লালন শাহ ফকিরের গান কবিতার সারাংশ দ্বিতীয় সেমিস্টার একাদশ শ্রেণি বাংলা | Lalon Shah Fokirer Gaan Kobitar Bisoibostu 2nd Semester Class 11 Bengali wbchse

WhatsApp Channel Join Now
Telegram Group Join Now

লালন শাহ ফকিরের গান কবিতার সারাংশ দ্বিতীয় সেমিস্টার একাদশ শ্রেণি বাংলা | Lalon Shah Fokirer Gaan Kobitar Bisoibostu 2nd Semester Class 11 Bengali wbchse

লালন শাহ ফকিরের গান কবিতার সারাংশ দ্বিতীয় সেমিস্টার একাদশ শ্রেণি বাংলা | Lalon Shah Fokirer Gaan Kobitar Bisoibostu 2nd Semester Class 11 Bengali wbchse

লালন শাহ ফকিরের গান
—লালন শাহ

মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি
মানুষ ছেড়ে ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি।।
দ্বি-দলের মৃণালে
সোনার মানুষ উজ্জ্বলে
মানুষ-গুরু কৃপা হ’লে

জানতে পাবি।।

এই মানুষে মানুষ গাথা
দেখ্ না যেমন আলেক লতা
জেনে শুনে মুড়াও মাথা

জাতে তরবি।।

মানুষ ছাড়া মন আমার
পড়বি রে তুই শূন্যকার
লালন বলে, মানুষ-আকার

ভজলে তরবি।।

(উৎসঃ লালন-গীতিকা, ৩৯১-পদসংখ্যা)

শব্দার্থ ও টীকা—
• ভজলে– ভজনা বা উপাসনা করলে,
• সোনার মানুষ– শুদ্ধ মানুষ, ক্ষ্যাপা পাগল,
• মূল– আসল অর্থাৎ মনের মানুষ,
• দ্বি-দল– দুই দল বা অক্ষর ‘হ’ এবং ‘ক্ষ’। হ হৃদয়ের প্রতীক আর ক্ষ ক্ষণ বা মুহূর্তের প্রতীক,
• মৃণাল– পদ্ম, • উজ্জ্বল– চকচকে,
• কৃপা– করুণা বা দয়া,
• আলেক– অলক্ষে,
• মুড়াও– মুন্ডন করা বা ন্যাড়া করা,
• শূন্যকার– নিরাকার বা আকার বিহীন,
• তরবি– ত্রাণ পাবি।

‘লালন শাহ ফকিরের গান’ কবিতার সংক্ষিপ্ত কবি পরিচিতি—

লালন শাহ ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি একাধারে সমাজ সংস্কারক, দার্শনিক ও মানবতাবাদী। একটি মত অনুসারে, লালন শাহ ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দের নদীয়া জেলার ভাঁড়ারা গ্রাম জন্মগ্রহণ করেন। আবার অন্য মতানুসারে, লালন সহ ছিলেন যশোহর জেলার ফুলবাড়ি গ্রামের এক মুসলমান পরিবারের সন্তান। তাঁর জন্ম নিয়ে বিভিন্ন পন্ডিতের বিভিন্ন মত-বিরোধ রয়েছে। তিনি বাংলার বাউল গানের শ্রেষ্ঠ রচয়িতা ছিলেন। তার গানে গ্রাম বাংলার মধ্যে সহজ সরল সুরে মানবতার জয়গান শোনা যায়।

• ‘লালন শাহ ফকিরের গান’ কবিতার উৎস—

ড. মতিলাল দাস এবং শ্রী পীযূষকান্তি মহাপাত্র সম্পাদিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত ‘লালন গীতিকা’ (১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দ) নামক লালনের গানের সংকলন থেকে ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’-টি নেওয়া হয়েছে। ‘লালন গীতিকা’ সংকলন গ্রন্থের ৩৯১ নম্বর গান হল ‘লালন শাহ ফকিরের গান’।

লালন শাহ ফকিরের গান—

বাউল কোনো স্বতন্ত্র ধর্মমত নয়, বাউল হল সাধনা। গ্রামবাংলার পথে-প্রান্তরে গেরুয়া বসনধারী যারা বাউল গান করেন, তারা সকলেই সাধক। আর, এই বাউল সাধকদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ হলেন লালন শাহ্। লালন তার গানের মধ্য দিয়ে সমস্তরকম ধর্মীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে, উদার মানবতার বাণী প্রচার করতেন।

(উৎসঃ লালন-গীতিকা, ৩৯১-পদসংখ্যা)

বাউল সাধনা সম্পর্কে কিছু কথা—

বিভিন্ন ধর্মে ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভের জন্য দেবালয় অথবা বিভিন্ন পবিত্র স্থানে (বা, তীর্থক্ষেত্রে) যাওয়ার কথা বলা হয়। বাউল সাধকেরা বিশ্বাস করেন, মানব দেহেই ঈশ্বর বিরাজ করেন। বাউল সাধনা আসলে দেহেরই সাধনা এবং এইজন্য বাউল গানকে বলা হয় দেহতত্বের গান। বাউল সাধনতত্ত্ব অনুযায়ী, মানব দেহে ছয়টি চক্র রয়েছে। এই ষট্-চক্র হল- মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ ও আজ্ঞা চক্র। এই ছয়টি চক্রের সবথেকে নিচে রয়েছে মূলাধার এবং সব থেকে উপরে, দুই ভ্রূ-র মধ্যিখানে রয়েছে আজ্ঞা চক্র। আজ্ঞা চক্রের ওপরেই বিরাজ করছে বাউলের ত্রিবেণী- ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না। এখানেই বাউলের আরশিনগর এবং এই আরশিনগরেই থাকে তাদের পরমেশ্বর বা মনের মানুষ বা সোনার মানুষ।

• ‘লালন শাহ ফকিরের গান’ কবিতাটি লাইন ধরে ধরে বিস্তারিত ব্যাখ্যা—

” মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি
মানুষ ছেড়ে ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি।।

ব্যাখ্যা : মানুষ ভজনা করলে সোনার মানুষ হওয়া যায়। অর্থাৎ খাঁটি বা শুদ্ধ মানুষ হতে গেলে মানুষের ভোজনা করতে হবে। মন থেকে মনুষত্ব। মানুষের মধ্যেই শক্তি-ভক্তি। আর মানুষের মনের মধ্যেই ঈশ্বরের অবস্থান। তাই লালন ফকির মানুষকে ভজনা করতে বলেছেন। আবার বলেছেন ক্ষ্যাপা তুই মানুষকে ছেড়ে দিলে তোমার মনুষত্ব হারিয়ে যাবে, তাই মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হলে মনের মানুষ এর সন্ধান পাওয়া যাবে না।

“দ্বি-দলের মৃণালে
সোনার মানুষ উজ্জ্বলে
মানুষ-গুরু কৃপা হ’লে
জানতে পাবি।।”

ব্যাখ্যা : দুই দলের কল্পিত পদ্মে সোনার মানুষ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে অর্থাৎ দ্বি-দল প্রস্ফুটিত হয় আজ্ঞাচক্রে। আর সেই দ্বি- দলের পদ্মে সোনার মানুষ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আমাদের দুটি ভ্রু-র মাঝে তার অবস্থান যা আমাদের চেতনাকে জাগ্রত করে আর একমাত্র গুরুর কৃপা হলেই এই সত্য জানা সম্ভব। অন্যথা সম্ভব নয়।

এই মানুষে মানুষ গাথা
দেখখা যেমন আলেক লতা
জেনে শুনে মুড়াও মাথা
জাতে তরবি।।

ব্যাখ্যা : এখানে লালন ফকির বলেছেন
মানুষের মধ্যেই মানুষের গাথা বা কাহিনী রচিত হয়ে আছে আলেক লতার মতো। অর্থাৎ পার্থিব মানব বা মানুষ শরীরের মধ্যেই বিরাজ করেন “মনের মানুষ বা সহজ মানুষ”। ঠিক যেমন লতা গাছের অলক্ষে বা দৃশ্যমানতার আড়ালে থাকে। আর বলেছেন- মাথা মোড়ালেই জাত ওঠে যায় না। এই সব কিছু জেনেও যে মাথা মোড়াই বা মুণ্ডিতমস্তক হয়, সে আসলে জাত-কে অবলম্বন করে মুক্তি খোঁজে।

মানুষ ছাড়া মন আমার
পড়বি রে তুই শূন্যকার
লালন বলে, মানুষ-আকার
ভজলে তরবি।।

ব্যাখ্যা : মানুষকে ছেড়ে অন্য স্থানে ঈশ্বর সন্ধান করলে শূন্যতাবোধ অনুভব করবে। কারণ মানুষের সঙ্গসুখ ছাড়া মানুষের মন অর্থহীন এবং মহাশূন্য। তাই ‘লালন শাহ ফকিরের গান’ কবিতার শেষে লালন শাহ বলেছেন- মানুষকে ভজনা করলেই একমাত্র ত্রাণ বা মুক্তি পাওয়া যাবে।

লালন শাহ্‌ ফকিরের গান কবিতার বিস্তারিত কবি পরিচিতি—

জন্ম ও বংশ পরিচয় : বাউল সাধনার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাধক এবং বাউলগানের কালজয়ী স্রষ্টা ছিলেন লালন ফকির। তাঁর জন্মস্থান, জন্মকাল, ধর্মমত এবং জাতি পরিচয় নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে বিস্তর মতপার্থক্য আছে। প্রচলিত মতানুসারে, ১৭৭৪ সালে পূর্বতন নদিয়া জেলার ছাপড়া, বর্তমান বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার কামারখালির কাছে ‘গোরাই’ নদীর তীরবর্তী ভাঁড়ারা গ্রামে এক হিন্দু কায়স্থ পরিবারে লালন জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল মাধব কর, জননী পদ্মাবতী। অপর মতানুযায়ী, যশোহর জেলার ঝিনাইদহের হরিশপুর গ্রামে তাঁর জন্ম হয়। পাশাপাশি অনেকে ধারণা করেন, যশোর জেলার ফুলবাড়ি গ্রামের মুসলমান পরিবারের সন্তান ছিলেন লালন।

বাল্য ও যৌবনকাল : অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সন্তান লালন শৈশবেই পিতৃহারা হন। নিদারুণ দারিদ্র্য ও অসহনীয় আর্থিক কষ্টের মধ্যে বড়ো হতে হয় তাঁকে। পারিবারিক ভয়ংকর প্রতিকূল পরিস্থিতি ও আর্থিক অস্বাচ্ছন্দ্যের কারণে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিতে পারেননি। তিনি ছিলেন নিরক্ষর। অল্পবয়সে বিবাহের পর প্রতিবেশী এবং জ্ঞাতিকুটুম্বদের সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় লালন বিধবা জননী এবং স্ত্রীকে নিয়ে ভাঁড়ারা গ্রামের অভ্যন্তরেই দাসপাড়ায় বসবাস করতে থাকেন।

জনশ্রুতি আছে, বিবাহের পর তীর্থযাত্রায় গিয়ে লালন প্রত্যাবর্তনকালে মারণ বসন্তরোগে আক্রান্ত হন। দুরন্ত ব্যাধির প্রকোপে অসাড় লালনকে সহযাত্রীরা মৃত ভেবে শাস্ত্রমতে মুখাগ্নি করে গঙ্গাবক্ষে ভাসিয়ে দেয় এবং ঘরে ফিরে আসে।

এদিকে মুমূর্ষু লালনের অচৈতন্য দেহ ভাসতে ভাসতে এক নদীঘাটে এসে উপস্থিত হয়। যেখানে এক তন্তুবায় মুসলিম রমণী লালনকে নিজগৃহে নিয়ে আসেন এবং অতি যত্নে সেবা-শুশ্রুষা করে ধীরে ধীরে সুস্থ করে তোলেন। এভাবে মুসলমান দম্পতির আপ্রাণ চেষ্টায় নবজীবন লাভ করেন লালন।

আরোগ্যলাভের পর লালন নিজ স্ত্রী এবং জননীর কাছে ফিরে গেলে, মুসলমান পরিবারের সান্নিধ্যে থাকার অপরাধে তাঁকে সমাজ থেকে বহিষ্কার করা হয়।

ফকির ধর্মগ্রহণ ও বাউলসাধনা : গ্রাম থেকে প্রত্যাখ্যাত লালন এরপর শাস্ত্রাচার, জাত-ধর্ম, সমাজসংস্কার সম্পর্কে স্বভাবতই বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন। এইসময় সিরাজ সাঁই নামে এক বাউল দরবেশের সঙ্গে লালনের সাক্ষাৎ হয়। সিরাজ সাঁই-এর আদর্শে অনুপ্রাণিত লালন তাঁর সাধনকর্মে দীক্ষিত হয়ে ফকিরি ধর্মগ্রহণ করেন। এই ঘটনার কয়েক মাস পরে লালন কুষ্ঠিয়া জেলার নিকটবর্তী ছেঁউড়িয়া গ্রামে এসে বাউলসাধনার আখড়া গড়ে তোলেন। পরবর্তীকালে তিনি প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের জমিদারি এলাকার নিষ্কর জঙ্গলের মধ্যেকার জমিতে নির্মিত আশ্রমেই আমৃত্যু সাধনভজনে নিরত থেকেছেন।

রচনাবৈশিষ্ট্য : লালন ছিলেন একজন মরমি স্বভাবকবি। গ্রামবাংলার মেঠো পথ দিয়ে যেতে যেতে তিনি একতারা হাতে নিয়ে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিমায় মুখে মুখে গান বেঁধেছেন। প্রত্যেক ধর্মের প্রতিই তিনি ছিলেন অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। তাই জাতপাত, সম্প্রদায় বিদ্বেষ এবং প্রথা-সংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি সুস্পষ্ট অবস্থান নিয়েছেন। বিশ্বনাগরিক লালন তাই হয়ে উঠেছেন শান্তি, সাম্য, সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য, কল্যাণ ও মানবতার মূর্ত প্রতীক।

বাউলরা ছিলেন সহজিয়া সাধক বা দেহাত্মবাদী। লালন মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, বিশ্ববিধাতার অধিষ্ঠান কোনো ঊর্ধ্বলোকে নয়, মনের মন্দিরে। পার্থিব টান শূন্য হয়ে অন্তরের আলো দিয়েই তাঁর দর্শন মেলে। জীবাত্মা মিলিত হয় পরমাত্মায়।

দেহের সীমার মধ্যেই লালন তাই অনন্ত অসীম মনের মানুষের সন্ধান করেছেন।

লালনমানসে তত্ত্বচিন্তার সঙ্গে দর্শনচিন্তার এক অপূর্ব যুগলবন্দি ঘটেছে। তিনি বলেছেন, কামগন্ধহীন শুদ্ধ প্রেমের পথ ধরেই সাধক প্রেমিককে ঐশী প্রেমের জগতে পৌঁছে যেতে হয়। লালন এসব গূঢ় তত্ত্বকথাকে সহজসরল ভঙ্গিতে গানের মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।

লোকসংগীতের এই বিশিষ্ট ধারা অর্থাৎ বাউলগানের সর্বশ্রেষ্ঠ সাধক লালন ফকির বাউল পর্যায়ের প্রায় সকল শ্রেণি তথা দেহতত্ত্ব, মুর্শিদা, গুরুবাদী, বৈয়ব, দরবেশি ও মারফতি গানের মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন। উপমা-রূপক, পরিচিত চিত্রকল্প, প্রচলিত প্রবাদ-প্রবচন এবং আটপৌরে জীবনে ব্যবহৃত শব্দচয়ন তাঁর গানগুলিকে কাব্যমাধুর্যমণ্ডিত করেছে। লালন সংগীতের সুরমাধুর্যরীতি, উপস্থাপনের পদ্ধতি এবং হৃদয়স্পর্শী আবেদন যেমন লালনগীতিকে স্বতন্ত্র মাত্রা দিয়েছে, তেমনই শ্রোতাকে বিমোহিত করেছে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালনের গানের অনুসরণে পরে বহু গান রচনা করেছিলেন।

অন্তিমকাল ও দেহাবসান : লালনের প্রায় দশ হাজার শিষ্য ছিল। বৃদ্ধ বয়সেও অশ্বারোহণে দক্ষ লালন ঘোড়ায় চড়ে শিষ্যদের বাড়ি যেতেন। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে ফকির শীতল শাহ্, ফকির ভোলাই শাহ্, ফকির মনিরুদ্দিন শাহ্, ফকির পাঁচু শাহ প্রমুখ ছিলেন তাঁর অত্যন্ত কাছের। অবশ্য জীবনের উপান্তে এসে উপার্জনহীন লালনকে তাঁর সুযোগ্য শিষ্যরা সযত্নে দেখাশোনা করতেন। জানা যায়, “পীড়িত অবস্থাতেও পরমেশ্বরের নামে পূর্ববৎ সাধন করিতেন, মধ্যে মধ্যে গানে উন্মত্ত হইতেন। ধর্মের আলাপ পাইলে নববলে বলীয়ান হইয়া রোগের যাতনা ভুলিয়া যাইতেন।… মরণের পূর্ব রাত্রিতেও প্রায় সমস্ত সময় গান করিয়া রাত্রি আটটার সময় শিষ্যগণকে বলেন, ‘আমি চলিলাম’। ইহার কিয়ৎকাল পরে শ্বাসরুদ্ধ হয়।” (হিতকরী পাক্ষিক পত্রিকা / ৩১ অক্টোবর, ১৮৯০)। তথ্যসূত্র: লালন সমগ্র/আবুল আহসান চৌধুরী।

১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর লালনের জীবনাবসান হয়। মৃত্যুর পর সাধকের উপদেশ অনুসারে কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের নিয়ম মেনে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়নি। কেবল ‘হরিনাম কীর্তন হইয়াছিল।’ আর ‘আখড়ার মধ্যে একটি ঘরে তাঁহার সমাধি হইয়াছে।’ বলে জানা যায়।

লালন শাহ্‌ ফকিরের গান কবিতার বিষয়সংক্ষেপ—

“মানুষ ভজে মানুষ ধর, মন, যাবি তুই ভব পার।”– পাঞ্জু শাহ

লালন ফকিরের বাউলগীতির অন্তরের কথা ছিল মানবপ্রেম। মানুষেরই মধ্যে তাঁর ঈশ্বরসাধনার তথাকথিত ঈশ্বরকে তিনি খুঁজেছেন, মূলে ছিল মানবসেবা। তাই সোনার মানুষ বা মানবশ্রেষ্ঠ হওয়ার একমাত্র পথ হল মানুষরূপী ঈশ্বরকে সন্ধান করা- এ কথা তাঁর গানগুলিতে ফিরে ফিরে এসেছে।

দেহবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত গুরুমুখী বাউলসাধনার বাস্তবিক আধার মানুষ। লালন ফকির বিশ্বাস করতেন- মানুষের গড, খোদা, আল্লাহ্, ভগবান সকলেই নিরাকার অবস্থায় আমাদের আপন ঘরে অর্থাৎ আত্মায় মিশে রয়েছেন। তাঁকে অন্যত্র খুঁজতে যাওয়া বৃথা। মানবপ্রেমের জাগরণে জন্মায় মনুষ্যত্ববোধ, তখন হয়ে ওঠা যায় সোনার মানুষ বা আলোকিত জন। তাই মানুষই উপাস্য হওয়া উচিত। মানুষের সঙ্গ ছাড়া সাধনা সম্পূর্ণ হয় না, সমাজও মূল্যবোধ হারায়। আর তার ফলে সমাজে মানবতাবোধের অবক্ষয় ঘটে, সমাজ হয়ে পড়ে ক্ষয়িষ্ণু। মনুষ্যত্ব হারালে মানুষকে মনুষ্যেতর হয়ে কাল কাটাতে হয়, যা কাম্য নয়।

বাউল সাধকের সাধনার বীজমন্ত্র হল-যা আছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে তা আছে দেহভাণ্ডে। এই দেহভান্ডের মধ্যেই তাঁদের অন্বেষণ পরমপুরুষের। বাউল বলছে, মানবদেহে রয়েছে সাতটি চক্র। সেই সাতটি চক্রের অন্যতম ‘আজ্ঞাচক্র’-টি রয়েছে মানুষের দুটি ভূ-র মাঝে- এটি দুই দলবিশিষ্ট। এই আজ্ঞাচক্রেই আমাদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হয়। এই আজ্ঞাচক্রেই জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলন ঘটে। গুরুবাদী এই বাউলসাধনায় গুরুর নির্দেশেই আজ্ঞাচক্রে মনের মানুষের উজ্জ্বল উপস্থিতি অনুভব করা যায়।

সত্যসন্ধানী, মরমি কবি, বাউল সাধক লালন সাঁইয়ের আজীবনের স্বপ্ন ছিল, মানুষের পৃথিবী হবে মানবধর্মের চারণক্ষেত্র। তাই মানুষের মধ্যে তিনি সন্ধান করেছেন অরূপরতন। ‘আত্মানাং বিদ্ধি’- আপন ঘরের আয়নাতেই মুখ দেখা যায় আরশিনগরের পড়শির। তাই সাধক বলছেন ‘মানুষে মানুষ গাথা।’ এখানে এক মানুষ বদ্ধজীব। অন্যজন পরমাত্মা। রক্তমাংসের মানুষই নিজের অন্তরে ধারণ করেছেন মনের মানুষকে। আলেক লতা বা স্বর্ণলতা যেমন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে মহিরুহকে, জীবাত্মা- পরমাত্মাও তেমনই একই দেহে অভিন্ন হয়ে জড়িয়ে থাকে। কিন্তু সেই পরমাত্মার সাধনায় আমরা ভ্রান্ত পথকে বেছে নিই। তুচ্ছ আচার-অনুষ্ঠানে সময় ফুরিয়ে ফেলি। চেতনার আলো এসে মনকে বিশুদ্ধ না করলে পরমপুরুষ অবধি পৌঁছোয় না-তখন অদ্ভুত এক শূন্যতা গ্রাস করে আমাদের। মানুষকে ভালোবাসতে পারলেই এই কঠোর সাধনায় সিদ্ধিলাভ সম্ভব। মানুষ ভজনাতেই আলেখ পুরুষ বা অলক্ষের সেই নিরাকার মনের মানুষ সাকাররূপে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। আর তাঁর সাক্ষাৎ পেলেই মানুষের মুক্তিলাভ হয়। মানুষ হয়ে ওঠে খাঁটি মানুষ বা সোনার মানুষ।

📌আরও পড়ুনঃ

1. একাদশ শ্রেণির বাংলা সিলেবাস ও প্রশ্ন প্যাটার্নClick Here

2. একাদশ শ্রেণির বাংলা সমস্ত অধ্যায়ের প্রশ্নোত্তর Click Here

Leave a Reply