সাহিত্য মেলা
সপ্তম শ্রেণি
একুশের কবিতা
—আশরাফ সিদ্দিকী
পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল
কাননে কুসুম কলি সকলি ফুটিলো।।
কবেকার পাঠশালায় পড়া মন্ত্রের মতো সেই সুর
সুর নয় স্মৃতির মধুভান্ডার…
সেই আমার দেশ-মাঠ-বন-নদী—
আমার দেশের জারি সারি ভাটিয়ালি মুর্শিদি
আরও কত সুরের সাথে মিশে আছে
আমার মায়ের মুখ
আমার মায়ের গাওয়া কত না গানের কলি!
বিন্নিধানের মাঠের ধারে হঠাৎ কয়েকটি গুলির আওয়াজ…
কয়েকটি পাখির গান শেষ না হতেই তারা ঝরে গেলো
পড়ে গেলো মাটিতে
সেই শোকে কালবৈশাখীর ঝড় উঠলো আকাশে
মাঠ কাঁপলো
ঘাট কাঁপলো
বাট কাঁপলো
হাট কাঁপলো
বন কাঁপলো
মন কাঁপলো
ইতিহাস থমকে দাঁড়িয়ে লিখে নিলো সব…
তাই তো সহস্র পাখির কলতানে আজ দিগন্ত মুখর
তাই তো আজ দ্যাখো এ মিছিলে এসে দাঁড়িয়েছেন আমার মা
যিনি বাংলা ভাষায় কথা বলতে বড়ো ভালোবাসেন
কথায় কথায় কথকতা কতো রূপকথা
আর ছড়ার ছন্দে মিষ্টি সুরের ফুল ছড়ান
যিনি এখনো এ মিছিলে গুন গুন করে গাইতে পারেন
পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল।
কাননে কুসুমকলি সকলি ফুটিলো।।
রাখাল গরুর পাল লয়ে যায় মাঠে।
শিশুগণ দেয় মন নিজ পাঠে।।
বিষয়বস্তুঃ
মাতৃভাষার প্রতি অসাধারণ টান ‘একুশের কবিতা’র মধ্যে অনিবার্যভাবে গাঁথা হয়ে আছে। কবির চেতনায় একুশে ফেব্রুয়ারির শহিদদের কথা উজ্জ্বল। শৈশবে পড়া ‘পাখি সব করে রব’ কবিতাটি যেন মন্ত্রের মতো বাজছে স্মৃতির গভীরে। মাতৃভূমি বাংলাদেশ, মাটির গান ভাটিয়ালি, মুর্শিদি, জারি, সারি গান শৈশবে মায়ের গাওয়া নানা গানের কলি, বিন্নিধান এসবের পাশাপাশি কবির মনে আসছে তাদের কথাও ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে খাজা নাজিমুদ্দিন সরকারের পুলিশ গুলি করে মেরেছিল যাদের।
ইতিহাস লিখে নিয়েছে সেই বেদনাময় ঘটনা, বুকের রক্ত দিয়ে মাতৃভাষাকে রক্ষার সেই করুণ কাহিনি। কবির বয়ানে ঝরে পড়া কয়েকটি পাখি আসলে ভাষা শহিদ আর সহস্র পাখি হল আপামর মানুষ, যারা ভাষার জন্য পা মেলায় মিছিলে, যার মধ্যে কবি দেখেন মা’কে। সহস্র সহস্র বাঙালি তাঁদের মাতৃভাষায় কথা বলে। কবির মা, যিনি বাংলা ভাষায় কথা বলেন তিনি কথায় কথায় রূপকথা, কথকতা, বাংলা ছড়ার ছন্দে সুরের ফুল ছড়িয়ে দিয়েছেন, আর মিছিলে গাইছেন- ‘পাখি সব করে রব’।
নামকরণের সার্থকতাঃ
সাহিত্যের ক্ষেত্রে নামকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর কবিতার নামকরণ বিষয়ে আলোচনা করতে হলে তার বিষয়বস্তুর উপর আলোকপাত করতেই হবে।
আলোচ্য কবিতাটি যে পটভূমিতে রচিত হয়েছিল সেই পটভূমির সঙ্গে ইতিহাসের একটা গভীর যোগ রয়েছে। যা ধর্মের ভিত্তিতে ভারত বিভক্ত হয়ে স্বাধীন হয়েছিল। জন্ম হয়েছিল ভারত – পাকিস্তান দুটি স্বাধীন দেশের।
পাকিস্তানের একটি অংশ পূর্ব পাকিস্তান আজ স্বাধীন বাংলাদেশ নামে পরিচিত। এই দুই পাকিস্তান ভাগ হয়েছিল ভাষাগত কারণে। পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ পূর্ব পাকিস্তানে জোর করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চালানোর চেষ্টা করলে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের মানুষ এর তীব্র বিরোধিতা করে। এর ফলে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের খাজা নিজামুদ্দিন সরকারের পুলিশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ও মেডিকেল কলেজের ছাত্রছাত্রী ও বুদ্ধিজীবীদের একটি শান্তিপূর্ণ মিছিলের উপর নির্বিচারে গুলি চালায়। এর ফলে মারা যান আব্দুস সালাম, আবুল বরকত, সফিউর রহমান, রফিক উদ্দিন আহমেদ ও আব্দুল জব্বার।
এই পাঁচ ভাষা-শহিদের মৃত্যুতে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষজন তীব্র আন্দোলনে নেমে পড়ে যা থেকে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এই ইতিহাসেরই ছায়াপাত ঘটেছে’ একুশের কবিতা’য়। তাই ভাষার প্রতি আবেগে দেশপ্রেমিক কবি তাঁর এই কবিতায় ভাষা মুগ্ধতার প্রচার করতে সচেষ্ট হয়েছেন। এই কবিতার নামকরণ ‘একুশে’ শব্দটি যেন মন্ত্রের মতো উচ্চারণে যুক্ত হয়েছে এবং নামকরণটিও সার্থকতা লাভ করেছে।
কবি পরিচিতিঃ
আশরাফ সিদ্দিকী (১৯২৭): জন্ম টাঙ্গাইলে। বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবি ও লেখক এবং খ্যাতনামা লোকতত্ত্ববিদ। পাক্ষিক ‘মুকুল’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তাঁর রচিত কাব্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘বিষকন্যা’, ‘উত্তর আকাশের তারা’, ‘কাগজের নৌকা’ প্রভৃতি।
শব্দার্থ: » রব– শব্দ, ধ্বনি।
» জারি– বাংলার মুসলমানি পল্লীসংগীত বিশেষ।
» পোহাইল– শেষ হলো।
» সারি– মাঝি-মাল্লাদের গানবিশেষ।
» কানন– উদ্যান, বাগান।
» ভাটিয়ালি– মাঝি-মাল্লাদের গান।
» কুসুমকলি– পুষ্প কলিকা, ফুলের কুঁড়ি।
» মুর্শিদি– বাস্তব বিষয়ক দেহতত্ত্বের গান।
» মন্ত্র– পবিত্র শব্দ বা বাক্য।
» গানের কলি– গানের চরণ বা পদ।
» কালবৈশাখী– চৈত্র-বৈশাখ মাসের বিকালের ঝড়বৃষ্টি।
» কথকতা– পাঠ বা ব্যাখ্যা।
» মিছিল– শোভাযাত্রা।
» রাখাল– গো-রক্ষক, গোরু চরানো ও তত্ত্বাবধান যার কাজ।
» বিন্নিধান– জমা জলে জন্মানো একপ্রকার আউশধান, এই ধানের খই ভালো হয়।
» পাঠ– পঠন, অধ্যয়ন, পাঠ্য বিষয়।
∆অতিরিক্ত প্রশ্ন উত্তরঃ
১. একুশের কবিতাটি লিখেছেন (কেদারনাথ সিং / অজিত দত্ত / আশরাফ সিদ্দিকী)।
উত্তরঃ আশরাফ সিদ্দিকী
২. আর কত সুরের সাথে মিশে আছে –( শহীদদের মুখ / মায়ের মুখ / গানের তাল )।
উত্তরঃ মায়ের মুখ।
৩. গুলির আওয়াজ শোনা গিয়েছিল (মাঠের ধারে / শহরে মাঝে / রোডের ওপর)।
উত্তরঃ মাঠের ধারে।
৪. ইতিহাস থমকে দাঁড়িয়ে ( লিখে নিল সব / পড়ে নিল সব / মেনে নিল সব)।
উত্তরঃ লিখে নিল সব।
৫. একুশের কবিতায় উল্লিখিত ঘটনাটি ঘটেছিল (২১শে জানুয়ারি / ২১শে ফেব্রুয়ারি / ২১শে মার্চ )।
উত্তরঃ ২১শে ফেব্রুয়ারি।
৬. একুশের আন্দোলন যে মাতৃভাষার জন্য হয়েছিল ( উর্দু / হিন্দি / বাংলা)।
উত্তরঃ বাংলা।
(হাতে কলমে প্রশ্নের উত্তর)
১. এই কবিতায় কিছু চন্দ্ৰবিন্দু যুক্ত শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। ‘কাঁপলো’ এবং ‘দাঁড়িয়েছেন’। প্রসঙ্গত দুটি শব্দই ক্রিয়া।
চন্দ্ৰবিন্দু দিয়ে শুরু এমন পাঁচটি অন্য ক্রিয়া ব্যবহার করে পাঁচটি বাক্য লেখো।
উত্তরঃ
» হাঁটা = প্রতিদিন সকালে হাঁটার অভ্যাস স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো।
» ঝাঁপানো = কোনো উঁচু স্থান থেকে ঝাঁপানো উচিত নয়।
» কাঁপানো = লেনিন দুনিয়া কাঁপানো বক্তৃতা দিয়েছিলেন।
» হাঁপানো = সাঁতার কাটার পর হাঁপানো-ই স্বাভাবিক।
» দাঁড়ানো = রাস্তার মাঝখানে দাঁড়ানো উচিত নয়।
২. গুনগুন : মৌমাছি যেভাবে ডানার একটানা আওয়াজ করে, তাকে গুনগুন বলে। বাস্তব ধ্বনির অনুকরণে তৈরি হওয়া এই ধরনের শব্দকে বলে অনুকারী বা ধ্বন্যাত্মক শব্দ। নীচে কয়েকটি ধ্বন্যাত্মক শব্দ শিখে নিতে পারবে।
ক | খ |
পাখা | চলছে কল কল করে। |
মাছিটা | বাসনগুলো ঝন্ ঝন্ করে ভেঙে গেল। |
হাওয়া | পড়ল কড় কড় শব্দ করে। |
নদী | বন্ বন্ করে ঘুরছে। |
কাচের | সন্ সন্ করে বইছে। |
বাজ | পড়ল ধুপ ধাপ করে। |
পটকা | ফর্ ফর্ করে ছিঁড়ে গেল। |
বৃষ্টি | পড়ছিল ঝর্ ঝর্ করে। |
কাগজটা | ভন ভন্ করে উড়ছিল। |
কয়েকটা তাল | ফাট্ছিল দুম দাম করে |
উত্তরঃ
ক | খ |
পাখা | বন বন করে ঘুরছে। |
মাছিটা | ভন্ ভন্ করে উড়ছিল। |
হাওয়া | সন্ সন্ করে বইছে। |
নদী | চলছে কল কল করে। |
কাচের | বাসনগুলো ঝন্ ঝন্ করে ভেঙে গেল। |
বাজ | পড়ল কড় কড় শব্দ করে। |
পটকা | ফাটছিল দুম দাম করে। |
বৃষ্টি | পড়ছিল ঝর্ ঝর্ করে। |
কাগজটা | ফর্ ফর্ করে ছিঁড়ে গেল। |
কয়েকটা তাল | পড়ল ধুপ ধাপ করে। |
৩. ‘আমার মায়ের গাওয়া কত না গানের কলি’—এখানে ‘মায়ের গাওয়া’ শব্দবন্ধটি একটি বিশেষণের কাজ করছে এরকম আরও অন্তত পাঁচটি তৈরি করো।
একটি করে দেওয়া হল—“মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’।
উত্তরঃ
(ক) মায়ের মুখের মতো প্রতিমার মুখ।
(খ) কালবৈশাখী ঝড়ের মতো ভয়ংকর তার দাপট।
(গ) তার যেন সিংহগর্জন গলার স্বর।
(ঘ) মরুভূমির ধূসরতার মতো নির্জনতা।
(ঙ) আকাশের ব্যাপ্তির মতো তার মনটা।
৪. নীচের বিশেষ্যগুলিকে বিশেষণে ও বিশেষণগুলিকে বিশেষ্যে পরিবর্তন করে বাক্যরচনা করো :
উত্তরঃ
» সুর (বি.) > সুরেলা (বিণ.) – সুরেলা কণ্ঠ সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে।
» দেশ (বি.) > দেশি (বিণ.) – দেশি কাপড়ের চাহিদা এখন অনেক কমে গেছে।
» মাঠ (বি.) > মেঠো (বিণ.) – মেঠো সুরের পল্লিগীতি এখন আর শোনাই যায় না।
» বন (বি.) > বন্য (বিণ.) – বন্য পশুরা বনেই সুন্দর।
» মিষ্টি (বি.) > মিষ্টতা (বিণ.) – কথায় মিষ্টতা না থাকলে সবার কাছে প্রিয় হওয়া যায় না।
» মুখর (বিণ.) > মুখরতা (বি.) চারিদিক মুখরতা-য় পূর্ণ তবুও আমি একা।
» ইতিহাস (বি.) > ঐতিহাসিক (বিণ.) – ঐতিহাসিক সবসময় ইতিহাসের সত্যতা পর্যবেক্ষণ করেন।
» ফুল (বি.) > ফুলেল (বিণ.) – ফুলেল গন্ধে চারিদিক মাতোয়ারা।
৫. ‘রব’ শব্দটিকে একবার বিশেষ্য এবং একবার ক্রিয়া হিসেবে দুটি আলাদা বাক্যে ব্যবহার করে দেখাও।
উত্তরঃ
» বিশেষ্য – পাখির রবে আকাশ আজ মুখরিত।
» ক্রিয়াপদ – মন্ত্রীর আগমনে আজ সাজো সাজো রব পড়ে গেছে।
৬. ‘কলি’, ‘সুর’, ‘পাল’—শব্দগুলিকে দুটি করে ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করে আলাদা বাক্যে লেখো।
উত্তরঃ
» কলি (গানের অংশ) — সারাদিন ধরে একটা গানের কলি গেয়ে চলেছো।
» কলি (গাছের নরম নতুন পাতা) – শীতের শেষে গাছে গাছে কলি দেখা দিয়েছে।
» সুর (গানের অংশ) – সুর-তাল-লয়ে গান গাওয়া হয়।
» সুর (দেবতা অর্থে) – সুরেদের হারিয়ে অসুররা স্বর্গ দখল করে।
» পাল (সমষ্টি অর্থে) – সে রোজ একপাল ভেড়া নিয়ে বেরিয়ে যায়।
» পাল (নামের পদবি অর্থে) – উনি হলেন রবীন পাল।
৭. ‘মুখ’ শব্দটিকে পাঁচটি আলাদা অর্থে ব্যবহার করে পাঁচটি আলাদা বাক্য লেখো।
উত্তরঃ
» মুখ (শরীরের অংশ অর্থে) – মুখই আমাদের সৌন্দর্যের প্রধান অঙ্গ।
» মুখ (লক্ষ্য অর্থে) – তোমার কাজের অভিমুখ সর্বদা ঠিক রাখবে।
» মুখ (খারাপ অর্থে) – সবার সামনে বিক্রম এবার মুখ খুলেছে।
» মুখ (প্রধান অর্থে) – সঞ্জয় সর্বভারতীয় দলের মুখপাত্র।
» মুখ (স্থান অর্থে) – বাড়ির মুখে নোংরা করছ কেন ?
৮. প্রত্যয় নির্ণয় করো :
» কথকতা = কথক + তা (ভাবার্থে)।
» মুর্শিদি = মুর্শিদ + ই
» মুখর = মুখ + র (অস্ত্যর্থে)
» পোহাইল = পোহা + ইল।
» ভাটিয়ালি = ভাটিয়াল্ + ই।
৯. নিম্নরেখ অংশগুলির কারক-বিভক্তি নির্ণয় করো :
৯.১ পাখি সব করে রব।
উত্তরঃ কর্তৃকারকে শূন্য বিভক্তি
৯.২ কাননে কুসুমকলি সকলি ফুটিল।
উত্তরঃ অধিকরণ কারকে ‘এ’ বিভক্তি।
৯.৩ তাই তো সহস্র পাখির কলতানে আজ দিগন্ত মুখর।
উত্তরঃ কর্মকারকে ‘শূন্য’ বিভক্তি।
৯.৪ তিনি বাংলা ভাষায় কথা বলতে বড়ো ভালোবাসেন।
উত্তরঃ কর্মকারকে ‘শূন্য’ বিভক্তি।
৯.৫ রাখাল গোরুর পাল লয়ে যায় মাঠে।
উত্তরঃ কর্তৃকারকে ‘শূন্য’ বিভক্তি।
১০. একটি-দুটি বাক্যে উত্তর দাও :
১০.১ “পাখি সব করে রব”—উদ্ধৃতাংশটি কার লেখা কোন্ কবিতার অংশ ? কবিতাটি তাঁর লেখা কোন্ বইতে রয়েছে ?
উত্তরঃ উদ্ধৃতাংশটি কবি মদনমোহন তর্কালঙ্কারের লেখা।
» উদ্ধৃতাংশটি তাঁর ‘প্রভাতবর্ণন’ কবিতার অংশ।
» ‘প্রভাতবর্ণন’ কবিতাটি মদনমোহন তর্কালঙ্কারের ‘শিশুশিক্ষা’ (প্রথম ভাগ) বইতে রয়েছে।
১০.২ এই পঙ্ক্তিটির পাঠের সুরকে ‘মন্ত্রের মতো’ বলা হয়েছে কেন ?
উত্তরঃ এই পঙ্ক্তিটির উচ্চারণে ‘মন্ত্রের মতো’ মনের মধ্যে এক স্বর্গীয় অনুভূতি সৃষ্টি করে, হৃদয়কে আনন্দ দেয়, মনকে শান্ত করে।
১০.৩ এই সুরকে কেন ‘স্মৃতির মধুভাণ্ডার’ বলা হয়েছে ? তা কবির মনে কোন্ স্মৃতি জাগিয়ে তোলে ?
উত্তরঃ শৈশবে পাঠশালায় কবিতাটি পাঠ করার মধুর স্মৃতি জড়িয়ে থাকায় এই সুরকে কবি ‘স্মৃতির মধুভাণ্ডার’ বলেছেন।
সেই শৈশব স্মৃতি কবির মনে ভোরবেলার এক সুন্দর ছবি জাগিয়ে তুলেছে। বাংলার অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পাখির কলতান, লোকগান এসবের মধ্য দিয়ে বাংলা মায়ের মুখ কবির মনে আজও জাগরিত হয়।
১০.৪ ‘সেই আমার দেশ-মাঠ-বন-নদী’—দুই বঙ্গ মিলিয়ে তিনটি অরণ্য ও পাঁচটি নদীর নাম লেখো।
উত্তরঃ
» তিনটি অরণ্য হল – (ক) সুন্দরবন (পশ্চিমবঙ্গ) (খ) রামসাগর জাতীয় উদ্যান (বাংলাদেশ),(গ) গোরুমারা অভয়ারণ্য (পশ্চিমবঙ্গ) (ঘ) মধুপুর জাতীয়
উদ্যান(বাংলাদেশ)।
» পাঁচটি নদী হল—(ক) গঙ্গা(পশ্চিমবঙ্গ), (খ) পদ্মা(বাংলা দেশ), (গ) মেঘনা (বাংলা দেশ), (ঘ) দামোদর(পশ্চিমবঙ্গ), (ঙ) কংসাবতী (পশ্চিমবঙ্গ), (চ) যমুনা (বাংলাদেশ)।
১০.৫ টীকা লেখো :
(ক) জারি – জারি হল বাংলার মুসলমান সম্প্রদায়ের পল্লিসংগীত বিশেষ। ইসলামের ইতিহাস ভিত্তিক ঐতিহ্যবাহী নাট্যধারার সর্বাধিক জনপ্রিয় পরিবেশনারীতি হচ্ছে জারিগান। জারি শব্দটির অর্থ বিলাপ বা ক্রন্দন। এ শব্দটির উৎস-মূল ফার্সি ভাষা।বাংলাদেশে মহররমের বিশেষ দিনে কারবালার শোকাবহ ঘটনা অবলম্বনে নৃত্যগীত সহকারে যে কাহিনী পরিবেশিত হয় তা সাধারণভাবে জারিগান বলে পরিচিত।
(খ) সারি – সারিগান হলো বাংলাদেশের লোকসংগীত । এটি শ্রমসংগীত নামেও পরিচিতি। নৌকার মাঝিদের সংগীত হলেও কর্মজীবী ও শ্রমিকরা দলবদ্ধভাবে বা সারিবদ্ধভাবে কাজের তালে তালে শ্রম লাঘব করার জন্য এ গান করে থাকে। এ জন্যই এ গানের নাম হয়েছে ‘সারি গান’। খেটে খাওয়া মানুষদের কাছে এ গানের এক বিশেষ মহত্ত্ব রয়েছে। কারণ এ গানের মাঝে শ্রমিকরা কাজের উদ্যম ও শক্তি ফিরে পায়।
(গ) ভাটিয়ালি – ভাটিয়ালী বাংলাদেশ এবং ভারতের ভাটি অঞ্চলের জনপ্রিয় গান। গানগুলো রচিত হয় মূলত মাঝি, নৌকা, দাঁড়, গুন ইত্যাদি বিষয়ে। সাথে থাকে গ্রামীণ জীবন, গ্রামীণ নারীর প্রেমপ্রীতি, ভালবাসা, বিরহ, আকুলতা ইত্যাদির সম্মিলন। বাংলাদেশে বিশেষ করে নদ-নদী পূর্ণ ময়মনসিংহ অঞ্চলের ব্রহ্মপুত্র নদের উত্তর-পূর্ব দিকের অঞ্চলগুলোতে এই লোকসঙ্গীতের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে।
(ঘ) মুর্শিদি – মুর্শিদি গান হলো এক প্রকার আধ্যাত্মিক লোকসঙ্গীত। সুফিদ সাধক দ্বারা এর উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে। ‘মুর্শিদ’ শব্দটি আরবি; এর শব্দমূল ‘এরশাদ’, অর্থ আদেশ-উপদেশ দেওয়া। যিনি মুরিদ বা ভক্তকে আদেশ- উপদেশ দেন এবং জিকিরাদি দ্বারা অধ্যাত্মপথে পরিচালিত করেন, তিনিই মুর্শিদ। এক কথায়, মুর্শিদ হচ্ছেন আধ্যাত্মিক উপদেষ্টা বা পথপ্রদর্শক।
(ঙ) বিন্নিধান – জমা জলে যে ধান জন্মায়। এই ধানকে আউশ ধান বলে। এই ধানের খই ভালো হয়। উৎসব পার্বণে বিন্নি চালের পিঠা পায়েস খই চিড়া খাওয়ার ঐতিহ্য রয়েছে সমভূমি ও পাহাড়ি দুই জনগোষ্ঠীরই। প্রায় হারিয়ে গেলেও পাহাড়ের আদিবাসীরা বিন্নি ধানের আবাদ ধরে রেখেছে। এ চাল দিয়েও নবান্নের উৎসব পালন করা হয় ।
(চ) কথকতা – পুরানো দিনের নানা বিষয়ে বিশদে পাঠ ও ব্যাখ্যা। কথকতা শব্দের অর্থ হলো মুখে মুখে কোনো গল্প বলা। যিনি গল্প বলেন তাকে বলা হয় কথক এবং তার গল্প বলাটিকে বলা হয় কথকতা। যুগযুগান্তর ধরে গল্প বলার যে রীতি চলে আসছে একেই বলা হয় কথকতা। কথকতা লোকসংস্কৃতিরই অন্তর্ভূক্ত। বঙ্গসংস্কৃতির সঙ্গে কথকতার যোগাযোগ বহুদিন ধরে চলে আসছে।
(ছ) রূপকথা – শিশুদের মনভোলানোর জন্য ঠাকুমা-ঠাকুরদারা রাজপুত্র রাজকন্যার নানা মজার গল্প করতেন। তাই হল রূপকথা। রূপকথা দেশ, কাল ও সমাজের বাইরের কোনো কল্পলোককে পাঠকের সামনে উপস্থিত করা হয়। কোনো দেশের লোকসমাজের বিশ্বাস, আচার, সংস্কার প্রভৃতি সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। রাক্ষস-খোক্কস, সন্ন্যাসী-ডাইনি, দৈত্য-দানব, জাদুকর, বীর-পালোয়ান, রাজা-রাণী, রাজপুত্র-রাজকন্যা, উজিরপুত্র-কোটালপুত্র এসব হচ্ছে রূপকথার পাত্রপাত্রী।
১০.৬ তোমার জানা দুটি পৃথক লোকসংগীতের ধারার নাম লেখো।
উত্তরঃ (ক) ভাওয়াইয়া। (খ) বাউল গান।
১০.৭;“ইতিহাস থমকে দাঁড়িয়ে লিখে নিলো সব”—’সব’ বলতে এখানে কী কী বোঝানো হয়েছে ?
উত্তরঃ এখানে ‘সব’ বলতে ভাষা আন্দোলনে শহিদ হওয়া সবাইকে এবং তার পাশাপাশি প্রকৃতির বন, মাঠ,ঘাটকে, নদী প্রভৃতিকে বোঝানো হয়েছে।
১০.৮ “তাই তো সহস্র পাখির কলতানে আজ দিগন্ত মুখর”— ‘সহস্র পাখি’ কাদের বলা হয়েছে ?
উত্তরঃ এখানে ‘সহস্র পাখি’ বলতে ভাষা আন্দোলনে সামিল শহিদদেরকে বোঝানো হয়েছে।
১১. ব্যাখ্যা করো :
১১.১ ‘কয়েকটি পাখি ….. পড়ে গেল মাটিতে।’
উত্তরঃ মাতৃভাষার অধিকার নিয়ে যেসব সংগ্রামী মানুষ লড়াই করেছে, প্রতিবাদ করেছে—তাদের ওপর সেই কাকভোরে নেমে এসেছে গুলির আঘাত। আর তারা মাতৃভাষার সম্মানে নিজের প্রাণকে তুচ্ছ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে রক্তাক্ত
অবস্থায়।
১১.২ ‘সেই শোকে কালবৈশাখীর ঝড় উঠল আকাশে।’
উত্তরঃ ভাষা আন্দোলনে যে-সব ছাত্র এবং বুদ্ধিজীবী সামিল হয়েছিল তাদের মাতৃভাষা বাঁচাতে তাদের ওপর নির্বিচারে আঘাত নেমে আসে। আর সেই আঘাতে তারা মৃত্যুবরণ করে। তার ফলে মানুষের মনে যেমন শোকের ছায়া নেমে আসে, তেমনি প্রকৃতির মধ্যেও তার প্রভাব পড়ে, যেন কালবৈশাখীর ঝড়ে ফুঁসে উঠেছিল।
১১.৩ ‘কথায় কথায় কথকতা কতো রূপকথা।’
উত্তরঃ রূপকথার গল্প শুনতে কার না ভালো লাগে। তাও আবার যদি মায়ের মুখে হয়। আসলে এই রূপকথার মধ্যেই আছে আমাদের অতীতের ইতিহাস,অতীতের গৌরব। আর সেই গৌরবময় ইতিহাসকে কথকতার ঢঙে কথায় কথায় মায়েরা
বলে চলেন এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মে।
১১.৪ ‘তাই তো আজ দ্যাখো এ মিছিলে এসে দাঁড়িয়েছেন আমার মা।’
উত্তরঃ এ-মিছিল প্রতিবাদের মিছিল। ভাষা নিয়ে প্রতিবাদ। মাতৃভাষার সপক্ষে প্রতিবাদ, মিছিল। আর এই মাতৃভাষার মিছিলে কবি সর্বজনের মাকে রূপকল্প হিসাবে ব্যবহার করেছেন।
১২. আট-দশটি বাক্যে উত্তর দাও :
১২.১ এই কবিতায় ‘পাখি’ শব্দের ব্যবহার কতখানি সার্থক হয়েছে তা কবিতার বিভিন্ন পক্তি উদ্ধৃত করে আলোচনা করো।
উত্তরঃ এই কবিতায় ‘পাখি’শব্দের ব্যবহার খুব তাৎপর্যপূর্ণ। ‘পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল’—এখানে পাখি যেমন রাতের অন্ধকারকে সরিয়ে ভোরের সূচনাবার্তাকে ঘোষণা করে, তেমনি ভাষা আন্দোলনে সামিল মানুষেরা মাতৃভাষার মুক্তি আনতে চেয়েছিল। আবার, ‘কয়েকটি পাখির গান শেষ হতে না হতেই তারা ঝরে পড়ে গেল, মাটিতে’—এখানে আসলে প্রতিবাদে সামিল ভাষা আন্দোলনকারীদের ওপর নামে বন্দুকের গুলি। তারা অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দেয়। কিন্তু মাতৃভাষার অধিকার তারা প্রতিষ্ঠা করে যায়। ‘তাই তো সহস্র পাখির কলতানে আজ দিগন্ত মুখর’— এখানে আন্দোলনে সামিল মানুষজনের প্রতিবাদে শেষপর্যন্ত মাতৃভাষা স্বাধিকার ফিরে পায়। এইভাবে পুরো কবিতা জুড়ে যেন ‘পাখি’ একটা গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য বহন করছে।
১২.২ কবিতাটির নামকরণের সার্থকতা বিচার করো।
উত্তরঃ ‘একুশের কবিতা’ নামকরণ কতখানি সার্থক তা আলোচনার পর্যায়ক্রমে দেখে নেব। বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে তৎপর বাংলা ভাষাভাষী মানুষ। তাদের ওপর রাষ্ট্রীয় জুলুম ও অত্যাচার চলে। কিন্তু নিজের মাতৃভাষার
অধিকারের লড়াইয়ে তারা প্রতিবাদে সামিল হয়। পথে নেমে মিছিল করে। তাদের ওপর গুলির আঘাতও নেমে আসে। তারা জীবন দিয়ে বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে যায়। এই বিষয়কে নিয়ে কবি কবিতাটা লেখেন। আর যেহেতু ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি এই আন্দোলনটা জোরদার হয়, তাই ‘একুশের কবিতা’ নামকরণটি সার্থক।
১৩. শুধু মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ও দায়বদ্ধতার প্রকাশ নয়, এই কবিতায় রয়েছে আবহমানের ও অমরতার প্রতি বিশ্বাস’—পাঠ্য কবিতাটি অবলম্বনে উপরের উদ্ধৃতিটি আলোচনা করো।
উত্তরঃ ‘একুশের কবিতা’-র মাতৃভাষার প্রতি যেমন শ্রদ্ধা ও দায়বদ্ধতার প্রকাশ দেখা গেছে তেমনি এই কবিতায় রয়েছে আবহমানের ও অমরতার প্রতি বিশ্বাস। কেন-না, কবিতা শুরু এবং শেষ হয়েছে ‘পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল/ কাননে কুসুমকলি সকলি ফুটিল’ দিয়ে। প্রকৃতির এই অনুষঙ্গ আবহমানকালের। আবার মাতৃভাষার মিছিলে মাতৃভাষাকে মা হিসাবে কল্পনা করা হয়েছে। তা আসলে অমরতাকেই প্রমাণ করে। কেননা, মায়ের সঙ্গে যেমন সন্তানের নাড়ির যোগ। ঠিক তেমনিভাবে ভাষার সঙ্গে মানুষেরও প্রাণের যোগ। এই সংযোগ আবহমানকালের। মাতৃভাষা আন্দোলনে শহিদদের শোকে মানুষ যেমন শোকার্ত, তার পাশাপাশি প্রকৃতিও একই সঙ্গে শোকার্ত। প্রকৃতির এই অনুষঙ্গ আবহমানকালের ছবি আঁকে।
১৪. মনে করো তুমি এমন কোনো জায়গায় দীর্ঘদিনের জন্য যেতে বাধ্য হয়েছ যেখানে কেউ তোমার মাতৃভাষা বোঝেন না। নিজের ভাষায় কথা বলতে না পারার যন্ত্রণা জানিয়ে বন্ধুকে একটি চিঠি লেখো।
উত্তরঃ
রাজু কিস্কু
ওড়িষ্যা
প্রিয় বন্ধু সোম,
কেমন আছিস ? জানিস তো ওড়িষ্যায় কাজের কারণে মাস ছয়েকের জন্য আসতে হয়েছে। জায়গাটা বেশ ভালো। এখানকার খাবার-দাবার আমার তো বেশ লাগে। কিন্তু একটা সমস্যা হয়েছে। কী জানিস, মাতৃভাষায় মোটেও কথা বলতে পারছি না। কেউ বাংলা বোঝে না। আর একটা মুশকিল হল—এরা কেউ হিন্দি বলেও না, বোঝেও না। ওড়িয়া ভাষা ছাড়া ওরা একেবারেই কথা বলে না। আমি খুব চাপে আছি। কী আর করা যাবে বল। ছ’মাস চুপ-চাপ কাজ করে কাটিয়ে দিতে হবে। তুই ভালো থাকিস। বাড়ি ফিরলে আরও কথা হবে।
ইতি —
রাজু
ডাকটিকিট
সোম দাস
তাজাপুর, বীরভূম
তারিখ : ০২/০১/২০২২
১৫. তোমার বিদ্যালয়ে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ কীভাবে পালিত হয়ে থাকে, তা জানিয়ে প্রিয় বন্ধুকে চিঠি লেখো।
উত্তরঃ
মাথাভাঙ্গা, কুচবিহার,
তারিখ : ০৫/০৫/২০২২
প্রিয় বন্ধু দীপ,
অনেকদিন তোর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। তোর বাবার চাকরির সূত্র ধরে তুই তো স্কুল বদল করে নিজের বাড়িতে চলেগেছিস। আমি বেশ ভালো আছি। তোকে একটা ভালো খবর জানাই— আমাদের স্কুলে এ-বছর খুব শ্রদ্ধার সঙ্গে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ পালিত হল। বাংলার শিক্ষক বর্মন স্যারকে তোর মনে আছে ? উনি পুরো অনুষ্ঠানটা পরিচালনা করেন। ছাত্র-ছাত্রীরা ওই ভাষা আন্দোলন নিয়ে যাবতীয় কবিতা পাঠ করে ৷ স্যারেরা ভাষা আন্দোলনের বিষয়ে নানা বক্তৃতা দেন। সব মিলিয়ে বেশ ভালো হয় ওই দিনের অনুষ্ঠান। তোদের স্কুলে কেমন হল জানাস।
ভালো থাকিস।
ইতি —
বিজয়
গ্রাম- গোপালনগর,
পো- লালবাগ,
জেলা- মুর্শিদাবাদ।
👉 পরবর্তী পাঠঃ একুশের তাৎপর্য