখন দিকবিদিক জ্ঞান থাকে না। তখন মানুষের জ্ঞান, বােধবুদ্ধি, ন্যায়-অন্যায়ের বিচারবিবেচনা সব লােপ পায়। মনুষ্যত্ব লােপ পেয়ে পশুত্ব প্রাধান্য পায়। হিতাহিত বােধের অস্তিত্বটুকুও থাকে না। রাগের থেকে বড়াে হয়ে দাঁড়ায় ক্রোধােন্মত্ত মানুষটির মনুষ্যত্বহীনপশুত্ব। হিতাহিত জ্ঞানহীন অন্ধ ক্রোধােন্মত্ততা। তা যেন রাগের মাথার ওপর ক্রোধােন্মত্ত মানুষটির চড়ে বসা। তার ফলও হাতে হাতে মেলে। বাপ-ব্যাটায় বচসা হয়, ভাইয়ে ভাইয়ে কলহ বাধে। তাতে পাড়ার লােকের ঘুম ছুটিয়ে সারা পাড়া যেন মাথায় করে।

This Post Has One Comment

Leave a Reply