বিদ্যাসাগর কবিতা মাইকেল মধুসূদন দত্ত একাদশ শ্রেণি বাংলা সেমেস্টার-১ | Vidyasagar Poem Michael Madhusudan Dutta Class 11 Bengali Semester-I WBCHSE

WhatsApp Channel Join Now
Telegram Group Join Now

বিদ্যাসাগর কবিতা মাইকেল মধুসূদন দত্ত একাদশ শ্রেণি বাংলা সেমেস্টার-১ | Vidyasagar Poem Michael Madhusudan Dutta Class 11 Bengali Semester-I WBCHSE

📌 একাদশ শ্রেণির বাংলা সমস্ত অধ্যায়ের প্রশ্নোত্তর Click Here

বিদ্যাসাগর
—মাইকেল মধুসূদন দত্ত

বিদ্যাসাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
দীন যে, দীনের বন্ধু!—উজ্জ্বল জগতে
হিমাদ্রির হেম-কান্তি অম্লান কিরণে।
কিন্তু ভাগ্য-বলে পেয়ে সে মহাপর্বতে,
যে জন আশ্রয় লয় সুবর্ণ-চরণে,
সেই জানে কত গুণ ধরে কত মতে
গিরীশ। কী সেবা তার সে সুখ-সদনে!—

দানে বারি নদীরূপ বিমলা কিংকরি ;
জোগায় অমৃত ফল পরম আদরে
দীর্ঘ-শিরঃ তরু-দল, দাসরূপ ধরি ;
পরিমলে ফুল-কুল দশ-দিশ ভরে ;
দিবসে শীতলশ্বাসী ছায়া, বনেশ্বরী,
নিশায় সুশান্ত নিদ্রা, ক্লান্তি দূর করে।

কবিতা লেখার উদ্দেশ্য ও সারাংশ—

মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর “ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর” কবিতায় বিদ্যাসাগরের প্রতি অসীম শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন। একদিকে তিনি যেমন বিদ্যাসাগর মহাশয়ের চারিত্রিক গুণগুলি প্রকাশ করেছেন, তেমনই অন্যদিকে ভারতের প্রতি বিদ্যাসাগর মহাশয়ের যে অপার ভালোবাসা এবং অবদান সে বিষয়েও আলোকপাত করেছেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর “সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতাটিতে মাইকেল মধুসূদন দত্ত বিদ্যাসাগরকে একই সঙ্গে বিদ্যার সাগর ও করুণার সাগর হিসেবে অভিহিত করেছেন। কবি বলেছেন – “বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে। করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,”

ঠিক তারপর কবি বিদ্যাসাগরকে ” দীনের বন্ধু” বলে সম্বোধন করেছেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের চরিত্রের মহান গুণগুলি এই সনেটের মাধ্যমে কবি উপস্থাপিত করেছেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সামগ্রিক জীবন আলোচনা করলে আমরা খুব সহজেই জানতে পারি, তাঁর সমুদ্রের ন্যায় তুলনীয় জ্ঞান, দীন – দরিদ্রের প্রতি অপার করুণা, ক্ষমার আধার, অসীম মাতৃস্নেহ – ইত্যাদি বৈশিষ্টগুলি তাঁর চরিত্রকে মহিমান্বিত করেছে এবং এই মহিমার সুফল পেয়েছে আপামর ভারতবাসী। মাইকেল মধুসূদন দত্তের লেখা সনেটটির প্রথম কয়েকটি চরণে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়কে তাঁর প্রকৃতরূপেই প্রকাশ করেছেন কবি।

পর্বত যেমন সূর্যের আলো গায়ে মেখে গলিত সোনার মত দ্যুতি বিকিরণ করে, আপন সৌন্দর্য দ্বারা মানবজাতিকে মোহাবিষ্ট করে; তখন যে ব্যক্তি সেই পর্বতের সান্নিধ্যলাভ করে, কেবল সেই জানে – পর্বতের কী অসীম সৌন্দর্য, কী অসীম গাম্ভীর্য, কত গুনের অধিকারী; ঠিক তেমনভাবেই মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর সনেটে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মহিমাকে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন—

হেমাদ্রির হেম-কান্তি অম্লান কিরণে। কিন্তু ভাগ্য-বলে পেয়ে সে মহা পর্বতে, যে জন আশ্রয় লয় সুবর্ণ চরণে, সেই জানে কত গুণ ধরে কত মতে গিরীশ। কি সেবা তার সে সুখ সদনে!

সনেটটিতে কবি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়কে হিমালয় পর্বতের বিশালতা ও ব্যাপকতার সঙ্গে তুলনা করেছেন। হিমালয় পর্বতকে রূপক অর্থে ব্যবহার করে তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মহিমান্বিত চরিত্র তুলে ধরেছেন। হিমালয় যেমন তার সবকিছু দিয়ে মানব ও প্রকৃতির সেবা করে তার নদী জল প্রদান করে, বৃক্ষরাজি সুস্বাদু ফল প্রদান করে, ফুলের তাদের দৈবিক সুগন্ধে প্রকৃতিকে মোহাচ্ছন্ন করে; বিদ্যাসাগর মহাশয় ঠিক তেমন ভাবেই নিজের সবটুকু দিয়ে মানব সমাজের সেবা করছেন জ্ঞানের বিকাশ ঘটিয়েছেন, নারীশিক্ষার বিস্তার ঘটিয়েছেন, সামাজিক কুসংস্কার প্রতিরোধে আজীবন আন্দোলন করেছেন, নিজের অর্থে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেছেন। তাই মাইকেল মধুসূদন দত্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়কে হিমালয় পর্বতের অপার মহিমার সঙ্গে তুলনা করেছেন।

পরিশেষে বলা যায়, সারা বিশ্বজগতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় জ্ঞানের অসীম আধার হিসেবে পরিচিত। কিন্তু, তাঁর চরিত্রের মধ্যে যে অন্যান্য মহামানবের গুণগুলি আছে, তা বিশ্বজগতের কাছে পরিচিত নয়। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর সনেটে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বহুমুখী মানবিক গুণগুলি অসাধারণ কৃতিত্বের সঙ্গে পাঠকবর্গের সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়েছেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় সারা জীবন ধরেই আর্তের সেবা করেছেন , অসহায়কে সাহায্য করেছেন, দরিদ্রের মুখে অন্ন জুগিয়েছেন। এমনকি, মাইকেল মধুসূদন দত্ত নিজেও চরম দারিদ্রতা ও অসহায়তার মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কৃপা ও সান্নিধ্যলাভ করেছিলেন। তাই তাঁর পক্ষে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বহুমুখী গুণাবলীর বর্ণনা তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এইভাবে ” ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ” সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতায় মাইকেল মধুসূদন দত্ত বিদ্যাসাগরের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন।

কবিতার প্রতিটি লাইনের ব্যাখ্যা—

বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
দীন যে, দীনের বন্ধু!

ব্যাখ্যা: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে কবি বলছেন: “তুমি বিদ্যার সাগর নামে ভারতে বিখ্যাত। কিন্তু হে দীনের বন্ধু, তুমি যে করুণারও সমুদ্র, এ কথা সেই জানে, যে দীন বা দরিদ্র।” এখানে চরণের শেষে অবস্থিত ‘দীনের বন্ধু’ অংশটি সম্বোধন রূপে ব্যবহৃত হয়েছে।

(“দীন যে, দীনের বন্ধু” অংশটির ভুল ব্যাখ্যা অনেকেই করে থাকেন। তাঁরা বলেন “যে দীন, সে-ই দীনের বন্ধু” বা গরীবই গরীবের বন্ধু। এ রকম ব্যাখ্যা নিতান্তই হাস্যকর। এ রকম হলে ‘যে’-এর পর কমা চিহ্ন থাকতো না। তাছাড়া এই কবিতায় বিদ্যাসাগরকে গরীব বলা হয়নি, গরীবের বন্ধু বলা হয়েছে। তিনি গরীব ছিলেনও না। সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ বিদ্যাসাগরের মাসিক মাইনে ছিলো ৫০০ টাকা। বর্তমান দিনে যার মূল্য ৫ লক্ষ টাকার বেশি।)

উজ্জ্বল জগতে
হেমাদ্রির হেম-কান্তি অম্লান কিরণে।
কিন্তু ভাগ্য-বলে পেয়ে সে মহা পর্বতে,
যে জন আশ্রয় লয় সুবর্ণ চরণে,
সেই জানে কত গুণ ধরে কত মতে গিরীশ।
কি সেবা তার সে সুখ সদনে!

ব্যাখ্যা: পরবর্তী অংশে কবি বলছেন: অম্লান সূর্য কিরণে হিমালয় পর্বতের সোনার মতো রূপ (হেম-কান্তি) জগতে উজ্জ্বল। কিন্তু ভাগ্যগুণে যে ব্যক্তি সেই মহা-পর্বতকে পায় এবং তার সোনার চরণে আশ্রয় নেয়, সে-ই জানে গিরিশ (গিরিশ্রেষ্ঠ) কত গুণের অধিকারী। তার সদনে (গৃহে) কত সেবার আয়োজন।

দানে বারি নদীরূপ বিমলা কিঙ্করী।
যোগায় অমৃত ফল পরম আদরে দীর্ঘ-শিরঃ তরু-দল, দাসরূপ ধরি।
পরিমলে ফুল-কুল দশ দিশ ভরে, দিবসে শীতল শ্বাসী ছায়া, বনেশ্বরী, নিশায় সুশান্ত নিদ্রা, ক্লান্তি দূর করে।

কবিতার শেষ ছটি পংক্তি বা ষটকে কবি হিমালয় পর্বতের গুণগান করেছেন (আসলে হিমালয়ের গুণগানের মধ্য দিয়ে বিদ্যাসাগরের গুণগান করেছেন।) তিনি বলেছেন– বিমলা (অর্থাৎ পরিচ্ছন্ন) নদী দাসী রূপে জল দেয়। দীর্ঘ গাছেরা দাস রূপ ধরে অমৃতের মত সুস্বাদু ফল দান করে। ফুলেরা সুগন্ধে দশদিক ভরিয়ে তোলে। দিনের বেলায় শীতল শ্বাসী ছায়া দেয়। রাত্রিবেলা শান্তির নিদ্রা ক্লান্তি দূর করে।

কবিতার সারাংশ—

এই কবিতায় কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত বিদ্যাসাগরের দয়াগুণের বর্ণনা দিতে গিয়ে এই পরম ব্যক্তিত্বময় মহাপুরুষকে হিমালয় পর্বতের সঙ্গে তুলনা করেছেন। বিদ্যাসাগরের বিদ্যাকে তিনি তুলনা করেছেন হিমালয়ের চূড়ার সৌন্দর্যের সঙ্গে, আর বিদ্যাসাগরের দয়াগুণকে তুলনা করেছেন হিমালয়ের চরণে আশ্রিত ব্যক্তির প্রতি হিমালয়ের বদান্যতার (বদান্যতা মানে উদারতা বা দান করার প্রবণতা) সাথে। বিদ্যাসাগর বিদ্যার সাগর রূপেই ভারতে বিখ্যাত, কিন্তু যে গরীব, এবং যে বিদ্যাসাগরের দয়াগুণের পরিচয় লাভ করেছে, সেই জানে, তিনি দয়ারও সমুদ্র।

হিমালয় পর্বতের সৌন্দর্য দূর থেকে দেখে মন ভরে যায়। কিন্তু যে সৌভাগ্যবশত হিমালয়ের সোনার চরণে আশ্রয় নেয়, সেই জানে গিরীশ (হিমালয়) কত গুণের অধিকারী। আশ্রিত ব্যক্তিকে নিজের সবকিছু দিয়ে সেবা করা ছিলো বিদ্যাসাগরের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত নিজের দারিদ্র্য ও অসহায়তার সময়ে বিদ্যাসাগরের দয়াগুণের পরিচয় লাভ করেছেন। তাই তিনি বিদ্যাসাগরকে দুই দিক থেকেই চেনেন।

Leave a Reply