নুন কবিতা – জয় গোস্বামী, সারাংশ, নামকরণের সার্থকতা | Noon Kobita – Joy Goswami
নুন কবিতা – জয় গোস্বামী, সারাংশ, নামকরণের সার্থকতা একাদশ শ্রেণি বাংলা দ্বিতীয় সেমিস্টার | Noon Kobita – Joy Goswami Class 11 Bengali 2nd Semester wbbse
নুন
জয় গোস্বামী
আমরা তো অল্পে খুশি; কী হবে দুঃখ করে?
আমাদের দিন চলে যায় সাধারণ ভাতকাপড়ে।
চলে যায় দিন আমাদের অসুখে ধারদেনাতে
রাত্তিরে দু-ভাই মিলে টান দিই গঞ্জিকাতে
সব দিন হয় না বাজার; হলে, হয় মাত্রাছাড়া
বাড়িতে ফেরার পথে কিনে আনি গোলাপচারা
কিন্তু পুঁতব কোথায় ? ফুল কি হবেই তাতে ?
সে অনেক পরের কথা। টান দিই গঞ্জিকাতে।
আমরা তো এতেই খুশি; বলো আর অধিক কে চায় ?
হেসে খেলে, কষ্ট করে, আমাদের দিন চলে যায়
মাঝে মাঝে চলেও না দিন, বাড়ি ফিরি দুপুররাতে
খেতে বসে রাগ চড়ে যায়, নুন নেই ঠান্ডা ভাতে
রাগ চড়ে মাথায় আমার, আমি তার মাথায় চড়ি
বাপব্যাটা দু-ভাই মিলে সারাপাড়া মাথায় করি
করি তো কার তাতে কী ? আমরা তো সামান্য লোক
আমাদের শুকনো ভাতে লবণের ব্যবস্থা হোক।
কবি পরিচিতিঃ জয় গোস্বামী : জন্ম ১৯৫৪, কলকাতায়। বাংলা সাহিত্যের এক খ্যাতিমান কবি। তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য কবিতার বই ‘প্রত্নজীব’, ‘উন্মাদের পাঠক্রম’, ‘ভূতুমভগবান’, ‘ঘুমিয়েছ ঝাউপাতা ?’, ‘বজ্রবিদ্যুৎখাতা’, ‘পাগলী তোমার সঙ্গে’, ‘সূর্য পোড়া ছাই’, ‘হরিণের জন্য একক’, ‘ভালোটি বাসিব’, শিবির’, ‘গরাদ! গরাদ।’ প্রভৃতি। ‘যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল’ তাঁর স্বরণীয় কাব্য-উপন্যাস। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘সেই সব শেয়ালেরা’, ‘সুড়ঙ্গ ও প্রতিরক্ষা’ প্রভৃতি। বাংলা আলোচনায় তাঁর লেখা ‘আকস্মিকের খেলা’, ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’, ‘গোঁসাইবাগান (তিন খণ্ড)’
উল্লেখযোগ্য সংযোজন।
উৎসঃ কবিতাটি কবির ‘ভুতুমভগবান’ কবিতা সংকলন থেকে নেওয়া হয়েছে।
কবিতাটির গদ্যরূপঃ কবিতাটি উত্তম পুরুষের জবানিতে লিখিত। অর্থাৎ, বক্তা আমি / আমরা দিয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করেছে। এখানে বক্তাকে ‘কবি’ না বলে ‘কথক’ বলাই ভালো। এবার দেখে নেওয়া যাক ‘নুন’ কবিতার কথকের বক্তব্যটা কী ?
কবিতার শুরুতেই কথক নিজেদের মানসিকতা স্পষ্ট করে দিয়ে বলেছে যে তারা অল্পেই খুশি। এজন্য তাদের দুঃখ নেই। সাধারণ অন্ন-বস্ত্রে তাদের দিন কেটে যায়। তাদের দিন চলে যায়। অসুখ হলে একটু অসুবিধা হয়; ধার-দেনা করে বহুকষ্টে সংসার চলে। অভাবের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে নেশা করার ঝোঁক। রাতের বেলা দু’ভাইয়ে মিলে গঞ্জিকাতে টান দেয়। বলে রাখা ভালো, এখানে দুই ভাই মানে যে কথকের সহোদর, এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। হতে পারে সে কথকের নিজের ভাই, অথবা, কথকের মতোই আরেকজন অভাবী মানুষ সবদিন তাদের রোজগার হয় না, তাই সবদিন বাজারও হয় না। তবে, যেদিন একটু বেশি রোজগার হয়, সেদিন মাত্রাছাড়া বাজার করা হয়। প্রয়োজনীয়- অপ্রয়োজনীয় কিছুই বাদ যায় না সেদিন। নিজেদের থাকার মতো ভালো জায়গা নেই তার উপর বাজার থেকে কিনে নিয়ে আসে গোলাপের চারা।
গোলাপের চারা তো এল, কিন্তু কোথায় সেটা পোঁতা হবে ? কারণ, গোলাপ তো ফুলের রানী, গরিবের ঝুপড়ি বস্তিতে তাকে রাখবে কোথায় ? আর যদি একটু ভালোমতো জায়গা দেখে চারাটা পোঁতাই হয়, তাকে তো নিয়মিত পরিচর্যা করতে হবে। সুতরাং প্রশ্ন একটা থেকেই যায়- “ফুল কি হবেই তাতে” ? সেটা অবশ্য পরের কথা। এখন এতসব না ভেবে টান দেয় গঞ্জিকাতে। আসলে এই নেশা হল তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
এই জীবনেই তারা সন্তুষ্ট। কথকের মতে, “আমরা তো এতেই খুশি”। এর বেশি তাদের চাওয়ার নেই। ‘হেসে, খেলে, কষ্ট করে’ কোনোমতে তাদের দিন কেটে যায়। কিন্তু কারো সবদিন সমান যায় না। ‘দিন- আনি-দিন-খাই’-এর সংসারে কোনোদিন উপার্জন না হলে সংসারের চাকাটা হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। কথক হতাশার সুরে বলে- “মাঝে মাঝে চলেও না দিন”। কাজ নেই, হাতে টাকাও নেই। পেটভর্তি খিদে নিয়ে দুপুররাতে বাড়ি ফিরে আসে। রাতে ভাত খেতে বসে যখন দেখে যে ঠান্ডা ভাতে নুনটুকুও নেই, তখন সে আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না। ক্ষুধার জ্বালা আর নিত্য-অভাব মাথা বিগড়ে দেয় তার, রাগে ফেটে পড়ে সে।
আসলে ‘নুন’ তো শুধু লবণ নয়, নুন হল বেঁচে থাকার ন্যূনতম রসদ। সেটুকুও যখন জুটছে না, তখন রাগ হওয়াই স্বাভাবিক পেটে খিদে আছে, তাই রাগের মাত্রা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। সেই কথাটিই কবিতায় সুন্দরভাবে বলা হয়েছে- “রাগ চড়ে মাথায় আমার, আমি তার মাথায় চড়ি”- অর্থাৎ, উত্তরোত্তর রাগ বাড়তেই থাকে। এরপর ঘরের কথা আর ঘরে থাকে না, সারা পাড়া জানাজানি হয়ে যায়। “বাপব্যাটা দু-ভাই মিলে” চেঁচিয়ে সারা পাড়া মাথায় করে। এখন প্রশ্ন হতে পারে, বাপ আর ব্যাটা দু’ভাই হয় কী করে ? এটা আসলে রাগের বহিঃপ্রকাশ। রাগলে মানুষের বাহ্যিক জ্ঞান লোপ পায়, সেইজন্য ‘বাপব্যাটা দু-ভাই’ বলা হয়েছে।
ঘরের অভাবের কথা বাইরের লোক শুনল, তাদের কিন্তু এতে কোনো আক্ষেপ নেই। দুপুররাতে সারা পাড়া মাথায় করেছে, এটা ভেবে যদি কেউ বিরক্ত হয়, তাতেও কিছু যায় আসে না। কথকের সাফ জবাব- “করি তো কার তাতে কী ?” তারা তো নিতান্তই সামান্য লোক, তাই তাদের চাহিদাটাও সামান্য। কবিতার শেষে কথক কোনোরকম রাখঢাক না করে দাবি জানিয়েছে- “আমাদের শুকনো ভাতে লবণের ব্যবস্থা হোক।” এই দাবি সমাজের উঁচুতলার মানুষের কাছে।
সারমর্মঃ জয় গোস্বামীর লিখিত ‘নুন’ কবিতা সমাজের খেটে খাওয়া, গরিব শ্রেণির মানুষের কবিতা। কবিতায় স্থান পেয়েছে তাঁদের দুঃখের কথা, তাঁদের অভাবের কথা। এই মানুষদের বেশি চাওয়া পাওয়া নেই। তারা অল্পতেই খুশি, তাঁদের নেই কোন অভিযোগ, নেই অনেক বেশি পাওয়ার। এদের জীবন অতি সাধারন তারা সম্পূর্ণ দিন পরিশ্রম করে যা উপার্জন করে তাতেই তাঁদের সংসার চলে। অনেকদিন তাঁরা অনেক কিছু কিনতে করতে পারে না তাদের আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে তাঁদের বাড়ি ফিরতে হয় অনেক কিছু না নিয়েই।
অভাব থাকলেও কিন্তু তাদের নেশা থেমে থাকে না। আর্থিক ভাবে সচ্ছল না হলেও তাঁদের বিলাসিতার ইচ্ছে হয়। তাঁদের ইচ্ছে হয় কখনো বা একটি গোলাপ ফুলের চারা লাগানোর কিন্তু লাগাবার জায়গাটাও তাঁদের থাকে না।
অভাবের টানে অনেক সময় তাদের ঠান্ডা ভাতে নুন টুকুও জোটে না। তখনই শুরু হয় উৎপাত এবং এই উৎপাতের শব্দ শুনতে পায় সমস্ত পাড়ার মানুষ। কিন্তু এতে তাঁদের কোন লজ্জা বোধ হয় না কারণ কেহই তাহাদের কথা ভাবে না। তাঁদের জীবন যাপনের নিত্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও কেউই তাদের দেয়নি। তাই তাঁদের কাতর আবেদন যে তাদের নুনের ব্যবস্থা হোক। অর্থাৎ তাহাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অভাব ঘুচে যাক।
তাই এই কবিতায় ‘নুন’ শুধুমাত্র একটি উদাহরণ, একটি উপলক্ষ। নুন হচ্ছে দরিদ্র, মধ্যবিত্ত মানুষের চাওয়া পাওয়ার প্রতীক। যেভাবে নুন বা লবন রান্নার জন্য একটি মৌলিক উপাদান সেইভাবে তাদের জীবনে দু-বেলা দুমুঠো ভাত তাদের মৌলিক চাওয়া পাওয়া। কিন্তু সেইটুকুও তাদের কপালে জুটে না এবং এই মানুষদের জন্য তার ব্যবস্থা হউক এটা কেউ দেখে না । তাই নুন কবিতাটি দরিদ্র মানুষের আর্থ-সামাজিক অসচ্ছলতার প্রতীক।
নামকরণের সার্থকতা—
উত্তরঃ আধুনিককালের একজন বলিষ্ঠ কবি জয় গোস্বামী। তার “ভুতুমভগবান” কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত প্রতীকীধর্মী “নুন” কবিতাটিতে তিনি চিরকাল বঞ্চিত, পদলালিত, অসহায়- অত্যাচারীত মানুষের প্রতিনিধি হয়ে ঠাণ্ডা ভাতে নুনের বন্দোবস্তের দাবীতে সোচ্চার হয়েছেন। তবে ক্রমে ক্রমে সমগ্র কবিতা জুড়ে ধ্বনিত হয়েছে অন্নবস্ত্র বাসস্থানের মর্মর দাবীর হাহাকারের ধ্বনি।
সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের সামান্য অস্তিত্ব তাদেরকে অল্পেতেই খুশী হতে শেখায়। তাদের দিন চলে যায় সাধারণ ভাতকাপড়ে—
“আমরা তো অল্পে খুশী;কি হবে দুঃখ করে?
আমাদের দিন চলে যায় সাধারণ ভাত কাপড়ে।”
অসুখে তারা ধারদেনাতে ডুবে যায়। বিশেষ কিছু তারা কামনা করেনা, কেবল মোটা কাপড় আর মোটা চালের ভাতই তাদের কাম্য। শখ ও বিলাসিতা তাদের সিলেবাসে থাকে না। তবুও মাঝে মাঝে মাত্রাছাড়া বাজার করে আনে বাড়িতে, সাথে আনে গোলাপচারা, কিন্তু পুঁতবে কোথায় বা তাতে আদৌ ফুল ফুটবে কিনা সেবিষয়ে তারা আগে থেকে চিন্তাভাবনা করে না। তাদের অন্তরে থাকে সৌন্দর্যবোধ, কিন্তু সমাজের শোষক যন্ত্র তাদের এই সামান্য প্রাপ্তিকে মেটানোর সুযোগ পর্যন্ত দেয় না। রক্ষক যখন ভক্ষক হয়ে ওঠে তখন সাধারণ মানুষের জীবন ঋণের বেড়াজালে জর্জরিত হয়ে ভোলা মহেশ্বরের মত গঞ্জিকাতে টান দিত। তাদের বেদনার্ত মন কেঁদে ওঠে-
“কিন্তু, পুঁতবো কোথায় ? ফুল কি হবেই তাতে ?
সে অনেক পরের কথা, টান দিই গঞ্জিকাতে।”
তবে অনেকসময় দুপুররাতে বাড়ী ফিরে যখন ঠাণ্ডা ভাতে নুন না পায় তখন বাপ বেটায় বিভেদ ভুল নেশা করে দুই ভাই এর মত সারা পাড়া মাথায় করে। সারাদিন হাড় ভাঙা পরিশ্রমের শেষে যখন সামান্য নুন না জোটে তখনই তাদের প্রতিবাদী সত্ত্বা ধৈর্য হারিয়ে ক্ষোভে ফেটে বলে-
“আমরা তো সামান্য লোক, আমাদের শুকনো ভাতে লবণের ব্যবস্থা হোক।”
এই কবিতায় নুন থেকে লবণের অধিকারের দাবী কখনও হয়ে ওঠে স্বাদের দ্যোতক, কখনও বা খাদ্যের দ্যোতক… তাই এই কবিতায় নুন শব্দের মাধ্যমে প্রতীকী প্রয়োগের ব্যাপ্তি ঘটেছে। তাই কবিতার নামকরণ সার্থক ও সুসংগত হয়েছে।
📌আরও পড়ুনঃ
1. একাদশ শ্রেণির বাংলা সিলেবাস ও প্রশ্ন প্যাটার্ন Click Here
2. একাদশ শ্রেণির বাংলা সমস্ত অধ্যায়ের প্রশ্নোত্তর Click Here