কে বাঁচায় কে বাঁচে গল্পের বড় প্রশ্ন এবং উত্তর | Descriptive Type Question and Answer [HS]

WhatsApp Channel Join Now
Telegram Group Join Now

          রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর

                    (প্রশ্নের মান – ৫)
 
১.১ “ মৃত্যুঞ্জয়ের বাড়ির অবস্থা শোচনীয় । ” — মৃত্যুঞ্জয় কে ? তার বাড়ির অবস্থা শোচনীয় কেন ? (২০১৫)
উত্তরঃ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বিরচিত ‘মহামন্বন্তর’ গল্পগ্রন্থের ‘কে বাঁচায় কে বাঁচে’ গল্পের অন্যতম চরিত্র – মৃত্যুঞ্জয়। তিনি একজন শহুরে মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবী, আদর্শবাদী যুবক।
 
 মৃত্যুঞ্জয় তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। সে একটি অফিসে চাকরি করত। একদিন অফিস যাওয়ার পথে একটি অনাহারে মৃত্যুর ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিল। তারপর থেকে তাঁর মনোজগতে এমন পরিবর্তন এসেছিল যে দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষদের জন্য একবেলার খাবার বিলি
করে দেয়। তারপর মাইনের সমস্ত টাকাটা
রিলিফ ফান্ডে দান করে দেয়। 
 
এরপর যত দিন যায় সেও ক্রমশ পাল্টে যেতে থাকে। অফিস থেকে আগে বেরিয়ে যাওয়া এবং সময়মতো বাড়ি না ফেরা। এমনকি শহরের ফুটপাতে এবং বিভিন্ন লঙ্গরখানায় নিরন্ন মানুষের সঙ্গে সে সময় কাটায়। দুর্ভিক্ষ-পীড়িত মানুষদের মুখে অন্ন জোগানোর জন্য সে নিজের পরিবারের প্রতি অবহেলা করতে থাকে। অন্যদিকে —
   » টুনুর মা অর্থাৎ মৃত্যুঞ্জয়ের স্ত্রী শয্যাশায়ী।তার স্বাস্থ্য ভালো ছিল না অথচ এতদিন ধরে নিজের খাবার অপরকে বিলি করে এসেছে। তার ফলেই এখন সে শয্যাশায়ী।
  » সে বাড়ির লোকেদের বারবার স্বামীর খোঁজে পাঠিয়ে দেয়। তারা কেউ মৃত্যুঞ্জয়ের খোঁজ পায় না। ফলে বাধ্য হয়ে বাড়িতে এসে তাকে মিথ্যে সান্ত্বনা দেয়।
 » মৃত্যুঞ্জয়ের ছেলেমেয়েগুলি অবহেলায়,
অনাদরে, ক্ষুধার জ্বালায় চেঁচিয়ে কাঁদে। এইভাবে, দেশের লোকের ভালো করার
নেশায় মৃত্যুঞ্জয় যে পাগলামি শুরু করেছিল
তার ফলেই তার বাড়ির অবস্থা শোচনীয়
হয়ে উঠেছিল।
 
১.২ “ নিখিল ভাবছিল বন্ধুকে বুঝিয়ে বলবে , এ ভাবে দেশের লোককে বাঁচনো যায় না । কোন্ প্রসঙ্গে নিখিলের এই ভাবনা ? এই ভাবনার মাধ্যমে নিখিলের চরিত্রের কোন বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছে ? ১ + ৪ (উঃ মাঃ ২০১৬)
উত্তরঃ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কে বাঁচায় কে বাঁচে’ গল্পে নিখিল যখন জানতে পারে যে মৃত্যুঞ্জয় এবং তার স্ত্রী একবেলার খাবার বিলি করে দেয়, তখন সে ভেবেছিল মৃত্যুঞ্জয়কে বুঝিয়ে বলবে যে এভাবে দেশের লোককে বাঁচানো যায় না
 
   রাতের অন্ধকার যেমন আকাশের তারাকে আরো উজ্জ্বল কোরে তোলে তেমনি নায়ক চরিত্র কে উজ্জ্বল করে তোলার জন্য লেখকেরা মাঝে মাঝে কিছু কিছু বিপরীতমুখী চরিত্র সৃষ্টি করেন। নিখিল তেমনই একটি চরিত্র।
 
      নিখিল চরিত্রটি গল্পের নায়ক মৃত্যুঞ্জয়ের সহকর্মী ও বন্ধু। সেও প্রায় সমপদস্থ মধ্যবিত্ত চাকুরে। দুই সন্তানের পিতা সে। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্ন, অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার অধিকারী। 
 
      নিখিল একটু অলস প্রকৃতির মানুষ। গল্পে দেখি মৃত্যুঞ্জয় নিজ দায়িত্বের সঙ্গে একটি বাড়তি দায়িত্ব বহন করত কিন্তু নিখিল এমন কোন বাড়তি দায়িত্ব পালন করত না।
 
       আট বছর বিবাহিত জীবন যাপন এবং দুই সন্তানের জনক হলেও নিখিলের নাকি সংসারে মন নেই। তাই—
   “অবসর জীবনটা সে বই পড়ে আরেকটা চিন্তার জগৎ গড়ে তুলে কাটিয়ে দিতে চায়”।
এটি উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিলাসিতা ছাড়া কিছুই নয়। তাই চরিত্রটি কিছুটা অন্তর্মুখী।
 
       নিখিল তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্ন হলেও মৃত্যুঞ্জয়ের অপরাজেয় শক্তির প্রতি ঈর্ষান্বিত। মাঝে মাঝে—
     “মৃদু ঈর্ষার সঙ্গেই সে তখন ভাবে যে নিখিল না হয়ে মৃত্যুঞ্জয় হলে মন্দ ছিল না”।
      বন্ধু প্রীতি নিখিল চরিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। দুঃসময়ে নিখিল বারবার মৃত্যুঞ্জয়ের বাড়িতে গিয়েছে। খোঁজখবর নিয়েছে। অফিসে চেষ্টা করে মৃত্যুঞ্জয়ের ছুটির ব্যবস্থা করেছে। অফিস ছুটির পর মৃত্যুঞ্জয়ের সঙ্গে দেখা করে তাকে ফেরানোর চেষ্টা করেছে।
      তবে আবেগপ্রবণ মৃত্যুঞ্জয় এর বিপরীতে নিখিল কিন্তু বাস্তববাদী। দুর্ভিক্ষের দিনে ফুটপাতে মৃত্যু তার কাছে সহজ ও সাধারণ ঘটনা। এই দুর্দিনে বাস্তব পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে অর্থসাহায্য কমানোর কথা সে ভাবে।
      নিখিল যুক্তিবাদী। সে বিশ্বাস করে অর্থ সাহায্য করা একার পক্ষে দুর্ভিক্ষ এবং অনাহারে মৃত্যু প্রতিরোধ করা যায় না। তার যুক্তি “নিজেকে না খাইয়ে মারা বড় পাপ”।
      নিখিল চরিত্রে বেশ কিছু মানবিক গুণের সমন্বয় ঘটলেও সে মধ্যবিত্ত মানসিকতার পোষক। নিরন্ন মানুষের মৃত্যু তাকে ভাবায় না। সে মনোবিলাসি এবং নিজেকে বাঁচানোর জন্য সে অমানবিক। আর এভাবেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কে বাঁচায় কে বাঁচে’ গল্পের প্রধান চরিত্র মৃত্যুঞ্জয়ের পাশাপাশি নিখিল চরিত্রটিও হয়ে উঠেছে একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, যাকে আমরা কেও এড়িয়ে যেতে পারিনা।
 
 (অথবা, এই উত্তরটাও লিখতে পারো)
উত্তরঃ গল্পকার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর ‘কে বাঁচায় কে বাঁচে’ গল্পের ঘটনা যাকে কেন্দ্র করে অগ্রসর হয়েছে সে হল এই গল্পের প্রধান ও অন্যতম চরিত্র মৃত্যুঞ্জয়। মৃত্যুঞ্জয় আদর্শ বাদী, ন্যায়নিষ্ট ভাবুক প্রকৃতির মানুষ। তার একমাত্র সুহৃদ তথা বন্ধু ছিল নিখিল যে কিনা আবার তার সহকর্মীও বটে। গল্পের সংক্ষিপ্ত পরিসরে গল্পকার চরিত্রটিকে নির্মাণ করেছেন তার স্বভাবসিদ্ধ দক্ষতায়।
     নিখিল মৃত্যুঞ্জয়ের অফিসের সহকর্মী। মধ্যবিত্ত মানসিকতার অধিকারী, শিক্ষিত দায়িত্ব সচেতন মানুষ নিখিল। সে রোগা, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি এবং একটু অলস প্রকৃতির লোকও বটে।
    নিখিল মৃত্যুঞ্জয়ের সহকর্মী সে মৃত্যুঞ্জয়ের
আদর্শ ও ধ্যান ধারণাকে সন্মান করে। অন্যান্য সহকর্মীদের থেকে মৃত্যুঞ্জয়কে একটু বেশিই ভালোবাসে সে।
      বন্ধুর প্রতি তার সহমর্মিতা তাকে আরো বিশেষ করে তুলেছে। মৃত্যুঞ্জয়ের প্রতি তার মৃদু অবজ্ঞা থাকলেও সে যখন মানসিক ভাবে অস্থির হয়ে পরেছে তার পরিবার যখন বিপদে পরেছে তখন নিখিল মৃত্যুঞ্জয়ের ছায়া সঙ্গী হয়ে উঠেছে।
    মৃত্যুঞ্জয়কে বোঝানোর চেষ্টা করেছে। তাকে সংসারাভিমুখ করতে চেয়েছে। মৃত্যুঞ্জয়ের মানসিক অস্থিরতায় নিখিল কাতর হয়ে পড়েছে। সাময়িক ভাবে সেও দুর্বল হয়ে পড়েছে। কিন্তু তার বাস্তব বুদ্ধি, তার দায়িত্ব কর্তব্য বোধ তাকে মৃত্যুঞ্জয়ের মতো অধীর করে তুলতে পারেনি। তাই মৃত্যুঞ্জয় যখন সংসারের প্রতি উদাসীন হয়ে পড়েছে তখন নিখিল তার সংসারকে সাহায্য করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে এবং বার বার ছুটে গিয়েছে মৃত্যুঞ্জয়ের বাড়িতে তাদের সকলের খবর নিতে তারা কেমন আছে কি করছে ইত্যাদি জানার জন্য।
   আর এভাবেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কে বাঁচায় কে বাঁচে’ গল্পের প্রধান চরিত্র মৃত্যুঞ্জয়ের পাশাপাশি নিখিল চরিত্রটিও হয়ে উঠেছে একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, যাকে আমরা কেউ এড়িয়ে যেতে পারিনা।
 
১.৩ “দিন দিন কেমন যেন হয়ে যেতে লাগল মৃত্যুঞ্জয়।”— মৃত্যুঞ্জয় কেমন হয়ে যেতে
লাগল? তার এমন হয়ে যাওয়ার কারণ কী?
৩ + ২ (উঃ মাঃ ২০১৮)
 
উত্তরঃ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ ছোটগল্পানুসারে অনাহারে মৃত্যু দেখার কিছুদিন পরই অফিসের মাইনের তারিখ আসে। সে-দিন মৃত্যুঞ্জয় তার মাইনের পুরাে টাকাটা নিখিলের মাধ্যমে রিলিফফান্ডে দান করে দেয়। সে-দিনের পর থেকেই মৃত্যুঞ্জয় কেমন যেন হয়ে যেতে থাকে। অফিসে আসতে দেরি করে, কাজে ভুল করে, প্রায়ই চুপচাপ বসে বসে ভাবে, তারপর একসময় বেরিয়ে যায়। বাড়িতেও তাকে বিশেষ একটা পাওয়া যায় না। দিনরাত শহরের ফুটপাথ ধরে সে হেঁটে বেড়ায়। বড়াে গাছের নীচে, ডাস্টবিনের ধারে বা খােলা ফুটপাথে যেসব দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষ পড়ে থাকে, তাদের শুধু দাঁড়িয়ে থেকে লক্ষ করে সে। এইসব অনাহারীরা সন্ধ্যা থেকেই শুয়ে থাকে, কিন্তু অনেক রাতে, দোকানপাট বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর হামাগুড়ি দিয়ে সামনের কোনাে রােয়াকে উঠে সেখানে শুয়ে পড়ে। এরাই ভোর চারটের সময় লঙ্গরখানায় গিয়ে খাবারের জন্য লাইন দেয়। সকালের দিকে মৃত্যুঞ্জয় তাই বিভিন্ন পাড়ার লঙ্গরখানায় গিয়ে অন্নপ্রার্থীদের ভিড় লক্ষ্য করে।
 
» মন্বন্তরকালে নিজের চোখে ফুটপাথে ঘটা অনাহার-মৃত্যুর দৃশ্য দেখে ভীষণ রকমের মানসিক আঘাত পেয়েছিল মৃত্যুঞ্জয়। একজন মানুষ না-খেতে পেয়ে মরার সময় কীরকম কষ্ট পায়, খিদের যন্ত্রণা না মৃত্যু যন্ত্রণা কোনটা বেশি কষ্টদায়ক এসব প্রশ্ন তাকে ভাবিয়ে তুলেছিল। মন্বন্তরকালে মৃত্যুঞ্জয় সপরিবারে চার বেলা খেয়ে চলেছে এবং ত্রাণকার্যেও কখনও এগিয়ে যায়নি বলে নিজেকে ধিক্কার দেয় মৃত্যুঞ্জয়। দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষদের বাঁচাতে তাই সে মাইনের সব টাকাটা ত্রাণ তহবিলে দান করে দেয়। এমনটা করেও তার অপরাধবােধ না কমায় সে এমন হয়ে গিয়েছিল।
 
১.৪ “ভূরিভােজনটা অন্যায়, কিন্তু না খেয়ে মরাটা উচিত নয় ভাই।”- বক্তা কে ? এই বক্তব্যের মধ্যে বক্তার চরিত্রের কোন দিক আভাসিত হয়েছে ? ১+৪ (উঃ মাঃ ২০১৯)
 
উত্তরঃ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কে বাঁচায় কে বাঁচে’ গল্পে প্রশ্নে উদ্ধৃত উক্তিটি মৃত্যুঞ্জয়ের সহকর্মী ও বন্ধু নিখিল একথা বলেছিল।
   নিখিলের এই বক্তব্য থেকে তার চরিত্রের
বাস্তববাদী দিকটি আভাসিত হয়েছে। মন্বন্তরের সময় বহু মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছিল। তখন অনাহারে মৃত্যুর ব্যাপারটা নিতান্তই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু আদর্শবাদী মৃত্যুঞ্জয়ের পক্ষে না খেতে পেয়ে মৃত্যুর দৃশ্য সহ্য করা সহজসাধ্য ছিল না। সেইজন্য মাইনের দিন তার বেতনের সমস্ত টাকাটা সে নিখিলের হাতে তুলে দিয়েছিল এবং বলেছিল কোনো রিলিফ ফান্ডে সেটা দিয়ে দিতে। অর্থাৎ, অন্যকে বাঁচানোর জন্য
নিজেকে মেরে ফেলার আয়োজন করেছিল সে। নিখিল তাকে এই বাস্তব ব্যাপারটা বোঝানোর চেষ্টা করেছিল যে, এইভাবে দেশের লোককে বাঁচানো যাবে না।
   » প্রতিটি মানুষেরই বেঁচে থাকার জন্য
খাবারের প্রয়োজন। দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষ গুলোকে বাঁচাতে হলে যেমন খাবারের প্রয়োজন, তেমনি মৃত্যুঞ্জয়ের নিজের বেঁচে থাকার জন্যও খাবার প্রয়োজন। দুর্ভিক্ষের সময় ভুরিভোজন করাটা উচিত নয়, সেটা কাম্যও নয়। কিন্তু নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যেটুকু খাবার দরকার সেটুকু খেতেই হবে। উপায় থাকতেও নিজেকে না খাইয়ে মারা অন্যায়। আদর্শবাদী মৃত্যুঞ্জয়ের বিপরীত প্রান্তে দাঁড়িয়ে নিখিলের এই বাস্তববোধ চরিত্রটিকে অন্য মাত্রা দিয়েছে।
 
১.৫ “সেদিন অফিস যাবার পথে মৃত্যুঞ্জয় প্রথম মৃত্যু দেখল – অনাহারে মৃত্যু ।” এই দেখা’র ফলে মৃত্যুঞ্জয়ের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া কী হয়েছিল ? 
 
উত্তরঃ উদ্ধৃতাংশটি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে !’ গল্প থেকে নেওয়া হয়েছে ।
     মৃত্যুঞ্জয় একজন অফিসকর্মী । সমপদস্থ সহকর্মী নিখিলের থেকে সে বরং একটি বাড়তি দায়িত্বের কারণে পঞ্চাশ টাকা বেশি পায় । বাড়ি থেকে বেরিয়েই সে ট্রামে ওঠে এবং অফিসের দরজার সামনে গিয়ে নামে । ফলে পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষের সময় কলকাতার পথেঘাটে দুর্ভাগা মানুষের মৃত্যুর ভয়াবহ দৃশ্যের সম্মুখীন তাকে এতদিন হতে হয়নি । কিন্তু সেদিন মৃত্যুঞ্জয়কে আকস্মিকভাবে অনাহারে মৃত্যুর বীভৎস দৃশ্যের মুখোমুখি হতে হলো ।
     এই মৃত্যুদৃশ্য তাৎক্ষণিকভাবে মৃত্যুঞ্জয়ের নরম, দরদি, মানবিক আদর্শে বিশ্বাসী মনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল । তার সুস্থ শরীর যেন মুহূর্তে অসুস্থ হয়ে পড়ল । তার সংবেদনশীল মনে আঘাত লাগলে শরীরেও প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় । ফলে মৃত্যু দৃশ্যে তার মন আলোড়িত হতেই শারীরিক কষ্ট বোধ হতে লাগল । অফিসে পৌঁছেই নিজের কুঠুরিতে বসে সে যেন অবসাদে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ে । কিন্তু সেখানেও সে স্বস্তিবোধ করে না বলে উঠে কলঘরে যায় । কলঘরে দরজা বন্ধ করে বাড়ি থেকে খেয়ে আসা যাবতীয় খাবার বমি করে উগরে দেয় । তার পর টেবিলে ফিরে জল খেয়ে দেওয়ালের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ।
 
১.৬.”ওটা পাশবিক স্বার্থপরতা”– কে, কাকে একথা বলেছে ? ‘পাশবিক স্বার্থপরতা’ শব্দবন্ধ ব্যবহারের কারণ কী ? 
                          অথবা, 
“ … সমাজদর্শনের দিক থেকে বিচার করলে দশ জনকে খুন করার চেয়ে নিজেকে না খাইয়ে মারা বড়ো পাপ। ” বক্তা কে ? এই উত্তিতে বক্তার যে মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে তা বিশ্লেষণ করো।
 
উত্তরঃ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে !’ গল্পের অন্যতম চরিত্র নিখিল উদ্ধৃত উক্তিটি করেছে।
      নিখিল বাস্তববাদী। তার মতে নিজেকে না খাইয়ে মারা ঠিক নয়। দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষদের প্রতি সহানুভূতিবশত মৃত্যুঞ্জয় খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল। নিখিল তখন যুক্তি দেখিয়ে বলে মন্বন্তরের দিনে ভূরিভোজনটা অন্যায় কিন্তু নিজেকে না খাইয়ে রাখা আরও অন্যায় । বেঁচে থাকার জন্য যতটুকু দরকার ততটুকু খেলে দুর্ভিক্ষের দিনে অন্যায় কোথায় ? শত শত নিরন্নের দিকে চেয়ে যদি নিজেকে অভুক্ত রেখে দেওয়া হয় তবে সেটা নিজেরই সঙ্গে প্রবঞ্চনা করা ।
     এর উত্তরে মৃত্যুঞ্জয় বলে ওটা পাশবিক স্বার্থপরতা । স্বার্থপরতা চরম হলে তবেই এ কাজ করা যায় । নিজেকে খাইয়ে অন্যকে না খাইয়ে রাখা, মৃত্যুঞ্জয় আপন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে নিখিলের এই যুক্তিকে ‘পাশবিক স্বার্থপরতা’ বলেছে ।
 
১.৭ “এভাবে দেশের লোককে বাঁচানো যায় না ।”— এভাবে বলতে কী বোঝানো হয়েছে ? এভাবে দেশের লোককে বাঁচানো যায় না কেন ?
 
উত্তরঃ আলোচ্য অংশটি নেওয়া হয়েছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে‘ গল্প থেকে। গল্পটি পঞ্চাশের মন্বস্তরের প্রেক্ষাপটে রচিত হয়েছে। অনাহারক্লিষ্ট মানুষ খাদ্যের আশায় কলকাতায় ভিড় করেছে। দিনের পর দিন কলকাতায় অনাহারে-অর্ধাহারে কাটিয়ে দেওয়া মানুষগুলির ঠিকানা ফুটপাথ। একদিন ফুটপাথে এমনই এক ব্যক্তির মৃত্যু দেখে অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়ে মৃত্যুঞ্জয়। এটা সে মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। সে নিজের খাওয়া কমিয়ে দেয়, বেতনের পুরো টাকাটা কোনো রিলিফ ফান্ডে দিয়ে দেওয়ার জন্য নিখিলকে অনুরোধ করে। এভাবে সে অনাহারক্লিষ্ট মানুষকে বাঁচাতে চায়। মৃত্যুঞ্জয়ের এই স্বার্থত্যাগ, পরোপকারবৃত্তি ও মানবিকতাবোধ আসলে বাস্তববর্জিত । তাই নিখিল মৃত্যুঞ্জয়কে বলে, “এভাবে দেশের লোককে বাঁচানো যায় না।” কারণ নিজে বাঁচো, অন্যকেও বাঁচাও’ – এটাই জীবনের দাবি, বাস্তব সত্য । কেননা একজন মানুষ তার সর্বস্ব দিয়েও দেশের এত অনাহারক্লিষ্ট মানুষকে বাঁচাতে পারবে না । এজন্য দরকার প্রত্যেকের সাধ্যানুযায়ী সাহায্য ও সহযোগিতা করা । সম্মিলিত প্রয়াসে এমন পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব , অর্থাৎ অভুক্ত, নিরন্ন মানুষকে বাঁচাতে একজন মানুষের সর্বস্ব ত্যাগও যথেষ্ট নয় । কোথাও দীর্ঘ খরা , আবার কোথাও অতিবৃষ্টির জন্য ফসল নষ্ট হয়েছে, ফলে গ্রামবাংলায় দেখা দিয়েছিল দুর্ভিক্ষ । গ্রাম ছেড়ে দলে দলে মানুষ ভিড় করেছিল শহরে –বন্দরে। সরকার ত্রাণের ব্যবস্থা, বাসস্থানের ব্যবস্থা করেছে । কিন্তু আশানুরূপ সাফল্য পায়নি। বেশিরভাগ মানুষ এটা বুঝতে পেরেও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু মৃত্যুঞ্জয়কে এসব প্রচণ্ড নাড়িয়ে দিয়েছে । সে সর্বস্ব দান করেছে, নিজেও ভুখা মানুষগুলির দলে সামিল হয়েছে। তবুও সে পরিস্থিতি একটুও পাল্টাতে পারেনি। তাই পরিস্থিতি বিচার করেই নিখিল এমন মন্তব্য করেছে। তার এই মন্তব্য তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা — একজনের সর্বস্ব ত্যাগ বা একজনকে খাওয়ালে মনের শাস্তি মেলে, দুর্ভিক্ষপীড়িত বৃহত্তর জনগণের মঙ্গল হয় না। তাছাড়া প্রত্যেক মানুষ তার দায়িত্ব যদি যথাযথ ভাবে পালন করে তবেই দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশের মানুষকে বাঁচানো যাবে।

This Post Has One Comment

Leave a Reply